পোস্টস

গল্প

বোমারু বিমানও যথেষ্ট নয়

২৪ নভেম্বর ২০২৪

Amir Hamza

বোমারু বিমানও যথেষ্ট নয়


 

কানের পাশ দিয়ে ‘ভোঁ’ করে শব্দ করে উড়ে গেলো একটা ‘মেসারশমিট Bf 109’ উড়ে গেলো। আমি ভেতর থেকে কেঁপে উঠলাম। আমার হাতে ধরে রাখা পিপিএসএইচ-41, বন্দুকটা এমনভাবে আমি ধরে আছি এইটা বোধহয় আমার শরীরের একটা অংশ। ছোট বেলায় উদোর থেকে বেরিয়েই এই বন্দুক আমার হাতের অংশ ছিল। আমি এই বন্দুক নিয়েই অন্ধকার থেকে বেড়িয়েছি। বর্তমানে এই বন্দুকে আমার আত্মা ভরে রাখা রাজার আত্মা তোতাপাখির মধ্যের মতন। এই বন্দুকই আমাকে এখন চালাচ্ছে। সামনে ধূধূ প্রান্তর। এখন কয়েক মিনিট যাবৎ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আরো কতক্ষণ থাকবো জানিনা। এমুনিশন  সাপ্লাই আসছে। আমাকে পিচের ক্রেডিটকে সেই সাপ্লাই বহন করে পথ দেখিয়ে জঙ্গলের ফ্রন্টে নিয়ে যেতে হবে।


 

কিছুক্ষণ আগে যে বিমানটা উড়ে গেলো সেইটা শত্রুপক্ষের কিনা মিত্রপক্ষের জানিনা! জানা যায়নি, আমি শুধু জানি বিমানটা বেশি সুবিধা করতে পারবে না। কেননা যুদ্ধ হচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে। এইজন্যেই বিমানের কোনো কাজ নেই। সে শুধুই উড়ছে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে নিলাম। ভেজা জিহ্বা, এতটা ভেজা যে এই দিয়ে অনায়াসে ব্রিটিশ হ্যাজাক বাতির সলতে বানানো যাবে। অনেকক্ষণ ধরে খাবার পানি সহ কিচ্ছু পেটে পড়েনি। সাপ্লাই নেই।


 

একটু পরপরেই গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে, প্রতি দমকে আমি আমার বন্দুকের গ্রিপ আরো আঁটোসাঁটো করে নিচ্ছি। পারলে ঝালাই করে হাতের সঙ্গে একেবারে লাগিয়ে নেই। আমার চোখ বোধ করি কঠোর থেকে ফুটে বেরিয়ে আসবে। কপালের শিরা খানিক দপদপ করে শক্তি না পাওয়ায় নিজের উদ্যোগেই থেমে গেছে। বন্দুকে লোড করা এক রাউন্ড ম্যাগাজিন, আর প্যান্টের হাঁটুর কাছের পকেটে এক রাউন্ড, এই আমার ইহজাগতিক সম্বল। এই দিয়েই আমার সবটা টিকিয়ে রাখতে হবে, যা দিয়ে অস্তিত্ব টিকে থাকে সেইটাই সম্বল। বন্দুকটা বুকের যতটা কাছে চেপে রাখা যায় রেখেছি। এমনি ঢোক গিললাম, তিতা লালার স্বাদ গলা পেট পর্যন্ত চলে গেলো। অনেকদিন আগের ঘুম থেকে উঠে প্রথম ঢোক গেলার স্মৃতি। এখন স্মৃতির পুরাটা জুড়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বন্দুক আর দুই রাউন্ড ম্যাগাজিন। সাপ্লাই আসছে, আমি দাঁড়িয়ে মতিগতি দেখছি।


 

আবার গোলাগুলির শব্দ, স্থায়িত্ব অনেকক্ষণ। কারা মরলো কারা মারলো জানিনা। শুধু জানি কেউ না কেউ মরলো হয়ত। কারুর মরার শোক নেই এখন। এখন শুধু কিছু শব্দ যা শুনলে বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। খানিক আগে পকেট ওয়াচের উল্টা পৃষ্ঠে নিজের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো চোখ আমার কঠোর থেকে বেরিয়েই এসেছে। শুধু একটা দুইটা শিরা দ্বারা লেগে আছে। কানের মধ্যে বন্দুকের শব্দের অনুপস্থিতে কান হাঁসফাঁস  করছে। কান অভ্যস্ত  হয়ে গেছে গোলাগুলিতে। জঙ্গলের মধ্যে থেকে আকাশের উপরের দিকে ধোয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। বিকেল, সূর্য টোলে পড়ছে একদিকে, কোনো মাথায় গুলি লাগা সৈনিকের মতন।


 

খানিক আগে ক্ষুধায় হাতপা কাঁপছিলো, আমি মাটির উপরের কিছু ঘাস ছিড়ে কুরে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে পেটকে বুঝ দিলাম হয়েছে ক্ষুধা নিবারণ। কিছুক্ষণ পরেই তোর জন্যে গুলি আছে। ঘাসের স্বাদ কী ছিল? জানি না, আন্দাজ করা যায় যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন সব কিছুর স্বাদ যুদ্ধ। ট্রেনে বসে আরাম  আয়েশে যে-সব কর্নেল মেজর মৃত্যু আয়োজনের ছক কষতে কষতে মাখন পাউরুটি, কমলার রস, হালকা আচে অর্ধসিদ্ধ ডিম আর নানান পদের খাবার গিলে তাদের জিহ্বাতেও সব কিছুর স্বাদ যুদ্ধ। আবার এক রাউন্ড গোলাগুলি হয়ে গেলো। দূরে জঙ্গলের মধ্যে পাখির নেউল খরগোশ হরিণ শিয়াল বনমোরগের বিচরণ ক্ষেত্রে এখন ক্ষণে ক্ষণে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলছে। আমার খালি ক্ষণে ক্ষণে সাপ্লাইয়ের কথা মনে হচ্ছে। ওদের এসে পরার কথা, কি দীর্ঘ অপেক্ষা। মনে আবার খানিক ঘাস খাবার ইচ্ছে জাগছে। আমি ঘাস খাবো, আমি ঘাস খাবো জন্যেই কিছুলোক প্লেনে বসে ট্রেনে বসে নদীর পাশে নিরিবিলি একটা গাছের পাশে বসে এমন খাবার খাবে যা হয়ত আমারই বন্দুকের বেঁচে যাওয়া কিছু রাউন্ড গুলি আর বন্দুকটা নিলামে উঠিয়ে বিক্রি করে কেনা রসদে উৎপন্ন।

বন্দুকটা আরো শক্ত করে আঁটসাঁট চেপে ধরলাম, চাপ দিয়ে  বন্দুকের ইস্পাতের কাঠামো বাঁকিয়ে ফেলার চেষ্টায় আছি বোধহয়। চোখ বুজলাম, চোখ বুজতেই চোখ জ্বালা করে উঠলো। তীব্র কোনো আলো হঠাৎ চোখে ফেলা হয়েছে বলে মনে হলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালাম। সামনে সেই একই দৃশ্য, নাহ আমি দৃশ্য বদলে যাবে এই ইচ্ছায় চোখ বন্ধ করিনি। আমি চোখ বন্ধ করিনি চোখ খুললেই চোখের সামনে একটা সাধারণ কেবল কিছু আটার মুণ্ড আঁচ দিয়ে বানানো কোনো রুটি সামনে পাবো বলে। কিংবা চোখ খুললেই শুনবো হুইসেল যুদ্ধ শেষ, দূর থেকে কেউ বোমের ঠেলায় নিজের এক উড়ে যাওয়া হাতের অবশিষ্ট অংশ হাতে কুড়িয়ে দৌড়ে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসছে। কিংবা আরো হাজার রকমের কল্পনা জেহালা শুধুই দৃশ্য কল্প। আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম কোনো প্লেনের জন্যে যে আমার অজান্তে নিঃশব্দে আমার উপরে বোমা ফেলবে। আমি তো বোমার যোগ্য, আমার হাতে ধরে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র এইটাই তো বোমা ফেলানোর নিশানা। আমি তাকাতেই সেই একঘেয়ে মাঠ সেই জঙ্গল যেখানে খানিক বাদে অন্ধকার ঘনীভূত হবে। গুলিও ফুরিয়ে আসছে আমাদের ক্রেডিটের। যেভাবে গোলাগুলি চলছে তাতে এই আন্দাজ করা যায়।


 

বুক পকেট থেকে আবার ঘড়ি তা বের করে দেখলাম ৫:৩০। বলা হয়েছে ৫:২০ এর মধ্যে সাপ্লাই ক্রেডিটের চলে আসার কথা। ওরা এর মধ্যে না আসলে ধরে নিতে ট্রেনে হামলা হয়েছে। আর আমাকে অপেক্ষা না করতে। একটা ম্যান পাওয়ারও খরচ না করতে। আমি আরো খানিক অপেক্ষা করবো ভাবলাম। এইটা সাপ্লাইয়ের না, নিজের মৃত্যুকে যতটা দীর্ঘায়িত করা যায় ততটাই ভালো। হয়ত এইটুকু সময় আমি শুধুই বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকবো, কয়েকঘণ্টা যাত্রী না পেয়ে বৈঠা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝি যেমন। নাহ, সাপ্লাই আসলো না।


 

আমি জানি আমার জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ, তবুও একটু না থেকেও থাকার আশায় পাওয়ার আশায় ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। হলো না, তবে জিহ্বার সাথে ঠোঁটের উপরের মরা চামড়া উঠে মুখের মধ্যে চলে গেলো, দুইবার থুথু করে ফেলেও পড়লো না। পরে অনুভব করলাম মুখের মধ্যেই আছে। আমি গিলে খেলাম ঠোঁটের মরা চামড়া। চামড়া উঠে ঠোঁট এখন জ্বলছে। ছিলে যাওয়া শরীরের অংশে বাতাস লাগলে যেমন হয় তেমনি ভাব ঠোঁটে। রক্ত বেরুচ্ছে কিনা আঙুল দিয়ে দেখলাম না। দেখতে ইচ্ছে করছে না, এই কয়েক মাস যতটা রক্ত দেখেছি, বন্দুকের নোলায় যত রক্ত লেগে আছে সমস্ত পৃথিবীর পানি দিয়েও সেইটা ধোঁয়া সম্ভব না। রক্ত হয়ত ধুয়ে যাবে। হয়ত না, রক্ত ধুয়েই যাবে মস্তিষ্কের মধ্যে যে রক্তের স্মৃতি আছে সেইটা তো উঠবে না। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডেও না, স্মৃতিভ্রম হলেও না। আমার ডিএনএতে পারমানেন্ট কোডিং হয়ে গেছে রক্তের বন্যা।


 

কিছুক্ষণ আগে ঘাস চিবানোর সময় কান্নার মতন দমক শুরু হয়েছিল বুকের মধ্যে। বহু আগের ধসে পড়া ভবনের কোনো একটা কিছুটা অক্ষত ঘর, যে ঘর ধ্বংসস্তূপের নিচে একেবারে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।  প্রত্নতাত্ত্বিকের যন্ত্রের ছোঁয়ায় ফাঁক পেয়ে সেই ঘরকে পূর্ণ করতে চাওয়া বাতাসের দমকের মতন কান্না। টের পাচ্ছিলাম শরীর কেঁপে কেঁপে উঠা তখন কান্নায় কেঁপে ওঠায় রূপান্তরিত হচ্ছিলো। পাশে ঘাসের উপরে আমার পিপিএসএইচ-41 ওর দিকে তাকিয়ে মৃত শিশুর মতন মনে হচ্ছিলো। আমার যে শিশু জন্মের পরে মারা গিয়েছিল, কলঙ্ক হিসেবে আমি তাকে এখনো বহন করে চলেছি। সেই শিশুকে পাশে শুইয়ে রেখে আমি হাঁটু গেড়ে বসে ঘাসের দিকে তাকিয়ে প্রায় কান্না করে ফেলতাম। কান্না করতাম সেইসব মুহূর্তের জন্যে যেগুলো আমাকে এই পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। দাড় করিয়েছে এই মহাশূন্যের মতন প্রান্তরের সামনে, দাঁড় করিয়েছে প্রান্তর পেরিয়ে দিগন্তের দিকের বন জঙ্গলের মাঝে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মানুষ মারার কাঁচামাল সাপ্লাই নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে। দাঁড় করিয়েছে সেই সব মুহূর্তের বিরুদ্ধে যার জন্যে আমি এককালে বেঁচে ছিলাম। কত কণ্ঠ কানে ভেসে আসে, কিছু হাসির সুর। মাতাল করার মতন কোনো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, কত নিদারুণ কষ্ট। যেই কষ্টগুলো পাওয়ার জন্যেও এখন বুক হাহা করছে। সেই কষ্টও এর থেকে ভালো,ভালো না হলেও সেগুলো ছিল কষ্ট, যুদ্ধ না। কিছু পরিচিত মুখের অবয়ব। যে মুখ গুলার দিকে তাকিয়ে আমি কখনোই এই বিভীষিকার সামনে দাঁড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। আমার সেই সকল মুহূর্ত গুলো, এমনকি সেই সকল স্মৃতি গুলাও এখন শুধুই স্মৃতি, ছোটবেলায় শোনা অচেনা পাখির ডাকের মতন কোনো স্মৃতি।


 

সাপ্লাই আসবে হাটুগেড়ে বসে থাকা ঠিক এই সবুজ ঘাসের মতন খুদা নিবারক কিছু ফোলা রুটি, সম্ভব হলে মিষ্টি কিছু পানীয়। তখনও মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিলো ক্ষীণ সন্দেহ যুক্ত আশার আলো। ডাবল থিঙ্কিংয়ের মতন হয়ত সাপ্লাই আসবে হয়ত আসবে না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আসবে না, আসবেনা আমি জানতাম। অথচ আমি জানতাম আমি আসবে না এইটা বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না। আমি বিশ্বাস করতে  চাচ্ছি না আরেকটা না খেয়ে বন্দুকের ট্রিগার চাপার বাস্তবতা। তবে তাই হলো আমি ঘাস খেলাম কিছু। সাপ্লাই একেবারে শেষ মুহূর্তেও আসলো না, মনকে শান্ত করলাম। 


 

কিছুক্ষণ আগে যেভাবে উবু হয়ে বসে কিছু ঘাস উপরে নিয়েছিলাম। কিছু ঘাস গলাদ্ধকরণ করেছিলাম যেভাবে মারা যাওয়ার আগে বুক ঝাঁঝরা করে নিয়ে সৈনিক গুলি খায়। এইবার ঘাস মুখে পুরলাম না। লেগ পকেটে যতটুকু পারা যায় ঠুসে নিলাম। আমার পকেটে এখন ইকোসিস্টেম, ঘাস। সেই ঘাসে মাইক্রো লেভেলের অণুজীব। যাদের জন্ম মৃত্যু সময়ের প্রায় শূন্যের কোঠায় নিবদ্ধ, তাদেরকে নিয়ে আমার পকেটের মধ্যে ইকোসিস্টেম। আমাকে বলে দেওয়া হুকুম অনুসরণ করে সাপ্লাই না আসার দরুন আমি একই বন্দুকটা হাতে জড়িয়ে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরলাম। সহযোদ্ধাদের বলতে বসে আমি কিচ্ছু পাইনি, তাদের হতাশ নয়নের দিকে আমার তাকাতে হবে। তাদের নিঃশব্দ আত্মচিৎকার আমার কানে অগ্রিম বাজছে। আমি বন্দুকের ইস্পাত বাঁকা করতে চাওয়ার আক্রোশে সেইটা আঁকড়ে ধরে প্রান্তরের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। মাথার উপরে কোথাও বোমারু বিমান নেই, ক্ষুধার্ত সৈনিকের জন্যে বোমারু বিমানও যথেষ্ট নয়।