বিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক শাখা হলাে রসায়নশাস্ত্র। প্রাচীনকালে মিশরের বিজ্ঞানীরা "আল-কেমি" বা রসায়নাগারে রসায়ন চর্চা করত। আরবি শব্দ আল-কেমি থেকেই ক্যামিস্ট্রি শব্দটি এসেছে। রসায়নে সাংকেতিক চিহ্ন প্রথম ব্যবহার করেন পারস্যের বিজ্ঞানীরা। এদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, জুননুন মিসরি ও ইবনে আবদুল মালিক আল-কাসি প্রমুখের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৪ খ্রি.) সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমান রসায়ন বিজ্ঞানের সাতন্ত্র জাবির ইবনে হাইয়ানের হাত ধরে। রসায়নবিদ্যার বিভিন্ন মৌলিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে জাবির ইবনে হাইয়ান সর্বপ্রথম রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। একারণে তাকে আল কেমি বা রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয়।
জাবির ইবনে হাইয়ান ইরাকের কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। তিনি এমন সব বস্তুর সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেন যেগুলোকে তাপ দিলে বাষ্পে পরিণত হয়। এর মধ্যে আছে কর্পূর, আর্সেনিক ও এমোনিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান দুটি সূত্র ভস্মীকরণ (Calcination) ও লঘুকরণ (Reduction) এর বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা করেন। তরল পদার্থকে বাষ্পে পরিণত করার এবং বাষ্পকে তরল পদার্থে পরিণত করার পদ্ধতি তার জানা ছিল। জাবির ইবনে হাইয়ান পাতন, উর্ধ্বপাতন, পরিস্রবণ, দ্রবণ, গলন প্রভৃতি রাসায়নিক পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতিসাধন করেন। Oxidation বা ধাতুর সাথে অম্লজান মিশ্রণ এবং হিসাব নিরুপণের রাসায়নিক পদ্ধতি তার হাতেই পূর্ণতা পায়। তিনি দেখান কিছু মিশ্র ও যৌগিক পদার্থ আছে যেগুলোকে অনায়েসে চূর্নে পরিনত করা যায়। নির্ভেজাল বস্তুর পর্যায়ে তিনি সোনা, রূপা, তামা, লোহা, দস্তা প্রভৃতি তুলে ধরেন।
জাবির ইবনে হাইয়ানই সর্ব প্রথম নাইট্রিক এসিড আবিষ্কার করেন। সালফিউরিক এসিডও তাঁর আবিষ্কার। তিনি ‘কিতাবুল ইসতিতমাস’ এ নাইট্রিক এসিড প্রস্তুত করার ফর্মুলা বর্ণনা করেন। নাইট্রিক এসিডে স্বর্ণ গলে না। নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মিশ্রনে স্বর্ণ গলানোর ফরমুলা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থে তিনি পাতন, উর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, গলন, ভস্মীকরণ, বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক সংশ্লেষণ বা অনুশীলন গবেষণার কি কি রূপান্তর হয় এবং তাঁর ফল কি তিনি তা বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি চামড়া ও কাপড়ে রঙ করার প্রণালী, ইস্পাত প্রস্তুত করার পদ্ধতি, লোহা, ওয়াটার প্রুফ কাপড়ে বার্নিশ করার উপায়, সোনার জলে পুস্তকে নাম লেখার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মিশ্রনে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম যে ”একোয়া রিজিয়া ” সেটিও জাবির ইবনে হাইয়ান প্রদত্ত।
জাবির ইবনে হাইয়ান বস্তু জগতকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ। তাঁর এ আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বস্তুজগৎকে যথা বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদার্থ বহির্ভূত এই তিনটি ভাগে ভাগ করেন।
জাবির ইবনে হাইয়ান ৭২২ সালে তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম হচ্ছে আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে আব্দুল্লাহ আল আজাদী, আত তুসি, আস সুফি, আল ওমাবি। তবে তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেই অধিক পরিচিত। তার পূর্বপুরুষরা আরবের দক্ষিণ অংশে বসবাস করতেন। তার বাবা ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে তিনি 'জিবার (Geber)' নামে পরিচিত।