রাষ্ট্র চাইলে যে কাউকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসা করতে পারে। আইনানুগভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। রাষ্ট্রকে এই সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ। এমন বাস্তবতায় একজন ধর্মগুরুকে গ্রেপ্তারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে সসম্মানে খালাস পাবেন। মান্যবর ধর্মগুরুকে আইনের প্রতি খানিকটা বেশিই শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। কারণ পান থেকে চুন খসলেই তাঁর বিপুল ভক্তবৃন্দের মধ্যে ভুল বার্তা পৌঁছে গিয়ে বিরাট গণ্ডগোল বেধে যেতে পারে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে তেমন একটা কারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মিস্টার ব্রহ্মচারীর অনুসারীরা কিছুতেই তাঁর গ্রেপ্তার মেনে নিতে পারেননি। তার মানে দেশের প্রচলিত আইনকে তারা তোয়াক্কা করতে চাইছেন না।
এই ঘটনার রেশ ধরে একজন আইনজীবীকে দিনেদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হলো! ইসলাম ধর্মীয় বহু গুরুকে বিগত সরকার অ্যারেস্ট করেছে, হৈ হল্লাও হয়েছে। এভাবে কোনো আইনজীবীকে তো প্রাণনাশ করা হয়নি।
দ্য ডেইলি স্টার 'চট্টগ্রামে চিন্ময় অনুসারী-পুলিশ সংঘর্ষ, আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা' শীর্ষক সংবাদে জানাচ্ছে, আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে এ সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের মধ্যে এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন সাংবাদিক, আইনজীবীসহ অন্তত ১০ জন। নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিন্ময়ের অনুসারীরা আইনজীবী সাইফুলকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তিনি আমাদের বারের সদস্য ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য ছিলেন।'
এমনটা কেন হলো?
ইন্ডিয়ান ফরেন মিনিস্ট্রি ইতোমধ্যে ব্রহ্মচারীর সপক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার ও জামিন নাকচ করার বিষয়টি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি। বাংলাদেশে চরমপন্থিদের দ্বারা হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক হামলার পরে এই ঘটনা ঘটলো।'
এ ঘটনায় কলকাতার বিজেপি বিধায়ক ও বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারী কলকাতার বাংলাদেশ দূতাবাস ঘেরাও এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা সকল পরিসেবা বন্ধের হুমকি দিয়েছেন।
দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক ভাষ্যকারও এতে ঘি ঢেলেছেন। তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'বড় বড় দুর্নীতিবাজ ও গুম-খুনের আসামীদের গ্রেপ্তার না করে দেশ ত্যাগে সহযোগিতা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ। অথচ দেশে প্রকাশ্যে থাকা সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ধরতে খুবই তৎপর! এই তৎপরতাকে সন্দেহ করলাম!'
তিনি আরো লিখেন, 'আমেরিকার রিপাবলিকান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে যাওয়া তুলসী গ্যাবার্ড ইসকনের ভাবাদর্শে দীক্ষিত। ইসকন ব্যান করা মানে হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়িয়ে পড়া। তৌহিদি জনতার চাপে এই ভুল সরকারকে করলে হবে না। চট্রগ্রামের নিহত আইনজীবী হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে হবে। ঢালাও গ্রেপ্তার না, জড়িতদের গ্রেপ্তার।'
মিস্টার ফরহাদ মজহার অবশ্য সরকারকে শেষাবধি ভালো পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, 'এইসব হিন্দুদের কেন এক করে সংলাপের ব্যবস্থা করা হয়না? ৮ দফা না মানতে পারেন, কিছুটা মানেন। বাকিগুলোর জন্য সময় নেন। পর্যালোচনা করেন। তা না করে হিন্দুদের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ধূর্ত শিয়ালগুলোকে দিয়ে সাধারণ হিন্দুদের মগজধোলাই করার সুযোগ ও সময় দিচ্ছেন কেন?'
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে ইন্ধন থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অপরদিকে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ‘সারা দেশের সম্মানিত আলেম-ওলামাসহ সাধারণ জনগণকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি আমরা। কোনো চক্রান্তের ফাঁদে পা দেব না আমরা। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ড ও নাশকতায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের এই সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করার জন্য নানান ষড়যন্ত্র চলছে। ধৈর্য ধৈর্য এবং ধৈর্য।’
সার্বিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে সম্মিলিত সনাতন জাগরণী জোট ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ৩৫ বছর বয়সী তরুণ আইনজীবী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি এখন বারুদে রূপ নিয়েছে। সামান্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ পেলেও এটি এখন বিস্ফোরিত হতে পারে। কাজেই কাউকে ঢালাও দোষারোপের সময় এখন নয়। দিনেদুপুরে এমন ন্যাক্কারজনক বিভীষিকা সৃষ্টির বিচার করতে হবে। একজন আইনজীবীর প্রাণ কেড়ে নিল যারা সেই দায়ীদের বিরুদ্ধে ন্যায্য বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৩ কোটি হিন্দু ভাইবোনদের বলব দয়া করে রাষ্ট্রের কাউকে শত্রু ভাববেন না। সংখ্যালঘু শব্দবন্ধটি ঘূর্ণাক্ষরেও উচ্চারণ করবেন না। দেশটা একজন মুসলমানের যতটা ঠিক ততটাই আপনাদেরও। দেশটা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সদ্য রেজিম চেঞ্জ হয়েছে। যেই আন্দোলনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও সমান অংশগ্রহণ ছিল।
এই মুহূর্তে নানামুখী দাবি-দাওয়া ও চাওয়া-পাওয়ার ঘেরাটোপে পড়ে বিচিত্র মানুষ আক্রমণের শিকার হচ্ছে। দয়া করে এই আক্রমণকে ধর্মীয় মোড়ক দেবেন না। মব ভায়োলেন্সকে নিখাদ ভায়োলেন্স হিসেবে দেখুন। সরকার হয়ত এখনো দিশা খুঁজে পায়নি। তাই বলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এই সরকারকে ব্যর্থ করে দিলে তার ফলও কারো জন্য শুভকর কিছু হবে না। প্রগাঢ় ধৈর্য এবং কঠোর ঐক্যের বাইরে দেশ বাঁচানোর অন্যবিধ আর কোনো উপায় নেই। সকলপক্ষকেই এবার থামতে হবে। হিংসা ও ঘৃণা নয়, বুকের ভিতর দেশটা রাখুন।
লেখক: সাংবাদিক
২৬ নভেম্বর ২০২৪
48
View