পোস্টস

গল্প

উত্তীর্ণ

১৫ মে ২০২৪

অর্ণব মিত্র

মূল লেখক অর্ণব মিত্র

আজকের রাতটা এত লম্বা কেন? কিছুতেই ঘড়ির কাটা আগাচ্ছে না৷ একটু পর পর বুক কেঁপে ওঠে, গলা শুকিয়ে যায়। কোনোভাবেই বিছানায় স্থির হতে পারছেনা শাওন। মনে হচ্ছে কিছু সময়ের জন্য স্মৃতি হারাতে পারলে বেশ হতো। ঈশ্বর! পাশ করিয়ে দিও। হাত জোর করে অন্ধকারে প্রণাম করে ও। ভয়ে চুপসে গেছে মন, মাথা ঘুরিয়ে ওঠে বারবার৷ কী হবে কালকে?  যদি রেজাল্ট খারাপ হয়?  বাবা মাকে কী বলবো?  সবাই কী বলবে? কীভাবে বাঁচবো আমি?  না!  ভাবতে পারছিনা৷ ঈশ্বর!  

রাত আরো গভীর হয়। ও অন্ধকারে চোখ মেলে ভাবছে, বাবা সারাদিন কত পরিশ্রম করে, কত কষ্ট করে আমাদের জন্য৷ এত অভাবের মধ্যেও আমার পড়াশুনায় কম ব্যয় করেনি। আর আমি যদি ভালো রেজাল্ট না করতে পারি! তাহলে কোন মুখে দাঁড়াবো তার সামনে? চোখে জল আসে ওর৷ রাগ হয় নিজের ওপর৷ এসব উপলব্ধি এখন হয়ে কী লাভ? পরীক্ষার আগে তো এসব মনে হয়নি, তখন তো এটা সেটা করে সময় অপচয় করেছি! ধিক্কার দেয় নিজেকে ও!  মনে মনে প্রার্থনা করে, এবারে পাশ করে গেলে, এরপর আর পড়ার জন্য বলতে হবেনা ওকে। সারাক্ষণ বই নিয়ে লেগে থাকবে। বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে। 

সকাল হয়েছে। আজ ছেলের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। অভাবের তাড়নায় পড়াশুনার সুযোগ পাননি রবিন৷ নিজের স্বপ্ন নিজের ছেলেকে দিয়ে পুরন করতে চান তিনি৷ রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন রবিন। রিক্সায় দুজন যাত্রী আলাপ করছে, তাদের মেয়ের রেজাল্ট নিয়ে। গোল্ডেন এ প্লাস! তাদের উচ্ছাস দেখে রবিনের চোখেও উচ্ছাস। ছেলের রেজাল্ট জানার জন্য উদগ্রীব হয়েছে মন৷ তারাতাড়ি তাদেরকে গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে বাড়ী ফিরলেন রবিন৷ শাওন বাড়ীতে নেই৷ বন্ধুরা মিলে স্কুলে নিয়ে গিয়েছে। রেজাল্টের পরে ওখানে সবাই আনন্দ করে একসাথে। ওরাও সামিল হবে তাতে। 

রবিন লোকাল বাসে চেপে স্কুলের গেটের সামনে থামে। ছেলে মেয়েরা ঢাক ঢোল পিটিয়ে আনন্দ করছে। সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ছেলে মেয়েদের। তিনি এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে শাওনকে খুঁজছেন। ফুটপাতে রাখা বেঞ্চের ওপর মাথা ঝুকিয়ে বসে আছে শাওন৷ রবিন দৌড়ে গেলেন৷ বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো শাওন। কিন্তু মাথা তুলছেনা। চোখ দিয়ে জল পড়ছে ফুটপাতের ধুলার ওপর৷ ছেলের চোখে জল দেখে রবিন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?  কী হয়েছে?  রেজাল্ট ভালো হয়নায়?  

শাওনের মুখে কোনো উত্তর নেই৷ 

দু হাতে দু কাঁধ ধরে জিজ্ঞেস করেন রবিন, ফেল করছোস? 

শাওন আর পারলোনা কান্নার শব্দ চেপে রাখতে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে শুধু শোনা যাচ্ছে,  ' বাবাআআ, বাবাআআআ। পাশ করতে পারিনি ইই আমি। তোমার সব কষ্ট জলে গেলো বাবা ' 

ছেলে পাশ করতে পারেনি শুনে রবিনের মুখ কালো হয়ে গেলো। কপাল কুঁচকে গেলো তার। খেয়াল করলেন ছেলের মুখের দিকে। দারুণ অসহায়ত্ব ওর মুখে। রবিনের মনে হলো, এ কী!  আমার ছেলের এমন অসহায় মুখ হবে কেন? আমি তো বেঁচে আছি এখনো৷ বাপ বেঁচে থাকতে ছেলের অসহায়ত্ব কীসের! তিনি আর কিছু ভাবলেন না। ছেলেকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। শাওন আরো জোরে কান্না করছে৷ এ কান্না ভয়ের নয়, এ কান্না বাবার বুকে আশ্রয় পাওয়ার। এ কান্না বাবার কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশের সুযোগের। 

রবিন বললেন, পাশ করতে পারিস নি,  তাতে কী হয়েছে?  আবার পড়বি ভালো করে। পরের বছর ভালো রেজাল্ট করবি। সবাই একবারেই পারবে তার তো কোনো কথা নাই। কেউ কেউ দুই বারে গিয়ে পারে। 

বাবার কথায় নব উদ্যম জাগে শাওনের৷ যে বাবা আমার ব্যর্থতায়ও আমাকে বুকে টেনে নেয় তাকে আমার সফলতার হাসি হাসাতেই হবে। শাওন আর সময় অপচয় করেনা। নিয়মিত পড়াশুনা করে। কেটে যায় এক বছর। পুনরায় পরীক্ষা দেয় শাওন৷ 

আজ রেজাল্ট বেরোনোর দিন। বাবাকে খুঁজছে শাওন। দৌড়াচ্ছে ও৷ দৌড়ে গ্যারাজে গিয়ে দেখলো,  বাবা রিকশার চাকা খুলছে। ছেলেকে দেখে রবিন চাকা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শাওন দৌড়ে গিয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা, আমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। বাবা আমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। 

রবিন ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে বুকে। চোখে জল আসে তার, কিন্তু মুখে আসে হাসি। 

লেখা: অর্ণব মিত্র 

বিদ্র: গল্পটিতে সাহিত্যরস হয়তো তেমন নেই। এ গল্পটি রচনার মুল উদ্দেশ্য হলো, অভিভাবকদের সচেতন করা। সন্তানের ব্যর্থতায় তাদেরকে ভর্ৎসনা না করে কাছে টেনে নিন৷ দেখবেন আপনার সন্তান নব উদ্যমে পথ চলতে শুরু করবে।