পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

লাক্রিমোসা

১৪ মে ২০২৪

সুমাইয়া সিমি

মূল লেখক সিলভিয়া মোরেনো-গার্সিয়া

অনুবাদক সুমাইয়া সিমি


মহিলাটা যেন আবর্জনা আর ছেঁড়া ন্যাকড়ার একটা তাল। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে একটা শপিং কার্ট ঠেলে নিয়ে চলেছে। ধীরে সুস্থে নড়ছে, যেন অদৃশ্য কোন নদীর জোয়ারে ভেসে চলেছে একটা স্তূপ। শণের দড়ির মত চুল তার মুখ ঢেকে রেখেছে, কিন্তু রামোন টের পায় মহিলা তার দিকেই চেয়ে আছে। 

সে সামনের দিকে চেয়ে রইল। ভ্যাংকুভার শহর জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিন্নমূল মানুষদের উপেক্ষা করাই সবচেয়ে ভাল। একটা টাকা দিলেই ফকিরের দল মাছির মত ছেঁকে ধরবে। 

“আমার বাচ্চাগুলোকে দেখেছো তুমি?” মহিলা জিজ্ঞেস করে।

তার কানের কাছে মহিলার কণ্ঠ যেন শিরিষ কাগজের মত, শিউরে ওঠে সে। হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস করে বাড়ি খায়, যেন সুঁই ফুটিয়ে দিয়েছে বুঝি কেউ। সে হাঁটা থামায় না, কিন্তু গতি বেড়ে যায়। বাড়িতে এসে ফ্রিজের ভেতর দুধের কৌটা ঠেলে ঢুকিয়ে রাখবার আগে সে বুঝতে পারে না কেন মহিলার কথাগুলো শুনে সে এমন আঁতকে উঠেছিল: মহিলা তাকে ইয়োরোনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

বহু বছর ধরে সে তার কথা ভাবেনি। তার দেশে, সেই পোরত্রেরোতে কাটানো শৈশবের পর থেকে আর না। 

তাদের এলাকার সবাই ইয়োরোনার গল্প করত। একবার এক মহিলা নাকি তার বাচ্চাদের ডুবিয়ে মেরেছিল নদীতে। তারপর থেকেই রাতের বেলা সে ঘুরে বেড়ায় শহর জুড়ে, কেঁদে কেঁদে খোঁজে তার বাচ্চাদের। মহিলার সেই খুনখুনে কান্না একই সাথে সতর্কবাণী, এবং অভিশাপ।

রামোনের ছোট দাদা ক্যামিলো তার মায়ের কবরের কিরা কেটে বলেছিলেন, এক রাতে ঘোড়ার পিঠে বাড়ি ফেরার সময় পেত্নীটাকে দেখতে পান তিনি। তখন বর্ষাকাল, নদীগুলো সব উপচে উঠেছে। ক্যামিলো তাই বাধ্য হয়ে ঘুরপথে এক অচেনা রাস্তা ধরেছিলেন। 

তিনি দেখলেন ফাঁকা এক পথের ধারে সাদা কাপড় পরা এক মহিলা উবু হয়ে বসে আছে নোপালে কাঁটাঝোপের ওপরে। ফণীমনসার মাংসল অংশ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে রাক্ষসের মত, কাঁটা গেঁথে ভরে গেছে পুরো মুখ। মহিলা ক্যামিলোর দিকে তাকিয়ে হাসল। খোলা মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিল তার সাদা জামা।

পোরত্রেরোর আশপাশে এলাকার মানুষজন এই জাতীয় গল্পই ফিসফিসিয়ে বলে। সবই গাঁজাখুরি, বিশেষ করে ক্য্যামিলোর মত পাঁড় মাতালের মুখ থেকে। তবে আট বছরের যে ছেলেটা ভাঙাচোরা সাদা-কালো টিভিতে ভূতের সিনেমা দেখার জন্য জেগে থাকত, তার কাছে এ লোম খাড়া করা গল্প বটে।

কিন্তু এই আধুনিক শহরের মাঝখানে, স্কাইট্রেইন আর ঝলমলে দোকান-পাটের ভিড়ে ইয়োরোনার কথা ভাবাও হাস্যকর। রামোন তার মালপত্রের সাথে ভূতের গল্প বেঁধে আনেনি। পোরত্রেরো আর ইয়োরোনা, সবই সে অনেক দূরে ফেলে এসেছে।

*

সে দেখল সেই পাগলি মহিলা একটা সরু কার্নিসের তলায় বসে আছে, আশ্রয় নিয়েছে বৃষ্টির হাত থেকে। মহিলাটা কাঁদছে, একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ চেপে ধরেছে বুকে, যেন একটা নবজাত বাচ্চা কোলে নিয়েছে।

“আমার বাচ্চাগুলোকে দেখেছ?” মহিলা জিজ্ঞাসা করে, রামোন যখন ছাতা হাতে নিয়ে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে।

কাছেই একটা লোক একটা খালি দোকানের সামনে মাটিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, একটা কুৎসিত কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে তার পাশেই। রামোন পুরোনো সিগারেটের গোড়া টপকে যায়, আর শহরের ঠিকানাহীন মানুষেরা ছায়া থেকে পিটপিট করে তাকায় তার দিকে।

লোকে বলে এটা নাকি উঠতি এলাকা, কিন্তু প্রতিদিনই সে দেখে একটা না একটা নতুন ভিক্ষুক খালি কাগজের কাপ বাড়িয়ে ধরছে তার মুখের সামনে।

কি জঘন্য অবস্থা।

এই কারণেই সে মেক্সিকো ছেড়েছিল। তার শৈশবের পুতিগন্ধময় দারিদ্র্য, আর সাদা-কালো টিভিওলা সেই পিচ্চি শোয়ার ঘরটা থেকে পালিয়েছিল, যেটায় সে আর তার চাচাতো ভাইরা ভাগাভাগি করে থাকত।

তাদের বাড়ির পেছনে ছিল শুধু কাঁটাঝোপ, আর শূন্যতা। কোন রাস্তাঘাট ছিল না, কোন দালানকোঠাও না। শুধু নিষ্ফলা শূন্যতা গিলে নিত বেগুনী দিগন্ত। ওখানে ইয়োরোনা ঘুরে বেড়ায় বিশ্বাস করা খুব সহজ ছিল। 

কিন্তু এই ভ্যাংকুভারে নয়, যেখানে সবই নতুন আর ঝলমলে, ল্যাতে কফি আর আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়িতে উছলে উঠেছে। 

*

কুকুরগুলো মরাকান্না জুড়েছে। ওগুলো ভয় পাইয়ে দেয় তাকে। বুনো, বেওয়ারিশ প্রাণীগুলো রাতের বেলা বাড়ির পেছনে ছোঁকছোঁক করে। তার চাচা বলেছিল কুকুররা ইয়োরোনাকে দেখলে চেঁচায়। রামোন মেয়েদের ঘরে দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের বিছানায় উঠে পড়ে, শব্দ শুনে আতঙ্কে অস্থির, না ঘুমানো পর্যন্ত মা’র তাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে হয়। 

কিন্তু যখন সে জেগে ওঠে, রামোন তার অ্যাপার্টমেন্টে একা, আর শুধু একটা কুকুরই চেঁচাচ্ছে। তার পড়শির পোষা ডোবারম্যান।

*

পরের সপ্তায় রামোন পাগলিটাকে দেখে, দু’হাতে হাঁটু দুটো জড়িয়ে বসে আছে। 

“আমার বাচ্চাগুলো,” মহিলা বলে, নোংরা চুলের মেঘ তার মুখটাকে ঢেকে রেখেছে। “আমার বাচ্চাগুলো কই?”

মহিলার পাগলামি দেখে গা গুলোয়, যেন একটা পুঁজওলা কুৎসিত ক্ষত এসে তার রাস্তায় গজিয়ে উঠছে। আশেপাশে ছড়ানো সব ফকির-মিসকিনগুলোরই মত: ওষুধের দোকানের সামনে যে লোকটা সবসময় দুটো পয়সা চায়, যদিও রামোন কখনো তাকে ভিক্ষা দেয়নি, অথবা বার্গারের দোকানের ছায়ায় পরিচিত কম্বলের নিচে চিরকাল ঘুমিয়ে থাকে যে খড়ি ওঠা লোকটা।

এই শহরটা নর্দমায় ডুবে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখতে ভালোই লাগে এই লম্বা কাচের দালানকোঠায় ভরা আর পাহাড়ঘেরা শহরটাকে, কিন্তু তার তলায় চাপা পড়ে আছে নেশাখোর আর ভিখারিদের এক কুৎসিত জগাখিচুড়ি, ম্লান করে দিচ্ছে সব রূপ। এসব তাকে মনে করিয়ে দেয় তার দেশের বাড়ির কথা, আর ছাদ থেকে পানি চোঁয়ানো ঘরের কথা। সে চেয়ে থাকত তার বিছানার ওপর সিলিংয়ে গড়ে ওঠা পানির ছোট হলুদ দাগটার দিকে। সময়ের সাথে সেটা বড় হতে হতে একটা অশ্লীল কালো ছোপে পরিণত হয়েছিল। একদিন সে তার জিনিসপত্র নিয়ে রওনা দেয় উত্তর সীমান্তের ওপারে।

তার এখন ইচ্ছে হচ্ছে কৈশোরের সেই ঝোঁকের পুনরাবৃত্তি করে, একটা ব্যাগে নিজের সব মালপত্র ভরে ছেড়ে যায় ভ্যাংকুভারের ধূসর আকাশ। কিন্তু, সে যে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, আর কিছুদিন ধৈর্য ধরলেই আকাশছোঁয়া দাম হবে সেটার। আছে তার চাকরি, আছে চল্লিশ ছুঁতে চলা একটা লোক যত পিছুটান জমা করতে পারে সব। কয়েক বছর আগে হলে হয়তো পারত। এখন মনে হয় সবই যেন সময়ের এক দানবিক অপচয়।

রামোন নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। ভাবে যে একদিন যখন সে অবসর নেবে, তখন চলে যাবে কোন এক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপে, যেখানে থাকবে ঝকঝকে সাদা সৈকত আর নীল-সবুজ সাগর। মানবতার পচা-গলা অবশেষ কখনোই সেই সাগরে ধুয়ে তীরে উঠে আসবে না। 

*

সে বাজার করতে এসেছে, আর এখানেও সেই মহিলা, সুপারমার্কেটের পেছনের গলিতে আবর্জনা ঘেঁটে বোতল কুড়াচ্ছে।

ইয়োরোনা। 

সে যখন ছোট ছিল, সদ্য স্টেটসে এসেছে, তখন প্রতি বছর তার মা’কে একটা পোস্টকার্ড পাঠাত। টাকা পাঠাতে পারত না, কারণ বাসন ধোয়ার কাজ করে খুব বেশি পয়সা জমে না। ফোনও বেশি করতে পারত না, কারণ সে যে বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়েছিল সেখানে ফোনের লাইন ছিল না। কল করতে হলে রাস্তার ওপারের পে ফোন ব্যবহার করতে হত।

তাই সে পোস্টকার্ড পাঠাত।

কারমেন সেটা পছন্দ করত না। 

তার বোন অভিযোগ করত সে তাদের মা’কে কোন আর্থিক সাহায্য করে না।

“আমাকেই কেন মা’র দেখাশোনা করতে হবে, হ্যাঁ? কেন আমাকেই আটকে থাকতে হচ্ছে তার সাথে, এই বাড়িতে?” সে জিজ্ঞাসা করেছিল রামোনকে।

“নাটক করো না। তুমি মা’র সাথে থাকতে পছন্দ করো।”

“তুই ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে আছিস, একটা পয়সাও পাঠাস না।”

“এত সোজা না।”

“এখানেও কিছু সোজা না, রামোন। তুইও অন্য সব অপদার্থ ব্যাটাছেলেগুলোর মতই। দেশ ছেড়ে, মেয়েমানুষগুলোকে ফেলে যেখানে ইচ্ছে চলে গেলেই হলো। মা যখন বুড়ি হবে, অসুস্থ হয়ে যাবে, তখন কে দেখবে তাকে? বাড়িঘর সাফ করবে কে? চলবে কোন ছাতার পয়সা দিয়ে? আমি পারব না এসব, রামোন।”

“রাখি, কারমেন।”

“সব কিছু থেকে তুই পালাতে পারবি না, রামোন,” তার বোন চেঁচিয়েছিল।

তারপর সে আর কল করেনি। কিছুদিন পরেই সে শহর ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দেয়। যখন সে কানাডায় পৌঁছল, আর পোস্টকার্ড পাঠানোর ঝামেলায় যায়নি। ভেবেছিল পাঠাবে, একদিন, কিন্তু কাজের চাপে হয়ে ওঠেনি। আর বহু বছর কেটে যেতে সে ভেবেছিল এখন বরং ফোন করলেই আরো খারাপ দেখাবে সেটা।

আর এখন তারা কথাই বা বলবে কি নিয়ে? কত বছর আগে বাড়ি ছেড়েছে সে, ছেড়েছে পোরত্রেরোতে থাকা বোনকে আর চাচাত ভাইদের। পুরোনো রামোনের খোলস সব একে একে ছেড়েছে সে, বেরিয়ে এসেছে এক নতুন মানুষ।

কিন্তু হয়তো কারমেনই ঠিক বলেছিল। হয়তো সবকিছু থেকে পালিয়ে আসা যায় না। কিছু স্মৃতি, কিছু গল্প, কিছু ভয় পুরানো জখমের মত চামড়ায় লেপ্টে থাকে।

সেসব জিনিস আমাদের পিছু নেয়।

হয়তো ভূতেরাও আমাদের পিছু নিতে পারে।

*

আজ বিকেলটা বড্ড বাজে গেল। অফিস ভর্তি কতগুলো হারামি, রাস্তায়ও। তারপর বিশ্রী একটা ভারি বৃষ্টি নেমে এল, ফুটপাথ গিলে নিল যেন চিটেগুড়ের মত। সে ছাতা হারিয়ে ফেলেছে, জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে মাথা নিচু করে হাঁটছে। 

আর চারটা ব্লক পেরোলেই বাড়ি পৌঁছে যাবে। 

এমন সময়েই রামোন আওয়াজটা শুনতে পায়। তীক্ষ্ম একটা শব্দ। যেন কারো চিল-চিৎকার, যেন কারো গোঙানি, এমন একটা শব্দ যা সে আগে কখনোই শোনেনি।

কি জিনিস এটা?

সে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পায় সেই বুড়িকে, যার নাম সে দিয়েছে ইয়োরোনা। শপিং কার্ট ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে। 

ক্যাঁচ, কোঁচ, ঠেলা গাড়ি এগোচ্ছে, রামোনের প্রতি পদক্ষেপের সাথে তাল মিলিয়ে। ধাতব খচমচ, ক্যাঁচ কোঁচ, ছাপিয়ে একটা নিচু বিড়বিড়ানি ভাসছে।

“বাচ্চা, বাচ্চা, বাচ্চা।”

ক্যাঁচ, কোঁচ, ক্যাঁচ। প্রাচীন এক তালে একটা ধাতব সুর বাজছে।

সে আরো দ্রুত হাঁটে। ঠেলাটাও তার সাথে তাল মেলায়; চাকাগুলো ঘুরে চলে।

সে গতি দ্বিগুণ করে, ট্রাফিক বাতির রঙ বদলাবার আগেই দৌড়ে পেরিয়ে যেতে চায় রাস্তাটা। ঠেলাগাড়ি ক্যাঁচর কোঁচর করে, আরো কাছে চলে এসেছে, তার পায়ে পায়ে ছুটছে।

তার মনে হয় পাগলিটা বুঝি তাকে ঠেলাগাড়ি দিয়ে ধাক্কা মারবে এখনই, তারপর হঠাৎ শব্দটা থেমে যায়। 

সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। বুড়ি চলে গেছে। একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, বড় একটা ডাস্টবিনের আড়ালে মিলিয়ে গেছে।

রামোন দৌড়ে বাড়ি ফেরে।

*

কুকুরগুলো আবার চেঁচাচ্ছে। মরাকান্নার সুরে। বাতাস পিশাচের মত গর্জায়। বৃষ্টি আঁচড় কাটে জানালায়, ভেতরে ঢোকার জন্য হাহাকার করে, আর রামোন শুয়ে থাকে বিছানায়, আতঙ্কে স্থবির।

সে টের পায় তার মায়ের বাহু তার শরীর ঘিরে রেখেছে, মায়ের হাত পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে তার চুলে, যেভাবে সে যখন ভয় পেত তখন হাত বুলিয়ে দিত মা। সে একটা ছোট্ট ছেলে, তেপান্তরে ঘুরে বেড়ানো প্রেতিনীর ভয়ে কাতর।

মায়ের হাতটা তার হাত চাপড়ে দেয়।

মায়ের হাতটা হাড়ের মত। খড়ি ওঠা, লম্বা আঙুলে নোংরা নখ। মাটি লেপ্টে থাকা নখ। কাদা, পচা আবর্জনা আর ছত্রাকের গন্ধ বাড়ি মারে তাকে। 

সে মায়ের দিকে তাকায়, আর মায়ের চুল ধূসর রঙের জটা। তার হলুদ হাসি অন্ধকারে রঙের পোঁচ বুলিয়ে দেয়।

রামোন বিছানা থেকে লাফ দেয়। মেঝেতে পড়েই সে বুঝতে পারে ঘরটা অন্তত তিন ইঞ্চি পানিতে ডুবে আছে।

“আমার বাচ্চাগুলোকে দেখেছ তুমি?” বিছানার জিনিসটা জিজ্ঞেস করে।   

কুকুরগুলো চেঁচায়, আর তারপর রামোন জেগে ওঠে, তার মুখ বালিশে ডোবা।

*

সে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কাজে যায়। এতে কিছুটা নিরাপদ লাগে তার। রাস্তাগুলো ইয়োরোনার রাজত্ব, গলিগুলোর মালিকানা ইয়োরোনার।

লাঞ্চ করতে গিয়ে সে রাস্তায় জমা পানির গর্তের দিকে তাকিয়ে ভাবে ডুবে মরা বাচ্চাদের কথা; রুপালি নদীতে ভেসে যাচ্ছে লাশের পর লাশ।

কখনো ইয়োরোনার চোখের সামনে পড়বি না, বলত তার চাচা। একবার তোকে যদি দেখে ফেলে সে, পিছে পিছে বাড়ি চলে আসবে, তোর ওপর আসর করবে তুই না মরা পর্যন্ত। বুঝলি?

“আহারে, আমার বাচ্চাগুলো,” চিৎকার করে সে টেনে নেবে তোমাকে নদীতে।

কিন্তু রামোন তো তাকে পোরত্রেরোতে ফেলে এসেছে।

সে ভেবেছিল তাকে পোরত্রেরোতে ফেলে এসেছে। 

*

রামোন মনে করার চেষ্টা করে বদ আত্মা তাড়ানোর জন্য কোন তাবিজ বা টোটকা আছে কিনা। তার চাচা কখনো বলেনি সেটা। সে একটাই ওষুধ জানে এর, তার ময়ের আলিঙ্গন। 

“এই তো, বাবা, এই তো,” তার মা বলত, তার আর সে নিরাপদে মায়ের কোলে লুকিয়ে থাকত, যখন নদীর কূল ছাপিয়ে উঠত, আর বিদ্যুতের রেখা সাপ আঁকত আকাশে।

*

সকালে এক চিলতে রোদ আসে। রামোন সাহস করে কয়েক ব্লক হেঁটে যায়। কিন্তু বৃষ্টি না থাকলেও শহরটা মনে হয় যেন ধুয়ে মলিন হয়ে গেছে। সব রঙ মুছে গেছে। তার শৈশবের সস্তা টিভিতে যে এক রঙা ছবিগুলো প্রচার করত, তেমনি দেখায় শহরটাকে।

যদিও রামোন তার সামনে পড়ে না, ইয়োরোনার উপস্থিতি রাস্তাগুলোর ওপর ঘন হয়ে বিছিয়ে থাকে, আঁধারের টুকরোগুলো লেপ্টে থাকে দেয়ালে আর গলির ডাস্টবিনগুলোতে। এমনকি মানুষগুলোর ওপরেও যেন তা ছড়িয়ে যায়: ডাস্টবিন ঘাঁটতে থাকা একটা ভবঘুরের কাচের মত চোখে দালানের ইটের পরিবর্তে প্রতিফলিত হয় একটা নদী। 

সে ঝটপট বাড়ি ফিরে দরজায় তালা দেয়। কিন্তু যখন আবার বৃষ্টি হয়, বসার ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। অল্প কয়েকটা ফোঁটা তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছে কেবল। 

সে মেঝে মুছে সাফ করে ফেলে। আরো পানি চুঁইয়ে ঢোকে যেন পেকে ওঠা ফোঁড়ার মত, ফেটে গিয়ে পুঁজ বেরোচ্ছে। 

*

ইয়োরোনা গলির মুখে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে। রাতের বুকে একটা পিণ্ড রামোনের জানালার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কংক্রিটের দেয়াল আর কাচের ফাঁক দিয়ে রামোন তাকে টের পায়। তাকে খুঁজছে ইয়োরোনা।

সে পুরোনো নোটবুকটাতে লিখে রাখা ঝাপসা হয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া নম্বরটা ঘেঁটে বের করে।

তারা দালানের ওপর বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর বাতাস কাঁদে মেয়েমানুষের মত।

তার কানে জোরালো হয়ে বাজে ফোনের ডায়াল টোন।

দশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সে জানে না সে কি বলবে। সে কি বলতে চায় তাও জানে না। সে তো আর ভদ্রভাবে বলতে পারে না, ভূতটাকে মেক্সিকোতে ফিরিয়ে নাও।

সে ডায়াল করে।

এই নম্বরটিতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

সে ভাবে কারমেনের কথা, আর মায়ের কথা, আর তাদের বাড়ির পিছনে ধূলোময় শূন্যতার কথা। 

হয়তো কোন বাড়িই আর নেই সেখানে। হয়তো রাত্রি আর নদী তাদের গিলে নিয়েছে। 

*

ইয়োরোনা আসে বৃষ্টির সাথে। অথবা হয়তো উল্টোটিই সত্যি। বৃষ্টিই আসে তার সাথে। অন্য কিছু একটাও আসে। অন্ধকার। রামোনের অ্যাপার্টমেন্ট আঁধার হয়ে আসে। সে আলোর পুকুরগুলোতে গা ডুবিয়ে বসে থাকে, কালিমা থেকে দূরে।

বাইরে, গলিতে, ইয়োরোনা তার নখ দিয়ে ডাস্টবিন আঁচড়ায়।

কুকুরগুলো চেঁচায়।

রামোন বিছানায় কাঁপে, আর ভাবে তার মায়ের কথা, কিভাবে মা প্রেতদের তাড়িয়ে দিত।   

*

মহিলা গলির মাঝখানে এক গাদা জঞ্জালের পাশে বসে আছে, তার কাঁধ বেয়ে ঝরঝর করে নামছে পানি। তার বুকের সাথে চেপে ধরা ন্যাকড়া আর ময়লা আর প্লাস্টিকের টুকরো। মাথা নিচু, মুখ লুকিয়ে আছে চুলের পর্দার আড়ালে।

“আমার বাচ্চাগুলো কই। আমার বাচ্চাগুলো।”

মহিলা মুখ তুলে তাকায়, ধীরে ধীরে। বৃষ্টি তার মুখ ছেয়ে ফেলে, গাল বেয়ে নেমে আসে নোংরা স্রোতে।

রামোন দুঃস্বপ্নের কোন দৃশ্য আশা করেছিল: টপটপ রক্ত, বিড়ালের মত হলুদ চোখ, বা শূন্য একটা কঙ্কালের খুলি। কিন্তু এ তো এক বুড়ি মহিলা। সময়ের নখরে তার চামড়া ছিন্নভিন্ন, চোখদুটো মেঘের মত ঘোলাটে। এ এক বুড়ি মহিলা।

এই মহিলা তার মা’ও হতে পারত। কে জানে, হয়তো এ-ই তার মা। কত বছর আগে মায়ের ছবিটা হারিয়ে ফেলেছে রামোন, আর মা দেখতে কেমন ছিল তার এখন আর মনে পড়ে না। মা তার চুলে বিলি কাটত, আর তাকে জড়িয়ে ধরে থাকত, যতক্ষণ না ভূতগুলো উধাও হয়ে যায়। এখন সে ভূতের ভয় পাবার পক্ষে অনেক বেশি বড়ো হয়ে গেছে, তবু রাতের বেলা ভূতগুলো আসে।  

মহিলা তার দিকে তাকায়। শুষ্ক, বিস্মৃত, ভয়ার্ত।

“আমার বাচ্চাগুলোকে হারিয়েছি,” মরা পাতার মত সুরে মহিলা ফিসফিস করে।

গলিটা একটা নদী। রামোন মহিলার কাছে যায়, কাদার মাঝে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে, ডুবে যায় রুপোলি পানিতে। সে মহিলাকে আলিঙ্গন করে, আর মহিলা তার চুলে হাত বুলোয়। মাথার ওপরে আকাশ পুরানো টিভি সেটের ছবির মতো সাদা-কালো, আর তার কানে হু হু করে যায় তার শৈশবের ভৌতিক বাতাস।


অনুবাদকের কথা

লা ইয়োরোনা মেক্সিকোর এক চলতি উপকথা। কোন এক মহিলা স্বামীর অবিশ্বস্ততার প্রতিশোধ নিতে নিজের সন্তানদের ডুবিয়ে মেরেছিল নদীতে। শোকে উন্মাদ সেই নারীকে নাকি দেখা যায় নদীর কাছাকাছি ঘুরে বেড়াতে, কেঁদে কেঁদে খোঁজে তার নিজেরই হাতে নিহত সন্তানদের। তাই তার নাম ‘লা ইয়োরোনা’, ক্রন্দরনরতা নারী।

লাক্রিমোসা অর্থও ক্রন্দনরতা, ল্যাটিন ভাষায়। তবে এ শব্দটি মূলত সন্তানহারা, দুঃখিনী মাতা মেরির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।