Posts

চিন্তা

তবু আমি টিকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও!

November 30, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

ভারতীয় বাঙালি কবি সৃজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 'পতাকা' নিয়ে কথা হচ্ছে। ইস্যুটা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন। আসুন কবিতাটি দেখে আসি... 

শুশ্রূষা ও জল নিয়ে কী সহজে ভুলে গেলে ঋণ! 
যে-পতাকা পিষে যাচ্ছ, তারই অংশ ছিলে একদিন। 

ভাষা তো নিশ্চয় প্রিয়। তারও চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি।
আমাকে ‘বাঙালি’ থেকে ‘ভারতীয়’ করে তুললে তুমি। 

ভালবাসা-বিরোধের মাঝখানে সরু একটা সুতো 
তাকে যদি তুলে নাও, অন্য ভাবে কথা হবে দ্রুত। 

এত যদি দ্বেষ থাকে, যদি এত ঘৃণা হয় জড়ো -  
তবে তো সওয়াল ওঠে, ক্ষমা কি দেশের চেয়ে বড়? 

নামেই স্বাধীন তুমি। চেতনায় আজও পরাধীন।
যে-পতাকা পিষে যাচ্ছ, তারই নীচে ছিলে একদিন।
আমাদের দেশের খুব হাতেগোনা গুটিকয়েক ছাত্র ভারতীয় পতাকা পদদলিত করেছে। এটা খুবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সাথে জাতিগতভাবে বাংলাদেশি কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের দায় নেই। বরং গেল রেজিমের সময় পরিপুষ্ট শিক্ষার্থী‌ ও তাদের একশ্রেণীর শিক্ষাগুরুরা কী করে এতটা জাতিবিদ্বেষী হয়ে উঠল তার জবাবদিহি চাইতে পারেন সেই মানুষটির কাছে যিনি এখন শিষ্যসাবুদদেরকে অথৈ জলে ভাসিয়ে নিজে দিল্লির সেফ জোনে আছেন। 

আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তা ও সমর্থন স্মরণ করি। কোটি শরণার্থীকে দেয়া আপনাদের সাহচর্য কখনোই ভুলব না।

কিন্তু মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায় আপনি কোনোমতেই বুয়েটের দায়ভার টোটাল বাংলাদেশির ওপর চাপাতে পারেন না। বাংলাদেশকে পরাধীন বলবার স্পর্ধা দেখানো কিছুতেই আপনার সাজে না। বাংলাদেশ কোনোকালে ইন্ডিয়ান পতাকার অধীন ছিল না। ছিল ব্রিটিশ কলোনি এবং পাকিস্তানের পার্ট। কাজেই আপনার কবিতার নীচে থাকার বয়ান খুবই Ridiculous and Silly! 

তিস্তার জল নিয়ে টালবাহানা ভুলে গিয়ে আপনি আমাদেরকে অতীতের নীচের অংশ ভেবেছেন। ধরে নিচ্ছি কলোনিয়াল মাইন্ডসেট থেকে আপনি এখনো বেরোতে পারেননি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং কবিবর শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনাকে আসলে কিছুই শেখাতে পারেননি। 
উপরন্তু সনাতন পুরাণের উর্ধ্বে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তক হয়ে উঠাও হলো না আপনার। অতীতে হিন্দু সমাজে চারটি শ্রেণি ছিল, ব্রাহ্মণ (বৈদ্য-শাস্ত্রী-পুরোহিত জাতীয় লোক), ক্ষত্রিয় (রাজন্যাস নামে পরিচিত, যারা শাসক, প্রশাসক ও যোদ্ধাও ছিলেন), বৈশ্য (কারিগর, ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী এবং কৃষক), এবং শূদ্র (শ্রমঘটিত শ্রেণিগত)। আরো একটি পঞ্চম ভাগ ছিল, যাদের উপজাতি লোক এবং অস্পৃশ্য লোক চিহ্নিত করা হতো। 

আপনি কী সহজে বাংলাদেশীদেরকে পঞ্চম ভাগে ফেলে দিলেন। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে পদাবনত রাখবার চিন্তা খুবই সংকীর্ণ, অমানবিক ও ব্যাকডেটেড। কাজেই আপনার কথিত পতাকা কবিতাটি আমাদের ফিলানথ্রোপিস্টদের ভুবনে অচল বলে গণ্য করা হলো। 

আপনি স্পষ্ট করে বুয়েটের ভুল করা শিক্ষার্থীদের কঠোর সমালোচনা করতে পারতেন। যেটা আমরাও করছি। ছেলেরা ভালো কিছু করেনি। তাদেরকে ভুল শোধরে দেয়ার ফিলোসফি দেখাতে পারতেন। এমনকি এখানে পদদলিতের পর যেহেতু আপনারা বাংলাদেশের পতাকা নিয়েও যাতা কাণ্ডকারখানা করে দেখিয়েছেন, এটাকে টিট ফর ট্যাট বা কাটাকাটি থিওরিতে ফেলে ঘৃণা না ছড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলতে পারতেন। আপনি তা না করে নিন্দামন্দ ও বিষোদগারকে নিজের কাব্যে স্থান দিয়ে হীনমন্যতার পরিচয়টাই স্পষ্ট করলেন। 

কবি সৃজাত বন্দ্যোপাধ্যায় স্রেফ আপনার জন্যই বুঝি বহুবছর আগে রবিঠাকুর কণিকায় 'শক্তির সীমা'তে লিখে রেখেছেন...
কহিল কাঁসার ঘটি খন্‌ খন্‌ স্বর--
কূপ, তুমি কেন খুড়া হলে না সাগর?
তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব,
জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব।
কূপ কহে,সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ,
সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ।
কিন্তু বাপু , তার লাগি তুমি কেন ভাব!
যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নাবো--
তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও। 

লেখক: সাংবাদিক
৩০ নভেম্বর ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login