Posts

প্রবন্ধ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস(পর্ব-৬)

December 1, 2024

Yousuf Haque Chowdhury

129
View

১০৬০ এর দশকে জেরুজালেম নগরীর কর্তৃত্ব সেলজুক মুসলিমদের হাতে চলে যায়। তারা পবিত্র শহরটিতে ইউরোপ থেকে আগত খৃষ্টান তীর্থ যাত্রীদের বিশৃংখলা নিয়ন্ত্রনের জন্য কঠোর হতে শুরু করে। ১০৭৭ সালে আনাতোলিয়ার সেলজুক শাসকেরা ইউরোপ থেকে আগত খ্রিষ্টানদের জেরুজালেমে যেতে বাধা দেয়। এ ঘটনায় পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্ষুব্ধ হন। ১০৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফ্রান্সের ক্লেরমন্ট শহরে পোপ দ্বিতীয় আরবান এক বক্তৃতায় বলেন, খ্রিষ্টানরা যদি জেরুজালেম উদ্ধার করতে যুদ্ধে যান, তাহলে ঈশ্বর তাঁদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। 

পোপ আরবান ঘোষণা করেন, এই ধর্ম যুদ্ধে যে মারা যাবে সে জান্নাতের অধিকারী হবে, তার সব পাপ ক্ষমা করা হবে। শহর বিজয়ের পর সেখান থেকে যেসব ধন দৌলত পাওয়া যাবে, তা তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। পোপের এই ঘোষণার ফলে সারা ইউরোপের খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। ধর্মীয় আবেগে হাজার হাজার কৃষক-জনতা পোপ দ্বিতীয় আরবানের ডাকে সাড়া দেয়। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা কনস্টান্টিনোপলে সমবেত হয়। তাদের প্রতীক ছিল লাল রঙের ক্রস চিহ্ন। ১০৯৫ খৃস্টাব্দ থেকে এভাবেই বিনা উষ্কানিতে, বিনা শত্রুতে শুরু হয় ক্রুসেড নামক এক মিথ্যা ধর্মীয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। 

১০৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিশরের ফাতিমী শাসকরা সেলজুকদের পরাজিত করে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফাতেমীরা ছিলো শিয়া আর সেলজুকরা সুন্নি। এমতাবস্থায় ফাতেমীরা সেলজুকদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদের সাথে জোট গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু প্রস্তাবটি কার্যকর হয়নি। ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। 

এদিকে কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট অ্যালেক্সিয়াস পোপ ২য় আরবানের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন যে যুদ্ধের মাধ্যমে যেসব এলাকা দখল করা হবে, সেসব এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অংশ হবে। আবার ইউরোপের কিছু খৃস্টান সামন্ত রাজার ধারণা ছিল মুসলমানদের এলাকাগুলো দখল নিতে পারলে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা কেটে যেতে পারে। অর্থাৎ এই যুদ্ধের পিছনে কোন নির্দিষ্ট একটা কারণ ছিল না। তবে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।     

এভাবে পোপ ২য় আরবান ক্রুসেড যুদ্ধের পথ তৈরি করে দিলেন। খৃষ্টীয় দশম শতকে ইউরোপের প্রভাবশালী খৃষ্টান রাষ্ট্রসমূহ বিশেষত ফ্রান্স এবং জার্মানী, হাংগিরি, ইতালি, ইংল্যান্ড ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূখণ্ড দখলের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে এই অঞ্চলকে আবার আবার খৃষ্টান সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভুক্ত করে নেয়া যায়। এই পরিকল্পনায় শামিল হয় ইউরোপের সুশৃঙ্খল ও প্রশিক্ষিত রাজন্যগণ যাদের নেতা ছিলেন ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ-১ এর ভাই হিউগ। 

প্রথম ক্রুসেড 

পোপের ডাকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৬০ হাজার নাইট টেম্পলার ও সাধারণ যোদ্ধা এই যুদ্ধে সমবেত হয়।ক্রুসেডারদের পক্ষ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মোট চারটি দল গঠন করা হয়। এই দলগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন রেমন্ড, গডফ্রে, হুগ, এবং বহেমন্ড। এছাড়াও পিটারের নেতৃত্বে People's Crusade নামে ক্রুসেডারদের আরো একটি দল গঠিত হয়েছিলো যেখানে ছিলো সাধারণ জনগণ আর কিছু নাইট যোদ্ধা। 

নাইট টেম্পলার কারা? -------------  ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় বল্ডউইনের সময় খৃষ্টান সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকে একদল স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরির প্রস্তাব আসে, যাদের কাজ হবে তীর্থ যাত্রীদের প্রতিরক্ষা ও জেরুজালেম সংরক্ষণ। ফরাসী রাজকীয় প্রথা অনুযায়ী একজন উচ্চ পদস্থ সম্মানিত ব্যক্তিকে এই বাহিনী তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন হিউ ডি প্যান নামক। এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় The Order of the Poor Knights of the Temple of King Solomon, সংক্ষেপে The Knight Templar যারা এক দিকে সন্ন্যাসী অপর দিকে ঈশ্বরের নিবেদিত যোদ্ধা।অর্থাৎ নামের তাৎপর্যের দিক দিয়ে ‘নাইট টেম্পলার’ হল ধর্ম যোদ্ধা। 

১০৯৫ সালে প্রথমে People's Crusade বাহিনী বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে মুসলিমদের আক্রমণ করলে সেলজুক বাহিনী দলটিকে পরাজিত করে। এরপরের বছর মানে ১০৯৬ সালে Godfrey of Bouillon নামক এক ফরাসি নাইট সেনাপতি ফ্রান্স থেকে তার বিশাল বাহিনী নিয়ে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। প্রথমে তিনি কন্সট্যান্টিনপোলে আসেন। ইতিহাসবিদ থমাস অ্যাসব্রিজ লিখেছেন, প্রায় ৭৫ হাজার ক্রুসেডারের এই বাহিনী সেলজুক রাজধানী নিকায়া দখল করে নেয়। এরপর দরিলিয়ামের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে ঠেকিয়ে দেয়। এরপর জুন মাসে তারা ওডেসা এবং অ্যান্টিওক দখল করে। ফলে তাদের জেরুজালেমের দিকে যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়।    

হোমস দখল করার পর ক্রুসেডাররা জেরুজালেম নগরীতে প্রবেশ করে বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে। সেই সময় জেরুজালেমের গভর্নর ছিলেন মিশরের ফাতিমী বংশের শাসক ইফতিখার আদ-দুলা। তিনি জেরুজালেমে হাজার খানেক সৈনিক আর চারশো অশ্বারোহী মোতায়েন রেখেছিলেন যা ক্রুসেডারদের সামনে খুবই নগন্য ছিলো। ফলে ওই খৃষ্টধর্মীয় উম্মাদরা ১৫ জুন ১০৯৯ বায়তুল মুকাদ্দাস সহজে দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের (১০৩৫-১০৯৯) সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল। 

শহর দখলের পর তার পবিত্রতা রক্ষার কোন চেষ্টাই করা করা হয়নি। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের বিবরণ অনুযায়ী জেরুজালেম বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা পবিত্র শহরটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। ১০ হাজারের উপর মুসলমান ও ইহুদিকে হত্যা করা হয়, তাদের ধনসম্পদ লুটে নেয়া হয়। তাদের জিঘাংসা থেকে কেউ রক্ষা পায়নি সেদিন। সেদিন নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে ক্রুসেডার যোদ্ধারা। শহরবাসীর রক্তে সেদিন নাকি ঘোড়ার খুড় পর্যন্ত পিছলে যাচ্ছিল। 

অথচ এর কয়েকশ বছর আগেই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) জেরুজালেম বিজয় করে খৃষ্টানদের প্রতি কতইনা নমনীয় আচরণ করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের আশপাশের স্থাপনাগুলো দখলের পর Godfrey of Bouillon-কে জেরুজালেমের শাসক বানানো হয়।বিজিত বাকি এলাকাগুলো অন্যান্য খৃস্টান রাজাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এসব এলাকার মধ্যে ছিল ত্রিপোলি, আন্তাকিয়া ও সিরিয়ার কিছু অংশ।  

১২৯১ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূখণ্ড, বিশেষ করে বায়তুল মুকাদ্দাসের উপর কর্তৃত্ব বহাল রাখার জন্য ইউরোপের খ্রিষ্টানরা নয়টি ক্রুসেড করে যেখানে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের এই বর্বরতা বিশ্ব ইতিহাসে আজও নিন্দিত। এই যুদ্ধের জন্য অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে পশ্চিমারা যে চরম মিথ্যাচার করেন তার জের এখনও শেষ হয়নি। এসব যুদ্ধে ইউরোপীয়রা বিশ্বাসঘাতকতা, অনৈতিকতা, পক্ষপাতিত্ব, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ও বর্বরতার যে নজির স্থাপন করে তা ইতিহাসে চিরকাল কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। তাদের পরিকল্পনা সফল করতে গিয়ে তারা যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেন তা ছোট বড় আকারে ১৩ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। 

Comments

    Please login to post comment. Login