Posts

চিন্তা

বিজয়ের মাস: মাথা উঁচু করে বাঁচার নামই অর্জন

December 1, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

হেমন্তের অগ্রহায়ণ যখন তার মাঝসময়ে পা রাখে, সে সময় বাঙালির বিজয় আনন্দ নিয়ে আসে ডিসেম্বর। পৌষের দ্বিতীয় দিন তথা ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। আর পয়লা ডিসেম্বর তো সেই বিজয়েরই প্রারম্ভিকা। অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতে মধুর হাসি দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে আপ্লুত হয়েছিলেন। এক অনির্বচনীয় মায়ায় বাঁধা পড়েছিলেন কবি। আর পুরো বাঙালি জাতিসত্তাকেও সেই মায়ার বাঁধনে একসূত্রে গেঁথে রাখবার প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাই তো আমরা সর্বমানব এখন সমস্বরে প্রাণ খুলে গাইতে পারি :
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার 
প্রাণে বাঁজায় বাঁশি।   

পয়লা ডিসেম্বর বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার অর্জন তথা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসের শুরু। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ নামের এক নতুন রাষ্ট্রের ইতিহাস রচনা হয়েছিল এই মাসেই। হেমন্তের কচি ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দুর মতো আনন্দাশ্রু নিয়ে আসে লাল-সবুজের পতাকা আর গর্বিত মানচিত্রের অনুভব। পাকিস্তানি হানাদারদের ২৩ বছরের শোষণ, যন্ত্রণা আর নিষ্পেষণের জ্বালা ভুলানিয়া এ যেন এক শীতল পরশ। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর আমাদের কাছে অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ থেকে অনিমেষ মুক্তির অবিস্মরণীয় প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের তাজা প্রাণ, দুই লাখ মা-বোনের সভ্রম আর শত বুদ্ধিজীবীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবার শোকগাঁথা ভুলবার দিন তো এই ডিসেম্বরই। যে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এই দেশমাতৃকা, সেই মহান মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে আজ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস।

কবিগুরু এমন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই বুঝি বলে রেখেছেন :
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী!
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই-
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

হাজারও সমস্যাসংকুলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের নানা ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে অর্জনও কিছু কম নয়। ছেচল্লিশ বছরে এসেও আমরা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারিনি বটে, কিন্তু মানুষের শ্রমেঘামে অর্জিত দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ছে।

মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণ শ্রেণি বেড়ে যাওয়া ও বন্যা অথবা অপরাপর প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামাল দিয়েও রাষ্ট্রের অগ্রগতির চাকাটা সচল রাখা যাচ্ছে-এটাই বা কম কিসে! যদি আমাদের থাকত সুশাসন, দুর্নীতিহীনতা বা সততা তবে বাংলাদেশকে নিশ্চিতই এই সময়ের থেকে এগিয়ে রাখা যেত।

এখানে মানুষের স্বাধীন চিন্তাপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত নয়। এখনো জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজিত চিন্তা-চেতনা বহন করে একে অপরকে ঘায়েল করবার প্রয়াসী হয় বাঙালি মানুষ। 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সংবিধানের মূলনীতির সমাজতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতায় এখন আর আস্থা নেই কোনো পক্ষেরই। মানুষে মানুষে ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসবার মন্ত্রণা দেওয়ারও নির্ভরযোগ্য কেউ কোথাও নেই যেন। এই উত্তরাধুনিক সুপারসনিক যুগে এসেও ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীরা সমাজ ও মানুষের ওপর নানা মধ্যযুগীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিতে চায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরাও নিজেদের ভোট ও ক্ষমতার স্বার্থে সেসবের প্রতিবাদ না করে তাল মিলিয়ে যায়। মোটের ওপর মুক্তচিন্তার মানুষের জন্য মুখ বুঝে সবকিছু সয়ে যাওয়ার কাল এটা। কথা বলবার বা কিছু লিখবার সাংবিধানিক স্বাধীনতা পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। তারপরও আমার দেশের সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতা নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই এই ভেবে যে পরিস্থিত তো এর চেয়েও খারাপ হতে পারত।

অসাধু খাবার ব্যবসায়ীদের লোভের যাঁতাকলে পড়ে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে। শস্য, সবজি, মাছ বা মাংসে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা পদের বিষ। দেশে জুতো বিক্রি হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আর খাবার পাওয়া যায় ফুটপাতের ধুলোর লুটোপুটিতে। সেসব খাবারে বাস করে টাইফয়েড বা কলেরার ভয়াল জীবাণু। প্যাকেটজাত খাবার আমের জুসে দেওয়া হয় না আমের ছিটেফোঁটাও। সয়াবিন তেলে থাকে না তেলের আসল গুণাগুণ। মসলা বানানো হয় কাঠের গুঁড়ো আর টেক্সটাইল কালার মিশিয়ে। মানুষের জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম ওষুধে ভেজাল আরো ভয়াবহ। সেসব ভেজাল ওষুধ মনেপ্রাণে ভেজাল ডাক্তার বা হাসপাতাল হয়ে ঢুকে যাচ্ছে অসহায় মানুষের শরীরে। অকারণ সিজারে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজ সংসারের সবচেয়ে কর্মঠ মায়েদের জীবনীশক্তি। দেশে পড়ালেখা বলতে কিছু নেই। যেটুকুও বা আছে তা প্রশ্ন ফাঁস, বিচিত্র রকমের পরীক্ষা আর কোচিং বাণিজ্যের নামান্তর। দেশে রোজ মানুষ জন্মাচ্ছে, কিন্তু ভালো মানুষ সৃষ্টি হচ্ছে খুব স্বল্পই। এসব যাদের দেখভাল করবার কথা, সেই সরকারি-বেসকারি সংস্থার মানুষরাও ভেজাল গ্রহণ করতে করতে আপাদমস্তক ভেজাল মানুষে পরিণত হয়ে আছে। কাজেই যতটা দুর্গতি তার সবটাই সাধারণের।

দেশে অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে অপহরণ, গুম, খুন বা ধর্ষণের মতো ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো মানুষও হঠাৎ মিসিং হয়ে যাচ্ছে। নারীর যাত্রাপথে ওত পেতে থাকে কাপুরুষ বর্বর হায়েনা। সংবাদমাধ্যমে খুব বেশি অনুসন্ধানী রিপোর্ট চোখে পড়ে না। বেশির ভাগই এখন নিজেদের লাভালাভের আখের রক্ষায় ক্ষমতাসীনদের সেবাদাসে রূপান্তর করে নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ গণবান্ধব করা যায়নি। আইনিসেবাও সাধারণের জন্য সহজপ্রাপ্য নয়। দেশে বিরুদ্ধ রাজনীতি বলে কিছু নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ, চাল, পেঁয়াজ তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সেবার মূল্য বাড়লেও প্রতিবাদ করবার মতো মানুষ রাস্তায় নামে না। পরমতসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশ একরকম বন্ধ্যাই বলা যায়। সংসদে নামমাত্র যে বিরোধী দল রয়েছে, তা ঘুরেফিরে ওই সরকারেরই তল্পিবাহক।

তারপরও আমাদের দেশের মতো সুন্দর ও ভালো দেশ পৃথিবীতে খুব কম আছে। আফ্রিকান ক্ষুধাকাতর কোনো দেশ অথবা রাখাইন, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন, সিরিয়া বা অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নাগরিকের মতো ভিন দেশি অথবা নিজ দেশি সামরিক বাহিনীর অমানবিক দমন-পীড়নের মধ্যে আমরা নেই। আমাদের গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত বলছে বিশ্বসমাজ। ভবিষ্যৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল দলের সমান অংশগ্রহণে পরিশুদ্ধ গণতন্ত্রের দিকে দেশটাকে নিশ্চয় নিয়ে যেতে পারব। 
মাত্র ছেচল্লিশ বছরেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্যানিটেশনসহ প্রায় সকল আর্থসামাজিক সূচকে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছি। বিশ্ব শান্তি ও নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবস্থান এখন শীর্ষে। পোশাক রপ্তানিতে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল, মাছ ও ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে আমাদের অবস্থান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সৌর বিদ্যুতায়নেও আমরা বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। ধর্মান্ধদের ক্রমবর্ধমান অশুভ আস্ফালন সত্ত্বেও সক্ষমতায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারী। নারী-পুরুষের জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। এসবই পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসার যথার্থ সার্থকতা প্রমাণ করে।

বিশ্বকবি তাঁর গতিচেতনাবিষয়ক কাব্য ‘বলাকা’তে বলেছিলেন, যত পাই তত পেয়ে পেয়ে/ তত চেয়ে চেয়ে/ পাওয়া মোর চাওয়া মোর শুধু বেড়ে যায়/ অনন্ত সে দায়/ সহিতে না পারি হায়! একদিন নিশ্চয় দেশের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ও উদার ভালোবাসা সকল না পাওয়ার গ্লানি মুছে দিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবার প্রেরণা জোগাবে। হেমন্ত আর পৌষের বিজয়ানন্দে সারা বছর মেতে থাকুক বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন
০১ ডিসেম্বর ২০১৭

লেখাটি ৭ বছর আগে এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত

Comments

    Please login to post comment. Login