পোস্টস

গল্প

সলতে জ্বলা আগুন

১৯ নভেম্বর ২০২৪

সুকান্ত সোম

ভালো মানুষ দিয়ে কি মনের মানুষের সাধ পূরণ হয়? নাকি জলের তৃষ্ণা অমৃত সুধায় মেটে? গত সাতাশ টি বছর এই ভালো মানুষটির সাথে ভালো মানুষের অভিনয় করতে করতে নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়। আমি তার যোগ্য কখনো ছিলাম না। তাকে ভালোবাসতে চেয়েছি, কিন্তু তার বিশাল মনের কাছে নিজের ক্ষুদ্র মন শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছে। আমি যে ভালোবাসার কথা বলছি সেখানে দুটি মনের সমান অনুভুতির প্রকাশ ঘটে। অথচ আমার বরের সামনে নিজেকে, নিজের মনকে এতো ক্ষুদ্র মনে হয় সেখানে তার বিশাল মনের প্রতি কেবল শ্রদ্ধায় আসে সে ভালোবাসা নয়। সে মানুষটার সাথে গত সাতাশ টি বছর সংসার করছি, অথচ মানুষটিকে কখনো আমি ভিন্ন রুপে পাইনি। আমি যাকে ভালো বাসতাম তার প্রতি ঘৃনাও এসেছে কিন্তু স্থায়ী রুপ দিতে পারিনি। মানুষ নাকি অনেক বার প্রেমে পড়ে আর আমি এমন মানুষের প্রেমে পড়েছিলাম তার মাঝে কি এমন পেলাম যে আজ সাতাশ বছর পরেও স্বর্গের মাঝে থেকেও সে দহন জ্বালার অসুখ কে দূরে ঠেলে দিয়ে বরকে ভালোবাসতে পারলাম না। নিজেকে বোঝাতে পারি না যে আমাকে তার সর্বস্ব উজার করে দিলো থাকে মন থেকে শ্রদ্ধা ছাড়া নারী পুরুষের ভালো বাসার নির্যাস দিতে পারলাম না। অথচ সকাল সন্ধায় যে মানুষটি সুখের সাথে ব্যথার অনুভুতি দিতেও কার্পন্য করেনি তার কথা আজো ভুলতে পারলাম না। নিজের সাথে এ এক আশ্চর্য লুকোচুরি করে যাচ্ছি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকি। আমাকে নিয়ে আমার বর ঘুরতে যাবে। কি চাই না চাই তাই নিয়ে অনেক পাগলামী করবে। তার একটা বিবাহ যোগ্য মেয়ে আছে সে বেমালুম ভুলে গিয়ে ছেলে মানুষিতে মেতে উঠবে। নিপাট ভদ্র লোক। অথচ কোন এক মানুষের জন্য কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতাম কখন আসবে এই দিন, সে দিনে উইশ করবে। করতো না তা নয় হয়তো কেউ মনে করিয়ে দিতো কিংবা সম্বিত ফিরে পেয়ে বোধদয় হতো আজ কারো হয়তো জন্ম দিন;কিংবা আজকে ভ্যালেন্টাইস ডে। আমার

বরটা মস্ত বড় কর্পোরেট কোম্পানির বড় পর্যায়ের

কর্মকর্তা দারুন এক সংবেদনশীল মানুষ অথচ যার জন্য এই মানুষটিকে ভালো করে ভালোবাসতে পারিনি সে মানুষটি প্রাইমারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একটা জবের জন্য তাকে কত পীড়াপিড়ী করেছি কিন্তু করেনি। বলতো তুমি জব করবে আর আমি লেখালেখি করবো। তুমি হবে বিখ্যাত কবির বউ। তারপরেও চাকরী জুটিয়েছিল, আমার বাবা যখন বিয়ের জন্য ছেলে খুজতে ছিল। আমাকে পাবার জন্য তার এ প্রচেষ্টা আমাকে যে কি পরিমান তৃপ্তি দিয়েছিল কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। তার অতীতে

বাউন্ডেলেপনা আর খাম খেয়ালির যে কষ্ট আমার নিমিষেই চলে গিয়েছিল। সে বলতো আমি মনে রাখবো কবিতা আর তুমি মনে রাখবে আমাকে, আমাদের প্রেমের সমস্ত আয়োজন করবে তুমি আর আমি আয়োজন করবো পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য কবিতা৷ সেখনে আমার কবিতা ভীত গড়ে দেবে তুমি। তুমি হবে আমার কবিতার কারিগর। আমার নিরিবিলি মস্তিষ্কের এক মাত্র স্বত্বাধিকার যার ত্যাগেই রচিত হবে বিখ্যাত প্রেমের কবি। কিন্তু আমার বাবা যেদিন তাকে ডেকেছিল সেদিন সে কেন জানিনা বাবার সাথে দেখা করেনি। কোন অজানা কারনে আমার সাথেও দেখা করেনি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকি৷ প্রতিটি বিবাহ বার্ষিকিতে আমার বর আমাকে নিয়ে কি করবে না করবে ভেবে পায়না। আমার প্রতিটি

চাওয়া পাওয়ার প্রতি তার গভীর মনোযোগ। কিন্তু আমার মনোযোগ ছিল সে অমনোগী মানুষটার প্রতি যে কিনা আমার বাবার সামনে আসার সাহস টুকু পায়নি। ও বাঊন্ডেলে ছিল জানতাম তাই বলে কাপুরুষ ছিল তা জানতাম না।আমার বাবার সামনে আসলে আমার বাবা বোধহয় ওকে না করতো। মানুষকে কনভিন্স করানোর মত অলোকিক ক্ষমতা ওর ছিল। মানুষকে বোঝাতে পারতো। আমার বাবাকেও ও বোঝাতে পারতো। কিন্তু কেন আমার বাবার সামনে ও আসেনি আমি জানিনা। সমস্তটা দিন আমি অপেক্ষা করেছি। সকাল ১০টায় ওর আসার কথা ছিল। অথচ ও আসেনি। বাবার কোন এক বন্ধুর ছেলে আমাকে সেইদিন দেখতে আসার কথা ছিল। বাবা আমাকে সেই ছেলের বিষয়ে যা যা বলেছিল আজকে তার সত্যটা সেই ছেলের সাথেই সাতাশটি বছর দেখছি৷ আমি বাবাকে বলেছিলাম আমার একটা ছেলে কে ভাল লাগে তাকে আমি আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। বাবা তার বন্ধুর ছেলে যেইদিন দেখতে আসবে সেই দিন তার কয়েকদিন আগেই তাকে সেই তারিখ ঠিক সকাল ১০ টায় আসতে বলেছিল। বাবা বলেছিল ছেলে তুই যে ছেলে সম্পর্কে বলছিস আমি খোজ নিয়েছি। সে ছেলে ভালো কি মন্দ আমি সে তর্কে যাবো না। তবে বাবা হিসেবে তোকে জোড় করে কাউকে তোর উপর চাপিয়ে দিবো না। তবে এটুকু বলতে পারি যে ছেলে তোকে দেখতে আসার কথা সে ছেলে আর তো পছন্দের ছেলে একই সময় দেখতে আসবে। তুই এই ছেলের কথা তাকে বলবি না। বললে হয়তো আসবে না। তারপর তুই দুই জনকেই দেখবি। কথা বলবি। যাকে ভালো লাগবে সেই দিনই তার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে ধুমধামের সাথে তোর বিয়ের আয়োজন করবো। তবে তোকে একটা কথা বলে রাখি মা। আজকে যেই ছেলে আর ছেলের বাবা তোকে দেখতে আসবে সেই ছেলের দাদুর জন্যই আমার এতোদুর আসা। জীবনে খুব ইচ্ছে ছিল কখনো যদি সুযোগ আসে আমি তাদের জন্য যদি কিছু করতে পারতাম। নিজেকে হালকা মনে হতো। একটা তৃপ্তি নিয়ে জীবনের বাকি অংশ টুকু পাড় করতাম। তাছাড়া ছেলে টা বড় অমায়িক ছেলে। এমন ছেলের হাতে যেকোন মেয়ের বাবায় তার মেয়েকে দিতে পারলে শান্তি পেতো। তবে তারা আসলেই যে তোর সাথে বিয়ে হবে, তোকে পছন্দ হবে এমন কোন কথা নেই। তোর পছন্দের গুরুত্ব আমাকে দিতে হবে। আমার মেয়ে যেখানে খুশি থাকবে সেটাও আমার বিবেচ্য বিষয়। তবে অনুরোধ তোর পছন্দের ছেলেটা যেন সেইদিনই সকাল ১০ টায় আসে। আমি জানিনা বাবা কেন একই সময় আসতে বলেছিল। বাবার কথার মাঝে এ এক বিষয় ছাড়া অন্য কোন কিছুই পাইনি। কারন প্রতিটা বাবায় চায় তার মেয়েকে ভালো ছেলে হাতে পাত্রস্ত করতে আবার আমার পছন্দের গুরত্ব ও বাবা দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন ও আসেনি। আমি অপেক্ষা করেছি সারাটা দিন কিন্তু ও আসেনি। আমি অপমানিত হয়েছিলাম বাবার নিকট। বাবা বলেছিল ছেলে পক্ষরা তোকে পছন্দ করেছে তুই যদি ওই ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করতে চাস করতে পারিস। আমি রাগে, অপমানে বলেছিলাম বাবা তুমি আজকেই বিয়ে ঠিক করতে পারবা? বাবা আমাকে সময় নিতে বলেছিল। আমি নিইনাই। কার জন্য নেব? এক বাঊন্ডেলের জন্য। যে আমাকে কখনই ভালোই বাসেনি। আমার গুরুত্ব যার কাছে কোন দিনই ছিল না।বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এ সাতাশ টি বছর এ মানুষটি আমার প্রতিটা কথা গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ তাকে এক শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি।ভালো বাসতে পারিনি৷ কোন এক বাউন্ডেলে মানুষের প্রেমে পড়ে ভালো মানুষটার সাথে অভিনয় করে গিয়েছি। বার টা বছর তবুও মনের কোনে সে মানুষটা প্রতি ঘৃনা ভরা মন নিয়ে বর্তমান কে নিয়েই বাচতে চেয়েছিলাম। মনে নিতে না পারলে মানিয়ে চলছিলাম।মেয়েটাও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে।সব মিলিয়ে জীবন চলছিল পৃথিবীর আহ্নিক গতির সাথে তাল মিলিয়ে। মেয়েটার বৃত্তি পরিক্ষার দিন মেয়ের বাবার সাথে মেয়েকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবটরি স্কুলে গিয়েছিলাম। জ্যামের কারনে মেয়েকে নিয়ে সেদিন একটু আগেই যেতে হয়েছিল। ঠিক একটা মানুষকে দেখে আমার মাথাটা ঘুরে গেল। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ভাল করে দেখে নিলাম।আরে এতো সে যে না না আমি কি ঠিক দেখছি নাকি ভুল। এখানে কি করছে? আমার বর আমার পাশেই ছিল। কোন রকম তাকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক থাকার ভান করলাম। কিন্তু আমি ঠিক নেই এটা আমার হাজবেন্ড বুঝতে পারে। কিন্তু ঠিক কি কারনে সে বুঝতে পারে না। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে আমি ঠিক আছি কিনা। আমার সামান্য বিষয়েও যার এতো খেয়াল অথচ তার কথার দিকে মন থাকতেই চাইছিল না। মন পড়ে রইলো সেই বাউন্ডেও লে মানুষটার প্রতি। যে আমার জীবন টা তছনছ করে দিয়েছে। ভিতরে ভিতরে আমাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছে। এতোদিন পড়েও কেন এতো টান? কিসের জন্য জানিনা। মানুষের জীবনে অনেক অমিমাংসিত বিষয় থাকে যাকে নিয়মের কিংবা কোন যুক্তি দিয়ে শেষ টানা যায় না। আমার হাজবেণ্ডকে বললাম তোমার অফিসে দেরী হয়ে যাবে তুমি বরং চলে যাও আমি ওর পরিক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে বাসায় চলে যাব। আমার বর বলল আজকে না হয় থাক, আমি বরং তোমার সাথে থাকি। আমি তাকে বললাম না না বরং তুমি অফিসে যাও আমি সময় মত চলে যাব বাসায়। আমার বর বলল ঠিক আছে আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি, আমি ড্রাইভার কে বলে যাচ্ছি, সমস্যা হলে সরাসরি অফিস হয়ে এসো।আমি বললাম গাড়ি রাখার দরকার নেই। তোমার কখন দরকার হয়। আরেহ না ড্রাইভার থাকুক বলেই আমার বর চলে গেল। আমি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিকই কিন্তু মনে উকি দিচ্ছিল যাকে দেখলাম তার কথা। এতোদিন পরেও মানুষটা একটুও পরিবির্তন হয়নি। যেমনটা দেখেছিলাম শেষবার। ও কি আমাকে দেখেছে? দেখলেই কি আমি ওর সাথে কথা বলতে চাইনা। যার জন্য জীবনটা এলোমেলো, তার সাথে কথা বলার দরকার নেই। এলোমেলোই বা বলি কি করে। ভিতরে যতখানি এলোমেলো বাইরে তো তার ছিটেফোটাও নেই। সে আমার ব্যর্থতা, আমার জীবনের নয়। আমার জীবন আমার সুন্দর বর, মেয়ে। এক মেয়ের জীবনে এর চাইতে আর কি

লাগে? মেয়ের কথা ভাবতেই মনে হলো এতো ক্ষন তো ওর কথা মনেই ছিল না। সম্ভিত ফিরে পেতেই মেয়েকে নিয়ে পরিক্ষার হলে ঢুকে পড়লাম। মেয়ের পরিক্ষা নিয়ে সকাল পর্যন্ত যে টেনশন করছিলাম তার কিছুই এখন আমার মাথায় নেই। মনে মনে ওকে খুজছিলাম।যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে কি বলব না কিছুই বলব না। একটা খামখেয়ালিপনা মানুষের সাথে কথা বলার রুচিই নেই। শুধু জিজ্ঞাসা করব সেদিন কেন আসেনি। কেন আমার মান সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেললো। বাবার সামনে কাপুরুষের মত হাজির হলো না কেন? আবার ভয় হলো ও যদি দেখা না করে

তাহলে আমি সেদিন থেকে বার বছর যে প্রশ্ন মনের ভিতর বয়ে বেরাচ্ছি তার উত্তর তো আমাকে জানতেই হবে৷ কিছুক্ষন পরেই অভিভাবকদের বের হয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দিলেন। আমি ভাবলাম হয়তো ও ওর বেবিকে নিয়ে পরিক্ষা দিতে নিয়ে এসেছে। আমার মত ও বাইরে চলে যাবে। তখন আমাকে ওর মুখোমুখি হতেই হবে।। আমি বাইরে চলে আসলাম। গাড়িতে বসে গেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম. কিন্তু না অনেকেই বের হয়ে আসলো সে আর আসলো না। বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। সেই ছিলো তো নাকি সব আমার ভুল। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কত খানি জুড়ে থাকলে এমন ভুল হতে পারে। অথচ তার মনের একটুকু খেয়ালেও আমার স্থান ছিল না। তার প্রতিটা বিষয়ে আমার যত খানি নজর থাকতো ততখানিই অবহেলা ছিল আমার প্রতি। তার কবিতা, তার সমস্তও কিছুই আমি ভাল বাসতাম প্রবল নেশার মত। এই যে তার উদাসীনতা সেটাও আমাকে প্রবল ভাবে টানতো। তার উদাসীনতা উপভোগ্ করতাম কারন এই উদাসীন মানুষটা অন্য মেয়েদের পাত্তা দিতো না। আমার প্রতি যে দুর্বলতা ছিল অন্য মেয়েদের প্রতি ছিল না। এটাও বেশ আমাকে আনন্দ দিতো। সময় কাটতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরিক্ষাটা আমার মেয়ে দিচ্ছে না আমিই দিচ্ছি। জীবনে ওর জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি কিন্তু আজকের মত অপেক্ষা করার কষ্ট যেন সব দিনের টাকে ছাপিয়ে গেছে। তখন জানতাম ও আমার ছিল আজ নয় কাল আসবে কিন্তু এখন তো না আমি ওর না ও আমার। সময় কাটে না গাড়ি থেকে বের হয়ে পায় চারী করছি। ড্রাইভার ছেলেটা বলল ম্যাম ম্যাম আপনি ঘেমে যাচ্ছেন এই ঠান্ডার ভিতরেও। আপনি গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসুন। আমি এসি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি বলল্লাম না না লাগবে না। বুঝোয় তো মেয়ের পরিক্ষা কি যে পরিক্ষা দিচ্ছে আল্লাহই জানে। আমার তৎক্ষনাত মনে হলো যাকে আমি দেখলাম সে হয় তাহলে ড্রাইভারের সামনে কিংবা আমার মেয়ের সামনেই বা আমি কিভাবে কথা বলবো। আর কথায় বা বলবো কিভাবে। ওর সাথে কথায় বা বলবো কি। প্রয়োজন তো নেই। এসব কি ভাবছি আমি। এর মাঝেই দেখি বাচ্চা রা বের হচ্ছে পরিক্ষা শেষে। আমিও তাকিয়ে আছি গেটের দিকে। আমার মেয়ে জোরে আমাকে ডাকতে আমি টের পেলাম মেয়ে আমাকে বেশ কয়েকবার ডেকেছে। আমি তরিঘরি করে বললাম কিরে এতো তারাতারি পরিক্ষা শেষ! মেয়ে বললো এতো তারাতারি কিসের সঠিক সময়ে তো বেরিয়েছি। তোমাকে কখন থেকে ডাকছি আর তুমি গেটের দিকেই হা করে তাকিয়ে আছো। আমি বললাম তুই কখন এসেছিস আমি বুঝতেই পারিনি ওথচ আমি তোকেই খুজছিলাম। যাই হোক চলচল তারাতারি কর তোর বাবার অফিস হয়ে বাসায় যাবো। মেয়ে গাড়িতে উঠলো আমিও উঠলাম৷ কিন্তু গাড়িতে উঠেই মনে হলো আমি যেন কিছু ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু কি ফেলে যাচ্ছি জানিনা। গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি স্ট্রাট দিলো। আমি হতভম্ব। আমার মাথায় কিছুই আসছে না। সামিনে অনেক জ্যাম বেধে গেছে। দুয়েক মিনিট এগিয়ে গাড়িটা থেমে গেলো। মিনিট ৫ থাকার পর জ্যাম ছাড়লো। গাড়ি স্টাট দিতেই মেয়ে বললো আম্মু আমি আমার পেন্সিল বক্সটা এক্সাম রুমে রেখে এসেছি। আমি বললাম কি বলছিস। এখন জ্যাম ছেড়ে গাড়ি চললো অমনি তোর মনে হলো তুই পেন্সিল বক্স রেখে এসেছিস। এখন আর আনা লাগবে না। মেয়ে জেদ ধরলো না না আমার আব্বুর কিনে দেয়া পেন্সিল বক্স। এতো সুন্দর বক্স রেখে যেতে বলছ। আমার তাৎক্ষনিক বললাম হ্যা হ্যা পেন্সিল বক্সটা দারুন। ওটা তোর বাবা দিয়েছে আনাটা ভীষন জরুরী। তাই বলে ড্রাইভার কে বললাম গাড়ি থমাও। আমি যেয়ে নিয়ে আসি। ম্যাম গাড়ি কি করে থামাবো। নীল ক্ষেত হয়ে ঘুড়ে আসতে হবে। আমি বললাম না না। ওতো সময় কোথায় কেউ নিয়ে নিবে বক্সটা। গাড়ি থামাও।! জোরে বলাতে ড্রাইভার গাড়ি থামালো। আমি গাড়ি থেকে তড়িঘরি করে নেমে বললাম। তুমি গাড়ি এইখানেই এক সাইড করে রাখ আমি যেয়ে নিয়ে আসি। আমি গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হেটে পরিক্ষার হলের দিকে যাচ্ছি। কেন যেন মনে হচ্ছে সব চেয়ে এখন যোদি আমি দৌড়ায়ে যেতে পারতাম। খেয়াল করলাম শরীরটা অনেক ভারি হয়ে গিয়েছে। আমি আগের মত আর হাটতে পারি না। হাপিয়ে যাচ্ছি। পরিক্ষার হলের গেটে যেয়ে দাড়োয়ান কে জিজ্ঞাসা করলাম সব শিক্ষকরা কি বেড়িয়ে গেছে। দাড়য়ান বলল না ম্যাম। আমি দ্রুত ঢুকতে যেতে দাড়োয়ান বলল ম্যাম এখন তো ঢাকা যাবে না। একটু পড়ে ঢকুন। আমি বললাম আমার মেয়ের দামি পেন্সিল বক্স টা রেখে গিয়েছে। হারিয়ে যেতে পারে। আমাকে ঢুকতে দিন। দাড়োয়ান কিছু বলার আগেই আমি গেটের ভীতর ঢুকে পরিক্ষা কক্ষের দিকে ডুকতে যাবো এমন সময় আমাকে একজন ডেকে বললো আপনি কি এইটা খুজছেন? আমি হন্ত দন্ত হয়ে হাপিয়ে হাপিয়ে বললাম না। মানে হ্যা। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে। আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি যেটা নিতে এসেছি সেটার দিকে আমার নজর নেই৷ আমি যেটা খুজতে এসেছি সেটা আমার সামনে। আমি মনে হয় আনন্দে মরেই যাবো। আমি নিজেকে কোন রকম সামলিয়ে নিয়ে বললাম তুমি। তুমি এখানে। তুমি এখানে কি করছো। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো আমি এখানে পরিক্ষা নেয়ার জন্য এসেছি। আমি একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। তোমার মেয়ের রুমে পরিক্ষার ডিউটি ছিল। বাচ্চারা চলে যেতেই দেখলাম এটা পড়ে আছে। ভাবলাম এটা নিয়ে যাবো। তুমি ওটা নিয়ে যেয়ে কি করবে? আর আমার মেয়েকেই বা চিনলে কি করে। তার আবার নির্বিকার ভঙ্গির উত্তর (যদিও এটাকে খুব ঘৃনা করি আজকাল,আগে ভালো লাগতো)তোমাদের এক সাথে সকালে দেখলাম। তুমি স্বামী সহ মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। আমি যে স্বামী সহ দাড়িয়েছিলাম তুমি বুঝলে কি করে। আমার কথায় একটু জোর ছিল। আরেহ রেগে আছো মনে হচ্ছে। আমার মেজাজটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো। আমি বললাম বল তুমি জানলে কি করে আমি স্বামীসহ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওটা তো অন্য কেউ হতে পারতো। আমি তোমার স্বামীর চেহারা ভুলি কেমন করে বলো। আমার আরো কৌতুহল বেড়ে গেলো আমি বললাম প্লিজ হেয়ালি মার্কা কথা ছাড়ো। আমার স্বামীকে তুমি চিনলে কি করে। ও বলল আমি মনে হয় তোমার চেহারাও ভুলে গেছি কিন্তু যে মানুষটা তোমাকে আমার নিকট থেকে নিয়ে গেলো তাকে ভুলি কি করে। নিয়ে গেলো মানে তুমি কি বোঝাতে চাও তুমিই তো আমাকে নিতে আসোনি। তুমি আমার বাবার সামনে গিয়ে দাড়াও নি। আমি তোমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিতো কি হয়েছে, তোমার বাবা তো আমার সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কি বলছ তুমি নাকি মিথা বলছো। বলো। তোমার বাবাকে আমার কথা বলার পর তোমার বাবা আমার সাথে দেখা করেছিল। দেখা করে কি বলেছিল বলো আমি আস্তে অথচ দৃর ভাবে বললাম।তার আবার অসহ্যকর ভঙ্গির জবাব, তোমার বাবা বললেন আগামী পরশুদিন যেন তোমাদের বাড়িতে যায় আমি শুনে খুশি হয়েছিলাম। ভালো লেগেছিল। তোমার বাবা আমাকে বলতে এসেছে। হয়তো তুমি পাঠিয়েছো। তারপর তিনি বললেন কাল তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসছে। ওই একই সময় যেন আমিও যায়। ছেলেরা কত অবস্থা সম্পন্ন, তার পরিবারের তোমাদের পরিবারের জন্য কত অবদান। ছেলের বিভভিন্ন প্রকারের গুনাগুন সুন্দর করে গুছিয়ে বললেন। আর বললেন আমার মেয়ে তোমার কথা আমাকে বলেছে। আমি এসে তোমাকে নিজ মুখে বলে গেলাম। আর তোমাকে আগে থাকতেই দেখে গেলাম। আমার লেখা পড়া জানা মেয়েটার যথার্থ শিক্ষায় হয়েছে বলে আমাকে ভালো বেসেছেন বলে তোমার প্রশংসাও করে গেছেন। বললেন মেয়ে যাকে পছন্দ করবে তার সাথেই মেয়েকে বিয়ে দেবে। সেটা আমি হই আর সেই ছেলে হওক। তবে তোমার বাবার পছন্দের ছেলে সেটা তিনি তাও জানি দিলেন। আমি বললাম এসব তুমি আমাকে জানাও নি কেন? সে বললো আমি তারপর তোমার ওখানে যাবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তো আমার বরকে কখন দেখলে যে তার চেহারা তুমি ভুলবে না। সে বলল সেদিন সারাদিন আমি ঘুমাতে পারিনি(শুনে ভালো লাগলো), তাই পরের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাদের ওখআনে যাবো। পরেরদিন আমি রওয়ানা দিলাম। পথের মাঝে ৩ রাস্তার মোড়ে ভ্যান থামিয়ে একজনকে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছিলাম। এমন সময় ভ্যানের পেছনে প্রাইভেট কার এসে ভ্যানকে ধাক্কা দিলে আমি ভ্যানওয়ালার এর সাথে ড্রাইভারের দুয়েক কথা হতে ভ্যান থেকে নেমে আমি ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে যেয়ে তোমার স্বামী(যদিও তখন আমি জানিনা) অনেক সুন্দর মানুষ। তার সাথে অমায়িক ব্যবহার। ভ্যানওয়ালার নিকট ক্ষমা চাইলেন। ভ্যানটি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে তিনি নেমে এসে ক্ষমা চেয়ে কিছুটাকা ভ্যানওলাকে দিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে তোমাদের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলো। পাশের লোকটি আমাকে তোমাদের বাড়ির পথ দেখানোর চেয়ে প্রাইভেট কারওয়ালাকে তোমার বাড়ির পথ দেখানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। গাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট দেখেছিলাম। তারপর তোমার স্বামীর গাড়ী(তখন বুঝেছিলাম) গ্রামের মেটো পথ ধরে এগিয়ে গেলো আর উলটো পথে ভ্যান ওয়ালা চললেন গাড়ি সাড়াতে আমার ভাড়ার জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করলো না। ওই লোক্টিও আমাকে একা রেখে তার কাজে চলে গেল। তিন রাস্তার মোড়ে আমি দ্বীধায় পড়ে গেলাম। তোমার বাবার কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিল হয়তো তিনিই সঠিক তাই চেনা পথে আবার ব্যাক করলাম আমার বাড়ির দিকে৷ মিষ্টি রোদে তখন সমস্ত দু:খ ঝেড়ে চলে আসতে ভালোই লাগছিল। তবুও আসতে পারছিলাম কই। একটা সংবাদ শোনার জন্য তোমাদের বাজারের চায়ের দোকানে ১০ টা টোশট, আর ২০ টা চা আর ২০ টা সিগারেট খেয়ে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলাম কাঙখিত খবর টি নিয়ে। নিউজটা এতো দ্রুত আমার কানে পৌছাবে আমার মত বাঊন্ডেলেও ভাবতে পারিনি। তার এতো অপমান কর কথা শুনে কান ভো ভো করছিল। মন বলছিল ওর কানের উপর ঠাস করে চড় দিয়ে যেন সে শব্দে সব কিছু যেন থেমে যায়৷ একটা নিল্ল্রিপ্ত মানুষকে ভালবেসে কিছুটা ধর্য্য ভিতরে আসাতে চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করলাম বিয়ে করেছো। সে বললো বিয়ে করার ইচ্ছা খুব ছিলো না। কিন্তু একটা মেয়েকে বিয়ে করার মত বাজে ইচ্ছে জেগেছিল। তারপর বিয়েটা আর করা হলো না। আমার মাথা ভন ভন করে ঘুরে গেল।আমি কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম তোমার কবিতা লেখা কেমন চলছে। বই টই বের করেছো। ও বললো না। সেদিনের পর থেকে আমি আর একটা শব্দও লিখি নাই। দুজনের মাঝে পিন পতন নিরাবতা। পাশ থেকে একজন কম বয়স্ক শিক্ষক এসে অকে বলল স্যার কাজ শেষ হয়ে গেছে। ও বললো তাহলে আসি৷ আমি ওর হাত থেকে বক্সটি নিয়ে বললাম ঠিক আছে, কোথায় থাকছো এখন? ও বললো ঠিক নেই।বরং তোমার ঠিকানা টা বলো যদি কোনদিন তোমার মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হয় তাহলে দেখা করে আসবো। আমার ঠিকানাটা বললাম। ও শুধু ঘাড় নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। আমার মাথায় কোন কাজ করছে না। আমি কি করবো না করবো বুঝে ওঠার আগেই বাইরে মটর সাইকেলের আওয়াজ পেলাম। হয়তো চলে গেলো। আমিও হাটতে হাটতে এসে বাইরে এসে দেখি গাড়িটা এসে দাড়িয়ে আছে । মেয়েটা রেগে গিয়ে বললো এতো দেরী করলে কেন? আমি শুধু বললাম একটা কিছু খুজতে একটুতো সময় লাগেই। এর পর কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। আমি বিষন্নতায় ভুগছিলাম। আমার বর আমার সেবা যত্নে কখনো ত্রুটি রাখিনি। আমি যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। শ আমিও তাকে দিয়েছি হয়তো কিছুটা কিন্ত ভালবাসাটা দিতে পারিনি। আমার বিষন্ন বিকেল কাটে প্রতিনিয়ত। আর বিবাহ বার্ষিকি আসলে আরো বেড়ে যায়। মানুষটা যদি আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতো তাহলে কি এমন হয়ে যেতো। আমাদের জীবনটা কি সুন্দর হতে পারতো না? এর চেয়ে অবশ্য বড় সুন্দর আর কজন মেয়ের ভাগ্যেই জুটে? কিন্তু আমি কি এমন ভাল ভাগ্য চেয়েছিলাম নাকি আমার ভালো বাসার মানুষটাকে চেয়েছিলাম। আমি জানিনা ও আমাকে যা যা বলেছে মিথ্যা কিনা। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি। করলেও কি ও বলতে পারতাম? কত দিন ভেবেছি ওই স্কুলে যেয়ে খোজ নেব। একদিন সত্যি সত্যই গিয়েছিলাম। কিন্তু ওর খোজ কেউ বলতে পারেনি। ওর খেয়ালি পনা দিয়ে আমাকেও সেদিন ঠকিয়ে গেছে। নয়লে ঠিকানা নিয়ে আর আসলো না কেন? আমার মেয়েকে দেখার জন্যই বা বলার কি ছিল? আমাকে এতো দ্বিধায় ফেলার কি দরকার ছিল। আসলেই বা কি করতাম৷ জীবনে সুন্দর স্বামী সংসার সব পেয়েছি। একটা মেয়ের জীবনে আর কি লাগে? লাগে লাগে মেয়েদের খবরদারী দেখানোর মত একটা অগোছালো মানুষ লাগে। যাকে গুছিয়ে দেবে বকা দেবে আর ভালোবাসবে। কি সব ভাবছি৷ এরকম মানুসিক টানাপোড়ন আর নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতেই এই ২৭ টা বছরের মত বাকি জীবনটাও যাবে। এসব ভাবছি। এর ভিতরে আমার মেয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার শান্তির বড় উৎস আমার মেয়ে। আমার মেয়ে আমাকে বললো মামনি জানো মামনি আজকে না একটা লোককে দেখালাম না না এর আগেও মনে হয় দেখেছি। আমাকে ফলো করছে। আমি ভাবলাম লোকটাকে দুটোকথা শুনিয়ে দিই কিন্তু আজকে আমার আব্বু -আম্মুর বিবাহ বার্ষিকি বলে আমি কিছু বলিনি। এমন শুভ দিনে আমি কাউকে কিছু বলে দিনটা নষ্ট করতে চাইনি। আমিই শুধু মুখেই বললাম নষ্ট না করাই ভালো। মনে মনে বললাম জীবনটা নষ্ট করতে এর চেয়ে আর কি লাগে? কলিং বেল বেজে উঠলো বুঝলাম আমার বর এসেছে। ২৭ বছর ওর বিবাহ বার্ষিকি নিয়েও যার বিন্দু মাত্র আগ্রহ কমেনি। হায়রে ভালো মানুষ, ভালোবাসাটা আর আমার পেলে না।আর যে পেলো, তাকে আমি পেলাম না।