ঘটনার সূত্রপাত হয় গত রোববার। ওই দিন 'ভুল চিকিৎসায়' অভিজিৎ হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু দাবি করে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। 'সুপার সানডে' কর্মসূচির নামে এই হামলা চালানো হয়। আগের দিনের হামলার জের ধরে গতকাল 'মেগা মানডে' কর্মসূচি দিয়ে যাত্রাবাড়ীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালানো হয়।
অতঃপর মোল্লা কলেজের কোটি টাকার সম্পত্তি লুট, ৫০/৬০ কোটি টাকার ক্ষতি। হামলাকারীরা শিক্ষার্থীদের সনদ ও ২০-৩০টি ল্যাপটপ নিয়ে গেছে, সব বৈদ্যুতিক পাখা ও পাঁচটি লিফট নষ্ট করেছে। ভবনের জানালা অক্ষত রাখেনি। সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনায় আহত হয়ে অন্তত ২৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। গতকাল সোমবার ঢাকায় এমন এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, 'সকাল ১০টার পরে আগারগাঁও থেকে খবর এল, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাছল। এর আগে ভোরে খবর আসে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে শাহবাগে জড়ো করা হচ্ছে। দুপুরে যাত্রাবাড়ী থেকে খবর এল, সেখানে একটি কলেজে হামলা চলছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাক-সিলেট মহাসড়ক। সন্ধ্যার পর জানা গেল, শাহবাগে শুরু হয়েছে মারামারি।'
ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে সরকারের তরফে একটা বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, 'পরিকল্পিত অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।' ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, বড় ধরনের পরিকল্পনা না থাকলে একদিনে এতগুলো ঘটনা কাকতালীয় না।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে...
• মাত্র ১২ থেকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর চাপ সামলানোর সক্ষমতা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেই। তারা এখনো জলকামান ব্যবহার করা শিখল না!
• অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে বিগত সরকারের অপপ্রচার এবং পরিকল্পনা সামাল দেয়া বা নস্যাৎ করবার সক্ষমতাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
• শিক্ষার্থীদেরকে বিপ্লবী চেতনা থেকে বের করে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে পারেনি বর্তমান সরকার।
কার্যত যা খুশি তাই করবার বুভুক্ষুতা থেকে তরুণ প্রজন্ম বেরিয়ে আসতে পারেনি। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় আসতে না পারা অনেক ইনফ্লুয়েন্সারই এই তরুণপ্রজন্মকে চরমভাবে মিসগাইড করে চলেছেন। বস্তুত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির মধ্য দিয়ে সেটিই পরিস্ফুটিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে অন্তত দুটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'বাম এবং ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি গণ অভ্যুত্থানে, এবং পরবর্তীতে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ এবং উসকানিমূলক কর্মকান্ড দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে।'
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'অযৌক্তিক কারণে দেশে বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের প্রতিহত করতে হবে। দেশের স্বার্থে তাদের প্রতিহত করে জনমানুষের নিরাপত্তা প্রদান করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজ।'
এরমধ্যেও সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মব ভায়োলেন্স টলারেট করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গেল কয়েকদিনে দেশের প্রমিনেন্ট দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে একটা শ্রেণী। তারা পত্রিকা দুটি বন্ধের দাবি তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানের কার্যালয় ভাঙচুর করছে। ঢাকার অফিসের পথ রুদ্ধ করে রাখছে। হাস্যকরভাবে জিয়াফত তথা গরুভোজন উৎসব করছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরাও হুমকির মধ্যে আছেন। এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, 'সংবাদপত্র অফিসে ভাঙচুর বা পত্রিকা বন্ধে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি সরকার সমর্থন করে না।'
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'আমি রাজশাহীতে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যদি আপনার প্রথম আলো ডেইলি স্টার বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকতা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে আইনি প্রতিকার পেতে আদালতে যেতে পারেন। আপনি শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে পারেন। সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নতুন কোন বিষয় নয়। এটা শত শত বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু সাংবাদিকদের হুমকি ও ভয় দেখানো বা সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা কোনভাবেই সহ্য করা হবে না।'
আন্দোলন করবার অধিকার সবার আছে, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা চাই। গণমাধ্যমের উপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি না।
কিছু জায়গায় সমস্যা তৈরি হলেও অন্তর্বর্তী সরকার যাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে সেই ব্যাপারে আমাদের সমর্থন ও সংহতি তারা পাবে। তবে সবার আগে দেশের সার্বিক শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ইতিবাচক কাজ আমরা এখনও দেখলাম না। জানি না সেখানকার উপদেষ্টা মহোদয় কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর কাছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য জবাবদিহি চাইতে পারেন। প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে হলেও দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় জোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
আমরা চাই না আরেকটা সুপার সানডে বনাম মেগা মানডের সিরিয়াস নাটক মঞ্চস্থ হোক।
লেখক: সাংবাদিক
২৬ নভেম্বর ২০২৪