ইতিহাস আমার খুব প্রিয় বিষয়। যখনই সময় পাই নানা মাধ্যমে পড়ি। বৃটিশ ভারতে বিভিন্ন লর্ডদের নিয়ে পড়ছিলাম। মজার একটা বিষয় জানতে পারলাম। আর উপলব্ধি করলাম কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্ব মোড়ল।
ব্রিটিশ ভারতের বহুল আলোচিত আইন বা বিধান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস। ১৭৮৬ সালে বৃটিশ রাজ তাকে নাইট খেতাবে ভূষিত করে গভর্নর জেনারেল এবং সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে ভারতে প্রেরণ করে। তিনি ১৭৯৩ সালে ভারতে প্রবর্তন করেন তার কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী ভূমিব্যবস্থা। এই আইনের ক্ষমতাবলে কোম্পানি সরকারকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে জমিদার ও অন্য ভূস্বামীদের জমির স্থায়ী মালিকানা দেয়া হয়।
তার আরেকটি আলোচিত কাজ ছিলো তৃতীয় মহীশূর যুদ্ধে (১৭৯০-১৭৯২) তিনি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যোদ্ধা ও মহিশুরের শাসক টিপু সুলতানকে পরাজিত ও হত্যা করেন। টিপু সুলতানের মরদেহ সনাক্ত হওয়ার পর তার সেনাপতি জর্জ হ্যারিসের বিখ্যাত উক্তিটি ছিলো "Now India is Ours"-যা ইতিহাসে আজও অম্লান হয়ে আছে।
মজার বিষয় হল ১৭৮১ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এই লর্ড কর্ণওয়ালিস বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনাতে Battle of York Town যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন Continental Army ও ফরাসী যৌথবাহিনীর হাতে চরমভাবে পর্যুদস্ত হন। Continental Army ছিলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর মত। এই যুদ্ধে আনুমানিক ২৭,০০০ বৃটিশ সেনা নিহত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ১৭৮৩ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩) চলাকালে লর্ড কর্ণওয়ালিস উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
চলুন তাহলে জেনে নেই জর্জ ওয়াশিংটনের Continental Army কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো। পঞ্চদশ শতক থেকে স্প্যানিশ আর পর্তুগীজদের নিয়ন্ত্রণে থাকা উত্তর আমেরিকার ভূমিতে বৃটেন ১৬০৭ সালে সর্ব প্রথম জেমসটাউনে কলোনি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকেরা তখন তাদের কাছে নতুন বিশ্ব বলে পরিচিত আমেরিকায় অভিবাসী হতে শুরু করে। মূলত আজকের দিনে আমরা যাদের মার্কিন বা আমেরিকান বলে থাকি তাদের একটা বড় অংশই ব্রিটেন থেকে স্থানান্তরিত।
নতুন আগত বৃটিশদের সাথে আগে থেকেই সেখানে ইউরোপ থেকে যাওয়া স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং আফ্রিকা থেকে বৃটিশ রাজের আনা কালো দাসদের সংযোগে একটা স্বতন্ত্র আমেরিকান সমাজ সৃষ্টি হয় সেখানে। তারা নিজেদের আমেরিকান পরিচয় দিতে বেশি গর্ববোধ করতো।
বৃটিশ শাসনে থাকলেও এই আমেরিকানরা তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বায়ত্বশাসন ভোগ করত। ইংরেজরা এদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কারণে আমেরিকানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এছাড়া ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার দূরত্ব আমেরিকান সমাজকে বৃটেন থেকে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
যেই লর্ড কর্ণওয়ালিস উত্তর আমেরিকায় চরমভাবে পর্যদুস্ত হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান, সেই ব্যাক্তির চাতুর্যের কাছেই ভারতের তাবৎ রাজা বাদশাহ নাস্তানাবুদ হয়ে ২০০ বছরের গোলাম হয়ে যায় বৃটিশ রাজের! কিছু ভাগ্যান্বেষী ইউরোপীয়দের মাধ্যমে গঠিত একটা মিলিশিয়া যেখানে কর্ণওয়ালিসের তৎকালীন বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী বৃটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে, সেখানে ভারতের নামকরা রাজা বাদশাহরা বিশাল বাহিনী নিয়েও কর্ণওয়ালিসের যুদ্ধ কৌশলের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। এখানেই আমেরিকানদের সাথে অন্যদের পার্থক্য। তারা সবসময়ই সেরের উপর সোয়া সের।
১৭৩৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি লন্ডনের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেন ইটন কলেজ ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৭৫৭ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৭৭৫ সালে তিনি মেজর জেনারেলের পদে পদোন্নতি পান। সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে ১৮০৫ সালের ৫ অক্টোবর দেশে প্রত্যাবর্তনের পথে ভারতের গাজীপুরে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।