“এই, আমি গেলাম”, ফারজানার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল আরিফ। কাত হয়ে ঘুমুচ্ছিল ফারজানা, একটু নড়েচড়ে কাদা হয়ে ঘুমুতে থাকা মেয়েটাকে বুকের কাছে এনে ঘুম জড়ানো গলায় বলে, “এই সাতসকালে কই বের হচ্ছ তুমি?” “সাতসকাল আর নাই! এখন সাড়ে সাত সকাল! খুব মেঘ করছে, তাই টের পাচ্ছ না”, কৌতুকের সুরে জবাব দেয় আরিফ। “তবে তো এখুনি বৃষ্টি নামবে। এখুনি বের হওয়া লাগবে তোমার?” চোখ না খুলেই ফারজানার জেরা চলতে থাকে। “ছাতা নিসি তো! বৃষ্টি শুরুর আগেই চলে যাবো। টেনশন করো না।” “তোমার যদি প্রতিদিন এমন সকালেই বের হওয়া লাগে, তবে একটা কাক বিয়ে করে সংসার করতা! ঘুম থেকে উঠেই কার্নিশে আরাম করে বসে দুইজন সুন্দর কা কা করে মানুষের ঘুম ভাঙ্গাতা!” ফারজানার গলায় কপট রাগ। “তাই তো করতেসি!” হেসে জবাব দেয় আরিফ, এরপর ঘুমন্ত মেয়ের নরম গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে ফারজানার কপালে চুমু খায়। “উফ!” শব্দে বিরক্তি জানায় ফারজানা। এখনো অনেকটা সকাল, মানুষের সাড়াশব্দ খুব একটা জোরালো হয়নি। হয়তো এ বাড়ির মানুষজন বৃষ্টির সকালে বিছানার ওম এখনো ছাড়তে পারছে না। তাই খুব সাবধানে দরজা খুলে পা টিপে সিঁড়িঘর পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পরে সে। বৃষ্টি হচ্ছে না, যদিও আকাশ কালো করে মেঘ করে আছে। সারারাতের বৃষ্টিতে রাস্তার গাছগুলোর পাতা ধুয়ে রং ফিরে এসেছে। একটা মিষ্টি নরম বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আরিফ মনে মনে ভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে এমন সকালের স্বাদ নিতে হয়, মগজের অলিগলিতে এ বাতাস ছুঁয়ে জঞ্জাল দুর করতে হয়।
আজকাল সকাল সকালই অফিসে বের হয় আরিফ। পায়ে হেঁটে অফিস বাসা থেকে ঠিক আধঘণ্টা দুর। না, স্বাস্থ্য বিষয়ক কোন জটিলতায় সে এখনো পড়েনি, বরং চল্লিশ পেরিয়ে সে না-বুড়ো না-যুবক ধরণের একটা আত্নপরিচয়মূলক জটিলতায় আটকে আছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে যে সে খুব মাথা ঘামায়, তেমনও না। বরং এই জটিলতার সাথে সে ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। এখন সে বুড়োদের সাথে বুড়োদের মত করে গল্প করে, পিঁয়াজ-মরিচের দাম বেড়েছে বলে রাগ দেখায়, সস্তায় কোথায় জমি পাওয়া যাবে তা নিয়ে পরামর্শ করে এবং গেছে দিন ভালো গেছে বলে সবার সাথে হাপিত্যেসের কোরাস গায়। আবার অফিসের ফাঁকে ও ওর অল্প বয়সী সহকর্মীদের সাথেই আড্ডা জমায় – কখনো ক্রিকেট, কখনো গান বা সিনেমা ……। বন্ধুর মতোই ভাগ করে সিগারেট খায়, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে খিস্তি করে আর কি করলে কার প্রেম হবে, কখন কিভাবে কার প্রেম ভাঙবে এসবের নিদান হাঁকে।
তার এই গড়পড়তা জীবনে প্রতিদিন সকাল সকাল অফিস যাবার পেছনে অন্য একটা রহস্য আছে। আরিফ অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছে প্রতিদিনের অফিস, বাসা, আড্ডা, ঘিঞ্জি বাজারের হৈচৈ, সকাল-সন্ধ্যার রাস্তাঘাট, ট্রাফিক জ্যাম, সব কিছুর ভিড়ে কোথায় কি যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে। কি যেন একটা ক্ষয় রোগীর মতো একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। আরিফ সেই কি যেন একটার খোঁজে প্রতিদিন সকালে রাস্তায় নামে, ঘুম জড়ানো মানুষদের শ্যাওলার মতো ভাসা ভাসা মুখে সেই কি যেন একটার খোঁজ করে আর যে কোন লৌকিক দৃশ্যে অলৌকিক রঙ মাখিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে জানতে চায় তার কল্পনার ঘোড়া এখনো কতদূর দৌড়োয়! একে অর্থহীন ভাবালুতা বলা যেতে পারে। আরিফের তাতে কিছু যায় আসে না। একে যদি অকারন স্মৃতিতর্পণও বলা হয় তাতেও তার আপত্তি নেই, কারণ তার এই নিজস্ব জগতে সারাক্ষণ সেই কিছু একটা খুঁজে ফেরার রহস্য এখনো কেউ জানে না। সে কাউকে জানাতেও চায় না, যদিও সে খুব ভালো করেই জানে যে সে একা নয়। আবোলতাবোল মানুষের ঠাঁই এখনো এ শহরে আছে, যারা চাইলেই একটা কোন পুরনো গানের একটুখানি ভাঙ্গা সুর মাথার ভিতর ঠিকানার মতো গুঁজে নিয়ে ঘুরে আসতে পারে অনেক দিনের ফেলে আসা কোন পৃথিবীতে, অথবা তৈরি করে নিতে পারে আরও অনেক সমান্তরাল পৃথিবী। সেখানে সবচেয়ে পরিচিত মুখটিও অচেনা লোকের মতো পাশকাটিয়ে চলে যায়। কেউ কাউকে ডেকে কুশল প্রশ্নও করে না, করার নিয়মও হয়তো নেই।
আরিফ মতিঝিলের বেশ বড়সড় একটা কনসালটেন্সি ফার্মে কাজ করে। ছাত্র হিসেবে খুব একটা কেউকেটা গোছের না হলেও, এই চাকরিটা পেতে তার তেমন কষ্ট করতে হয়নি। তার শিক্ষকেরা তাকে নিয়ে এক সময় ভালোই স্বপ্নটপ্ন দেখতেন। আরিফ অবশ্য অতটা দেখেনি। দেশে পড়ালেখা শেষ করে কেমন করে যেন সে একটা স্কলারশিপ পেয়ে যায়। ইকোনমিক্সে একটা মাস্টার্স করবে বলে সে সমুদ্র পাড়ের শহর হ্যালিফ্যাক্সে পাড়ি জমায়। কে জানে, হ্যালিফ্যাক্সই হয়তো তাকে ভাবালুতা উদযাপন করতে শিখিয়েছে! এক একটা জায়গার এক একটা প্রাণ থাকে। হাঁটতে চলতে সে প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া যায় না। কিন্তু খুব গভীর করে তাকালে তার ভাসা ভাসা মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিছু দিন থেকেই আরিফ টের পেয়েছিল হ্যালিফ্যাক্স ধীরেসুস্থে বাঁচে, ধীরেসুস্থে কথা বলে, রাত নিশুতি হলে ধীরেসুস্থে ঘুমিয়ে পরে, আর ঘুমিয়ে পরার আগেই ধীরেসুস্থে দিনের সব কাজ শেষ করে নেয়। যতটুকু শেষ করতে পারে না, ততটুকু ধীরেসুস্থে করবে বলে পরের দিনের জন্য ফেলে রাখে। আহা হ্যালিফ্যাক্স…! সে ছিল আজকের সকালের মতোই অলস।
পড়ালেখা শেষ করে আরিফ হ্যালিফ্যাক্সে থেকে গেলে পারত। কিন্তু থাকেনি। দেশে থাকতেই ফারজানার সাথে আরিফের প্রেম হয়। এখন সেই প্রেম সুখের মতো ব্যাথা হয়ে আরিফের জীবনটাকে জড়িয়ে ধরেছে। যে ছন্নছাড়া জীবনের স্বাদ সে একদিন পেয়েছিল, তা এখন পাখির পালকের মতো উড়তে উড়তে কোথায় যে হারিয়ে গেছে! এখন বরং তার মেয়েটাই মেঘের স্বাদ নেবে বলে পাখি হতে চায়। মেঘের কি স্বাদ তা তার মেয়ে একদিন ঠিক জেনে যাবে, আর আরিফের জীবন এখানেই থেমে যাবে। আফসোস হয়? নাহ্! জীবন নিয়ে আরিফের মনে কোন আক্ষেপ নেই। বরং বিবাহিত জীবনের মধু তার সবটাই জানা হয়ে গেছে। তবুও কি হ্যালিফ্যাক্সের জীবনের সব আকাঙ্খারা মরে গেছে? হ্যালিফ্যাক্স এখন অতীত। অতীত যাপন করা যায় না, তাই অতীতও ভবিষ্যতের মতোই একধরণের কল্পনা। সে রাস্তার ঘোলাটে পানিতে আবছা নীল রং মেশায়, মুহূর্তেই রাস্তাটা হ্যালিফ্যাক্সের বন্দরে বদলে যায় আর গলির মুখের উঠানওয়ালা বাড়িটা হয়ে যায় একটা নির্জন বাতিঘর।
বড় রাস্তার মোড়ে ফুটপাতের ঝুপড়ি ঘরে একটা মাঝ বয়সী নারী চায়ের পানিতে জ্বাল ধরিয়েছে, এরিমধ্যে চায়ের আশায় কয়েকটা লোকও জুটে গিয়েছে। আরিফের কল্পনার ঘোড়া তখনো হ্যালিফ্যাক্সের অলিগলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে। একদিন সে হ্যালিফ্যাক্সের এক ব্যাস্ত রেস্তোরাঁয় এই মাঝ বয়সী মহিলাটির মতোই এক বৃদ্ধাকে খুঁজে পেয়েছিল, যার ছেলে কোকুন কাটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেছে। সে বৃদ্ধা হয়তো এখনো তার ঘরের দুয়ার খোলা রেখে কাজে বের হয়, চুলায় দিনের প্রথম আগুন ধরায়, ধোঁয়া ওঠা কফির তিতকুটে ঘ্রাণের লোভে আসা অফিসগামী মানুষদের ব্যাস্ত মুখগুলোতে পরম আদরে চোখ বুলায়, আর অপেক্ষায় থাকে একদিন ঘরে ফিরে দেখবে তার প্রজাপতি ছেলেটি বাড়ি ফিরেছে। সেদিন সে তার ছেলের কাছে অপেক্ষার কৈফিয়ত চাইবে না, বরং পুরনো দিনের মতোই নিঃশব্দে ক্লান্ত হাতে ডিম রুটি দিয়ে স্যান্ডউইচ বানাবে, এরপর ছেলের খাবার টেবিলে রেখে নিজের ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিবে। আরিফ নিশ্চিত জানে, সেদিনের সেই সন্ধ্যেরাতে সে বৃদ্ধা নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ক্লান্ত হবে, এরপর হারিয়ে যাবে এক অলৌকিক ঘুমের দেশে। আচ্ছা, এই চা দোকানের মহিলাটিরও কি তেমন কারো জন্য অপেক্ষা আছে? থাকারই তো কথা! নইলে প্রতিদিন চায়ের পানিতে জ্বাল ধরাবে কেন সে! আরিফ ভাবতে ভাবতে মুখ টিপে একটু হাসে, এরপর সাবধানে কাদাপানি এড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অফিসের রাস্তায়।
একটু এগিয়ে ডানদিকে মোড় ঘুরে বড় রাস্তায় নেমে আসে সে। এরপর ফুটপাত ধরে এগোতে থাকে। আর কিছু দুর হাঁটলেই ফজলু মিয়ার খাবারের দোকান। এখানেই আরিফ প্রায়দিনই সকালের নাশতা সারে, না সেরে উপায় নেই। দোকানের সামনে দিয়ে গেলে ফজলু মিয়ার চোখে সে পরবেই, নাশতা না করিয়ে রাস্তা পার হতে দিবে না। এই সাত সকালেই ফজলু মিয়া দোকান খুলে গদিতে বসে হিসাবের খাতায় কি যেন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তার কর্মচারীদের একজন স্টোভে আগুন ধরিয়ে রুটির ভারী তাওয়া চাপিয়ে দিয়েছে, একদিকে চায়ের পানি ফুটছে। মেঘলা বাতাসে স্টোভের ধোঁয়া বেশিদূর এগুতে পারছে না। ধোঁয়ার পর্দা ভেদ করে আরিফ দোকানে ঢুকে পরে। খাতা থেকে মুখ তুলে ফজলু মিয়া আরিফের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসে এরপর বলে “এই বৃষ্টির মইধ্যে কই ম্যালা করসেন?”
- “অফিসে যাই। আপনি দেখি এই সকালেই আমলনামা নিয়ে বসছেন?” হাসতে হাসতে জবাব দেয় আরিফ।
- “আর কইয়েন না স্যার! হিসাব তো সারাদিনই করতেসি, মিলে তো না!” ফজলু মিয়ার গলায় স্পষ্ট হতাশা।
- “মন দিয়ে হিসাব করেন, মিলবে, মিলবে!” উৎসাহ দিয়ে বলে আরিফ।
- না স্যার, এই হিসাব আর জীবনে মিলবো নাহ্! হালায় চোর ছ্যাচ্চর লইয়া আমার কারবার! পাঁচ ট্যাকা রাইখ্যা বাসায় গেলে সাত ট্যাকা গায়েব অইয়া যায়। এই হিসাব মিলে, কন?
- আপনেরে ঘুণে ধরসে, ফজলু ভাই!!!
ফজলু মিয়া হো হো করে হেসে ওঠে। আরিফও আর কথা না বাড়িয়ে হাসি হাসি মুখে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। ফজলু মিয়া ব্যাস্ত হয়ে হাঁক দেন “ওই স্যারেরে টেবিল মুইছা দে!” অল্প বয়সী একটা ছেলে এগিয়ে এসে পুরনো ময়লা একটা কাপড় দিয়ে টেবিল মুছে দিয়ে বিনীত ভঙ্গীতে ফিরে চলে যায়। আরিফ বসতে বসতে আবার ছেলেটিকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বলে। আজ তার অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আরিফ আরাম করে চেয়ারে বসে দিনের প্রথম সিগারেট ধরায় এরপর একটা লম্বা টান দিয়ে দোকানের ঘোলাটে দেয়ালের দিকে তাকায়। বাতি জ্বালানো হয়নি বলে সব কেমন আধো আলো আধো অন্ধকারে ডুবে আছে। একটা ফ্যান খুব ধীরে ঘুরছে। ছেলেটা চা টেবিলে রেখে ফিরে যায়। ফজলু মিয়া তখনো হিসেব মিলিয়ে যাচ্ছে। তার চোখে গভীর মনোযোগ। আরিফের এক হাতে চা অন্য হাতে জলন্ত সিগারেট। ফজলু মিয়াকে দেখতে দেখতে তার সেই সিসিফাস বুড়োর কথা মনে পরে। লোকটা হ্যালিফ্যাক্সে আরিফের পাশের ঘরে থাকতো। মাঝ বয়সী মানুষ, এক তরুণী মেয়ের সাথে ঘর করত। অনেকদিন ধরেই তাদের সেই ঘর ভাঙছিল, তারপর হঠাৎ একদিন সে অবাক হয়ে দেখে তার ঘরের ছাদটাই কখন যেন ভেঙে পড়েছে! আর সে রাস্তায় একা…! সেই থেকে সে আরিফের পাশের ঘরে এসে জুটেছিল। সে সপ্তাহজুড়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি পিয়ানো সারাইয়ের কাজ করে বেড়াতো। ছুটির দিনে তার ছেলেদুটি তার সাথে থাকতে আসত। সেদিন সে অন্য মানুষ। ঘর গোছাত, রান্না করত, নিয়ম করে গোসল সারত, চুল আঁচড়াত, যেন সে দেয়ালে টানানো একটা শিল্পকর্ম আর তার ছেলেরা এক এক জন কঠিন শিল্পবোদ্ধা! ছেলেরা সারাদিন তার সাথে হুটোপুটি করতো, হইচই চিৎকারে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আর সে হাসি মুখে বিনীত ভঙ্গীতে আরিফের কাছে তাদের দুরন্তপনার জন্য ক্ষমা চাইত। তখন তার চোখেমুখে কেমন একটা প্রাপ্তির অহংকার! আরিফের খুব ভালো লাগত। লোকটার জীবনে একটাই স্বপ্ন ছিল - একদিন তার একটা বাড়ি হবে, দুটো ঘর থাকবে তার ছেলেদের জন্য, ওরা আসলে সে বসার ঘরেই ঘুমোতে পারবে। একটা ছোট রান্নাঘর থাকবে। ছেলেদের ঘরের ছাদে সে স্কাইলাইট বসাবে, রাতে ঘুমোতে গিয়ে তারা আকাশের তাঁরা দেখবে! আর বেশী কিছু না, শুধু ছোট এক চিলতে একটা ব্যাক ইয়ার্ড - কাজ থেকে ফিরে সে সেখানে বসে সিগারেট ধরিয়ে গিটারে পুরনো গানের সুর তুলবে, এটুকু থাকবে শুধু তার নিজের। যদিও বয়স হয়েছে, তবুও বাড়ি বানানোর কাজটা সে নিজেই করে নিতে পারবে। তেমন যদি প্রয়োজন হয়, দুএকজন বন্ধু কি তার হয়ে হাত লাগাবে না! জীবনে কম বন্ধুর উপকার তো সে আর করেনি! বিনিময়ে কিছুই চায়নি কখনো সে। তার প্রয়োজনে, তার বন্ধুরা এটুকু সাহায্যের হাত অবশ্যই বাড়িয়ে দিবে, সে বিশ্বাস তার আছে। ছেলেরা ফিরে গেলে পর সে প্রায়ই আরিফের সাথে তার স্বপ্নের কথাটা বলতো। স্বপ্নটা আরও গভীর ভাবে দেখবে বলে সে তার পুরো সপ্তাহের উপার্জন খরচা করে বোতল বোতল মদ কিনে আনত। তখন তার চোখে থাকত গভীর বিশ্বাস। আরিফের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে সে নিজেই নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে স্বপ্নটা হরবর করে বলে যেতো, ফজলু মিয়ার মতোই গভীর মনোযোগে বাড়ি বানানোর হিসেব কষত। নেশার ঘোরে তার হিসাব গুলিয়ে যেতো, তখন সে আবার প্রথম থেকে শুরু করত। এরপর এক সময় বোতলের মদ শেষ হয়ে গেলে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতো। কে জানে হয়তো তখনই সে তার স্বপ্নটাকে স্বপ্নের মতো করে দেখতে পেত! ঘুম ভাঙলে সে আবার তার পুরনো লরঝরে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পরত পিয়ানো সারাইয়ের কাজে। পরের সপ্তাহে তাকে আবার স্বপ্নটা দেখতে হবে, সেজন্য চাই পর্যাপ্ত রসদের জোগান!
আচ্ছা, ফজলু মিয়া কি জানে পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে অন্য আরেকজন মানুষ তার মতোই একই ভাবে একই সময়ে আকাঙ্খার হিসেব কষছে? সেই সিসিফাস বুড়োই কি জানে আকাঙ্খার নেশায় বুঁদ আরও একটা মানুষের ঠিঁকুজী? নাকি এরা দুজনেই ভিন্ন চেহারায় একই মানুষ - পৃথিবীর দুই প্রান্তে সিসিফাসের জীবন যাপন করছে?
অনেকদিন আগে আরিফ একটা গল্প পড়েছিল। সেখানে একজন লোক যৌবনে এক আনন্দময় শহরের নাম শোনে। সমুদ্র পাড়ের সেই শহরের মানুষেরা চীরসুখী, দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না, জড়া কাউকে বুড়িয়ে দেয় না, ঝলমলে রোদে চিরযৌবন প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতে হাত রেখে পরম বিশ্বাসে হেঁটে যায়। লোকটি ভাবল সে একদিন সে শহরে গিয়ে পৌঁছবে, এরপর সে সেই চিরযৌবন মানব-মানবীদের আনন্দে মিশে যাবে। লোকটি একদিন সত্যি সত্যিই সেই শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বহুদিন কেটে যায় পথে। এরপর একদিন সে ঠিক সেই শহরে পৌঁছে যায়। পথের ধারে একটা পাথরের উপর বসে একটু জিরিয়ে নেয়। যেমন সে শুনেছিল তেমনি চিরযৌবন তরুণ-তরুণীরা তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাদের মুখে অফুরন্ত হাসি, চোখে গভীর আনন্দের ঝিলিক। কিন্তু কি আশ্চর্য, তার আর এখন সেই ভালবাসার মিছিলে শামিল হতে ইচ্ছে করছে না। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল তার পোশাক জীর্ণ, চোখ ঝাপসা, শরীর ক্লান্ত, পথেই কখন যেন তার যৌবন নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছে, আর তার মগজে আকাঙ্খারা মরে স্মৃতি হয়ে গেছে!
সিগারেটের শেষ ছাইটুকু টুক করে চায়ের কাপে পড়ল। আরিফেরও ঘোর ভাঙল। সে আশপাশে তাকিয়ে দেখে আরও দুএকজন লোক দোকানে এসে বসেছে। নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে কথা বলছে। আরিফের আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। এখন সে উঠে পড়বে। যদিও আকাশ এখনো মেঘ করে আছে, যে কোন সময় ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে, তবুও সে বেড়িয়ে পরল। বৃষ্টি শুরুর আগেই অফিসে পৌঁছে যেতে হবে। ফজলু মিয়া চায়ের দাম রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে “নাশতা না কইরা কই যান?” “আজকে আর নাস্তা করব না, ফজলু ভাই। কালকে আসব” - বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে সে। ফজলু মিয়া একটু অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখে, অবশ্য সে আরিফের এসব পাগলামির সাথে ভালোমতোই পরিচিত। রাস্তার শেষ মাথায় আসতেই মতিঝিলের আকাশছোঁয়া দালানগুলো আরিফের চোখের উপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল এরা? আরিফ অবাক হয়ে দালানগুলোর দিকে তাকায়। তাদের মাথা যেন মেঘ পার হয়ে আকাশ স্পর্শ করেছে! কারা থাকে সেই আকাশ ছোঁয়া ঘরে? তারাও কি একদিন মেঘের স্বাদ নেবে বলে পাখি হতে চেয়েছিল? এখন কি সেই সাধ পূর্ণ হয়েছে? নাকি তাদের আকাঙ্খারাও মরে স্মৃতি হয়ে গেছে? আরিফ তখনো দালানগুলোর চুড়ার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে, যেন আরেকটু এগিয়ে গেলেই চুড়ার কোন ঘরের জানলা খুলে গলা বাড়িয়ে কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেবে। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কখন যে মাঝ রাস্তায় এসে পরে নিজেও টের পায় না। আর তখুনি কোথা থেকে একটা গাড়ি উটকো ঝামেলার মতো উড়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার এক পাশে ছিটকে ফেলে রেখে চলে যায়।
রাস্তায় চিৎ হয়ে পরে আছে আরিফ। খুব একটা ব্যাথা টের পাচ্ছে না সে, কিন্তু তবুও তার উঠতে ইচ্ছে করছে না, কেমন একটা মিষ্টি ক্লান্ত ভাব তাকে অবশ করে রেখেছে। দালানগুলোর ফাঁক গলে বিশাল আকাশটা দেখা যাচ্ছে। আরিফ বুক ভরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কোথা থেকে একটা ভোঁতা গুঞ্জন ভেসে আসছে। আরিফ দেখছে আজ সারা সকালের সব অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলো গোল হয়ে ভিড় করে তার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে অথবা আরিফ হয়তো সেভাবেই শুনছে “মইরা গ্যাছেনি?”, “তারাতারি হাসপাতালে নেওন দরকার”, “ভাই, কেউ একটা ফোন দেন না হাসপাতালে”, “শুনতাছেন ভাই আপনে?”...... কেউ তার একটা হাত ধরল, মুখটা ঘুরিয়ে এনে আবার জিজ্ঞেস করলো “ভাই শুনতাছেন?” আরিফ সব শুনছে কিন্তু উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার। সে প্রশ্নগুলোর দিকে অর্থশূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। তারা নড়ছে না, আগের মতোই গুঞ্জন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কেউ নড়বে না, যতক্ষণ না উত্তর পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তারা এক দৃষ্টিতে আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আরিফের হঠাৎ খুব ভয় লাগছে, খুব পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে, পরিচিত ঘর, পরিচিত মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে। সে অনুভব করল তার বুকের ভিতর হৃদপিণ্ডটা খুব দ্রুত চলছে, যেন একশটা ইঞ্জিনের পিস্টন প্রচণ্ড শক্তিতে এই পাথুরে শহরটার পথঘাট লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আর তখুনি সে অনেক দুরে আকাশে একটা বিন্দু উড়তে দেখে। বিন্দুটা একটু একটু করে বড় হয়ে একটা চিলের রূপ নেয়, এরপর ধীরে ধীরে তার খুব কাছে চলে আসে, এতো কাছে যে সে আর চিলটাকে আলদা করে দেখতে পায় না। চিলটার তামাটে পালকের ভিড় ফুড়ে কেমন করে যেন একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে আসে। ছেলেটাকে তার খুব চেনা মনে হয়, কিন্তু কিছুতেই সে মনে করতে পারে না সে কে! ছেলেটা হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকে, চোখের ইশারায় অভয় দেয়। আরিফ ধীরে ধীরে উঠে দাড়ায়, তার আর ভয় করছে না, হৃদপিণ্ডটা শান্ত হয়ে আসছে। আরিফ ছেলেটার সাথে হাঁটতে শুরু করে। তখনো পেছনে তার শরীরটা ঘিরে প্রশ্নগুলো গোল হয়ে ঘুরছে, গুন গুন করে কি যেন মন্ত্র পড়ছে, আর তার বুকে যজ্ঞের লাল আগুন একজন পুরোহিতের অপেক্ষায় জ্বলছে। সে তার চারপাশের এইসব আয়োজন অবহেলায় পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যায়, কোথায় যেন একটা মেঘভোজী পাখি তারস্বরে ডেকে ওঠে। সে একবার ফিরে তাকায়, তারপর জীবনের যাবতীয় জাদুময়তা উপেক্ষা করে সেই ছোট্ট ছেলেটার হাত ধরে একটা অন্তহীন সাদা কাশবনে হারিয়ে যায়।