যা হওয়ার তা হবেই
যা হওয়ার তা হবেই, যা হওয়ার তা হবেই, যা হওয়ার তা হবেই। শিহাব বারবার মনের মধ্যে এই কথা আওড়ে নিচ্ছিলো। যা হওয়ার তা হবেই, শুধু আমার সঙ্গে না আমার আগে আমার মতন আমার থেকে আলাদা সবার সঙ্গেই সেটাই হয়েছে, যা হওয়ার তা হবেই। বারবার নিজেকে একটা ‘যা হওয়ার তা হবেই’ কথা ছাঁচে ফেলে নিখাদ হওয়ার মধ্যে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো সে। শিহাব মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছিলো, সে নিজের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছিল। নিজের মধ্যে কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে সেই কবে থেকেই। অথচ আজ অনেক দিন পরেও সেখানে অন্ধকার, যা সর্ব গ্রাসি। আশেপাশের সবকিছুকে অন্ধকার করে দেওয়ার মহান পাঁয়তারা নিয়ে যার উৎপত্তি হয়েছিল ওর মধ্যে। মানুষের সৃষ্টি করা বেশিরভাগ উপাদান তার ধ্বংসের কারণ।
ট্রেন চলছে, ট্রেনের ছন্দের সঙ্গের দুলুনিতে ছন্দ তালেই সে বুঝিয়ে চলেছে যা হবে তা হবেই। যা হওয়ার বহু আগেই হয়ে গিয়েছে, সে শুধু ধীরে ধীরে পরিণতি দেখার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছে, যা হবে তা হবেই। ট্রেন সেই রাত ৮ টায় ছেড়েছে স্ট্রেশন। এখন ভোর পাঁচটা বাজবে বাজবে করছে। ট্রেনের বাতায়নের মোটা পুরু কাচের বাহিরে চলমান বেগবান চিরচেনা পৃথিবীর খানিক দেখা যাচ্ছে। ট্রেন এখন সম্ভবত কোনো গ্রাম্য এলাকা দিয়ে চলেছে, সকালের ফুটতে থাকা আলোয় দেখা যাচ্ছে শিশিরভেজা প্রান্তর, কিছু সাদা পাখি উড়ে চলেছে এদিক সেদিক। ট্রেনের কাঁপুনির সঙ্গে মাঠঘাট প্রান্তর দুলছে। বাহিরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ধীরে ধীরে আলোকময় হলেও সে অনুভব করছে তার ভেতরের দৃশ্য এখনো সেই অন্ধকার, যে অন্ধকারের গভীরতায় তার সবটুকু হারিয়ে যাচ্ছে।
অন্ধকার, ঝিরঝির বিটিভির মতন পরিবেশ। কিচ্ছু নেই, না থাকা তেমনটা গুরুতর না। এই যে নেই এইটা শিহাব জানে। আগে বুঝতে না পেরে মাঝে মাঝে ভয় পেতো। এখন আর ভয় পায় না, অভ্যাস হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ ভয় পায় না। মাঝে মাঝে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়, অথচ লুকানোর একমাত্র জায়গা সেই অন্ধকার। হয়ত সেখানে কেউ ছুরি হাতে বসে আছে। ধীরে ধীরে ফিস ফিস করে ডাকছে, ডেকে চলেছে অনবরত, “তোর এনাটমি করি আয়, তোর ব্যবচ্ছেদ করি আয়।” শিহাব জানে তাকে এইটা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। হয়ত অস্থিমজ্জার যেখানে লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয় সেখানে এই অন্ধকার কিংবা অন্ধকারে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকারও উৎপন্ন হয়। এইটা অবিচ্ছেদ্য কোনো নিয়ম, যা হবে তা হবেই এর মতন করে।
নাদিমের বাবা মারা যাওয়ার পরে বন্ধুরা সবাই মিলে নাদিমের বাসায় গেলো। নাদিম তখন চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে ছিল, মুখে ক্লান্তির ছাপ। এই ক্লান্তি মানুষের মধ্যে লুকিয়েই থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। হঠাৎ বেরিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিবে বলে। সবাই নাদিমকে গোল করে ঘিরে বসলো, নাদিম চোখ খুলে তাকাতে শিহাব ওর কাঁধে হাত রাখলো। নাদিম শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, বললো “বস শিহাব?” শিহাব ধীরে উত্তর দিলো, “নাহ, দাঁড়িয়েই ঠিক আছে।” নাদিম এর পরে আর কোনো কথা বলেনি। লাশ দাফনের শেষে অনেকক্ষণ বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সব ছেলেরাই থাকে, দাঁড়িয়ে থাকা শেষে সেও ফিরে আসছিলো সবার সঙ্গে। গোরস্থানের গেটের পাশে কিছু বন্ধু সহ শিহাবও দাঁড়িয়ে ছিল।
ফেরার সময় শিহাব আর নাদিম একসঙ্গে পাশাপাশি হেটে হেঁটে ফিরছে, নাদিম হঠাৎ দমকের মতন বলে উঠলো, “আব্বু অনেক হাঁটত, প্রায় কাছাকাছি যেখানে হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যায় আব্বু হেঁটে হেঁটেই যেত।” আমি তোর দিকে না তাকিয়েই সামনের বন্ধুদের লক্ষ্য করতে করতে বললাম, “আচ্ছা।” আমার কথা শেষ হতেই নাদিম বললো, “এর জন্যে মা সারাদিন বকতো, ডাক্তারেরও বেশি হাঁটাহাঁটি করা বারণ ছিল। শরীর শেষের দিকে এসে অনেকটা দুর্বল হয়ে পরে।” নাদিম থামলো, সম্ভবত চোখের সামনে বাবার দুর্বল শরীর কল্পনা করছে এখন। কিংবা বাবা দুর্বল না হলে কেমন হতো সেইটা ভাবছে এখন।
নাদিম ওর নীরবতা শেষে আবার বললো, “আব্বুকে এই নিয়ে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু বললেই বলতো, অত ভেবে কি হবে। যা হওয়ার তা হবেই। একদিন তো এমনিতেই যেতে হতো, ডাক্তার এখন শুধু সেই যাওয়ার দিনটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে দিলো তাই। আব্বুর এইরকম কথা শুনে মা অনেক রাগ করতো। তখন আব্বু বলতো, চিন্তা কইরো না। বেশিকিছু হবেনা মারাই তো যাবো। যা হওয়ার তা হবেই।” কথা বলতে বলতে নাদিমের গলা ভারী হয়ে উঠেছিল। শিহাব বুঝছেনা কি বলবে, তার কাছে বলার মতন কিছুই নেই, এমন পরিস্থিতিতে বলার মতন কারুর কাছেই কিছু থাকেনা। আমাদের সব বলা কওয়া অনেক আগেই ফুরিয়ে যায় এমন পরিবেশে।
শিহাব আর নাদিম সেদিন হেঁটে হেঁটে নাদিমের বাড়ি ফিরেছিল। নাদিমের মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেদিন। সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরে এসেছিল শিহাব। তার মাথায় নাদিমের মুখে শুনা ওর বাবার কথা ভাসছিল, “যা হবে তা হবেই।” আসলেই যা হবে তা হবেই, এইটাই অমেঘ সত্যি। এই কথা মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার এই উপলব্ধি শিহাবকে নানান ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে, তীব্র কোনো কিছুর সামনে এসেও নিজেকে যখন আর খুঁজে পায়নি সে তখন নিজেকে বুঝ দিয়েছে, “যা হবে তা হবেই।” হয়ত এমনটাই হওয়ার কথা ছিল, কিংবা একটু অন্যরকম। অথচ যা হয় সেইটাই তখন সত্য, বাকি সব সম্ভাবনা শুধুই সম্ভাবনা সেইগুলা বাস্তবতা না, বাস্তবতায় শুধু যা হওয়ার সেইটাই হয়। শিহাব নাদিম এর পরে অনেক বছর সহপাঠী ছিল। একটা সময় সবকিছুই ফিকে হয়ে আসে সেই নিয়ম অনুযায়ী তাই হলো। নাদিম এক সময় উত্তরবঙ্গ রংপুর বিভাগের দিকে ওর এক ফুফুর বাড়ি থেকে পড়ালেখা করতে সেখানে চলে যায়।
দুইজনার মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো, এই যোগাযোগও শুধু খোঁজ খবরেই কেটে যেত।
ট্রেন চলছে, শিহাবের ছোটবেলায় পড়া ট্রেন নিয়ে ছড়াটার কথা মনে পরে গেলো, “ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই?” আসলেই ট্রেনের বাড়ি কোথায়? যদি ট্রেনের জন্মস্থান তার বাড়ি ধরা হয় তাহলে ইংল্যান্ড। সকল কিছুর জন্মস্থানই কি তার বাড়ি? তাহলে তো মানুষের বাড়ি মায়ের উদরেই থেকে গেছে। শিহাব ভাবছে একই সঙ্গে তার মাথায় ক্রমাগত ভেবে চলেছে সমান্তরালে, যা হওয়ার তা হবেই। শিহাবের চাকরিটা চলে গেছে। সে চাকরিটা চলে যাওয়ায় সংবাদ শুনে অফিস থেকে বিনা বাক্য ব্যয়ে সব বুঝিয়ে নিয়েছে। লেনদেন যা হিসেব ছিল তিন মাস পরে এসে বুঝে নিতে বলেছে কর্তৃপক্ষ। এমনটা হবে শিহাব ভেবেছিলো, সে ভেবেছিলো জন্যেই হয়েছে এমনটা না। বরং পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তাকে জানান দিচ্ছিলো এমনটা হবে। সে তাই বাড়ি যাচ্ছে, বাড়ি যাচ্ছে আর ভাবছে যা হওয়ার তা হবেই। বহুদিন পরে সে বাড়ি যাচ্ছে, একরাশ গ্লানি আর অনেকটা পরাজিত ভঙ্গিমা তার পুরো শরীর জুড়ে বিস্তার করছে। ভেতরের অন্ধকারটাও ক্ষণে ক্ষণে তালগোল পাকিয়ে জানান দিচ্ছে।
চাকরিটা ছিল তার একমাত্র সম্বল, এই সম্বলটাও ঠুকনো। এতটা ঠুকনো ছিল যে সে জানতো একটা হারাবে। সেদিন দেরি করে পৌঁছানোয় ম্যানেজার তাকে থেকে নিয়ে গিয়ে চা বিস্কুটে আপ্যায়ন করেছিল। এইটা ম্যানেজারের নীতিবিরুদ্ধ কাজকর্ম, কিছু মানুষ থাকে যাদের কাজকর্ম প্রত্যেকবার একই রকম হয়। এই একই রকমের কাজকর্মের তাল যখন কেটে যায় তখন বুঝে নিতে হয় কোথাও গন্ডগোল হতে চলেছে। এবং তাই হলো, কালকে সেই একই ভঙ্গিতে ম্যানেজার তাকে ডেকে চা বিস্কুটে আপ্যায়ন করে কণ্ঠে শীতল ভেজানো ভাবটা ধরে রেখে বলে দিলেন কোম্পানির বাজার মান্দার কথা। এই অবস্থায় বেশি স্টাফ রাখা কেমন কষ্ট সাধ্য সেইটাও লম্বা ফিরিস্তি দিলেন। তারপরে এই ব্যাপারে যে তার কোনো হাত হাত নেই তিনি তাও সুবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে এতদিনের সার্ভিসের জন্যে শিহাবকে ধন্যবাদ দিয়ে আস্তে বললেন। শিহাবও লক্ষ্মী ছেলের মতোই বসের কথা শুনলো, জিনিসপত্র গুছিয়ে একমাসের বেতন নিয়ে সোজা ম্যাসে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকে সে ট্রেনে, বাবা অবশ্য অনেক আগেই তাকে বলেছিলো এলাকায় এসে কিছু একটা করতে শহুরে জীবনে কিচ্ছু নেই। শিহাবই গ্রামে যেতে চায়নি, গ্রামে তার অনেককিছু পরে আছে। যেগুলো সে কখনোই ঘেটে দেখতে চায়না, চায়নি। অথচ এখন তার গ্রামেই যেতে হচ্ছে, সে ভাবলো যা হওয়ার তা হবেই। শেষমেশ বাবার কথায় গ্রামেই যাচ্ছে সে, সেখানে বাবাই একটা কিছু করে দিবে এ আশায় না। এখন সে শহর থেকে পালাচ্ছে, এই শহরে তার সম্বল বলতে সেই চাকরিটাই ছিল। ছিল কম্পিউটার স্কিনের সামনে বসে থেকে ক্রমাগত এক্সেলে ডেটা এন্ট্রি করা। এইগুলোকে কখনোই ওর আপন মনে হয়নি অথচ আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিল। সেবার যখন নাদিমের মৃত্যু সংবাদ শুনলো, তাও এলাকায় যায়নি এলাকায় ফিরেনি সে। কিন্তু এখন তাকে যেতে হচ্ছে, নিজের জন্যে যেতে হচ্ছে। মৃত মানুষের জন্যে কিছু না করলেও জীবিত নিজের জন্যে মানুষের কতকিছুই করতে হয়। কত পুরানা ব্যাপার তলিয়ে দেখতে হয়। নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয় না সারাক্ষণ, অথচ নিজের মধ্যে থেকেও কি বিচ্ছিন্নতা। নিরবচ্ছিন্নতা পেয়েছে নাদিম।
মৃত্যুর পরে মানুষের ইহজাগতিক চিন্তা থাকেনা, নিজের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা থাকেনা। মস্তিষ্কের উত্তপ্ততাই মানুষকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, শীতল শান্ত স্নিগ্ধতা নিজের কাছে নিয়ে আসে। শিহাব এইগুলা ক্রমাগত ভেবে চলেছে, আর ভাবছে এলাকায় গিয়ে সে একটা লম্বা ঘুম দিবে। ট্রেনের মধ্যেও ঘুমঘুম পাচ্ছে, আর বাহিরে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে। তাই বাহিরে তাকিয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ, বাবা হয়ত এখনই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। নেমেই সাদা দাড়ি ভর্তি একটা মুখ দেখতে পাবে। বহুদিন সেই মুখ, যে আশ্রয় থেকে শিহাব দূরে থেকেছে।
শিহাব আবার বাড়ি ফিরছে, একভাবে দেখলে তার আনন্দই লাগছে। বাড়িতে ফেরা তো হচ্ছে, ফিরেই নাদিমের কবরের পাশে যেতে হবে আগে। ঘুমেরও আগে এইটা করবে সে। যা হওয়ার তা হবেই, এইটাই ভালো। যা হওয়ার সেইটা যেহেতু হবে এইভাবে দেখলে আর কোনো ভাবনা কাজ করেনা। এই ট্রেনের মতন নিজেকে মাঠঘাট প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।