Posts

গল্প

মা-বাবার সম্পদ

December 4, 2024

সোহেল রানা

               মা-বাবার সম্পদ

অধ্যায় ১: সুখের সংজ্ঞা ও সম্পদের সীমা
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই সুখের সন্ধানী। কেউ সম্পদে, কেউ সম্পর্কের গভীরতায়, আবার কেউ জীবনের অর্জনে সুখ খোঁজে। কিন্তু সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা কী? এবং সম্পদ কি সত্যিই মানুষকে সম্পূর্ণ সুখ এনে দিতে পারে?

মানুষ মনে করে  অর্থ, ধন-সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি বা সমাজে উচ্চ মর্যাদা অর্জনই সুখের মূল উৎস। সেই লক্ষ্যেই তারা দিন-রাত নানা ধরনের পরিশ্রম করে। প্রতি নিয়ত দৌড়ায় আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কিন্তু এই সকল সম্পদ যখন অর্জিত হয়, তখনও কেন হৃদয়ের কোনো এক কোণে শূন্যতা থেকে যায়?

এখানে একটি বাস্তব উদাহরণ ধরা যাক—রহমান সাহেব ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। জীবনে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছে তিনি অনুভব করেন, এই অর্থ-সম্পদ তাকে প্রকৃত সুখ দিতে পারছে না। তার প্রিয় সন্তান বিদেশে, বন্ধুরা ব্যস্ত, আর জীবন জুড়ে রয়েছে নিঃসঙ্গতা। তার প্রাসাদ সমতুল্য বাড়ি যেন এক শূন্য কারাগার।

অন্যদিকে, কামাল নামের একজন মধ্যবিত্ত স্কুল শিক্ষক, যার অর্থ-সম্পদ সীমিত। তার স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে ছোট একটি বাড়িতে বাস করেন। সপ্তাহান্তে পরিবারের সঙ্গে আড্ডা, সন্তানদের ছোট ছোট হাসি এবং তাদের সফলতা তাকে পূর্ণ সুখ দেয়। তার জীবনে সম্পদ কম হলেও সুখের অভাব নেই।

এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় সম্পদ হয়তো জীবনের অনেক চাহিদা পূরণ করতে পারে। কিন্তু তা কখনোই হৃদয়ের গভীরতম সুখ আনতে পারে না। সুখের আসল উৎস হলো প্রিয়জনদের সান্নিধ্য, ভালোবাসা, এবং সম্পর্কের উষ্ণতা।

"আপনি কি সম্পদের পিছনে ছুটতে গিয়ে প্রকৃত সুখকে উপেক্ষা করছেন?"

অধ্যায় ২: অমূল্য ধন—সন্তান
পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকে এক পাশে রাখা হলে এবং অন্য পাশে সন্তানকে রাখা হলে মা-বাবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয়ে দাঁড়ায় তাদের সন্তান। সন্তান শুধুই একটি জীবন নয়, বরং মা-বাবার স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা এবং ত্যাগের প্রতিচ্ছবি। সন্তানের হাসি, প্রথম কথা বলা, প্রথম হাঁটা—এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই মা-বাবার কাছে পৃথিবীর সব ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি মূল্যবান।

প্রাচীনকাল থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে—"সন্তানই পিতামাতার প্রকৃত ধন।" এই ধন অর্থ দিয়েও কেনা যায় না এবং জমি-জায়গা দিয়েও মাপা যায় না। সন্তান হলো এমন এক সম্পদ যা মা-বাবাকে প্রতিনিয়ত নতুন স্বপ্ন দেখার প্রেরণা জোগায়। জীবনের প্রতিটি বাধাকে জয় করার শক্তি জোগায়।

মা-বাবা সন্তানের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝা যেতে পারে। রফিক ও রেহানা দম্পতি তাদের সন্তান রাহাতের জন্য নিজেদের সব চাহিদা ত্যাগ করেন। রাহাত যখন ছোট ছিল, তখন তারা নিজেদের ইচ্ছাগুলোকে পেছনে ফেলে শুধুমাত্র রাহাতের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখে ছিলেন। রাত জেগে তার পড়াশোনায় সাহায্য করা, অসুস্থ হলে সারারাত তার পাশে থাকা—সবকিছুই তারা হাসিমুখে করেছেন।

সন্তান যখন বড় হয় তখন তার ছোট্ট সাফল্যও মা-বাবার কাছে বিশাল হয়ে ওঠে। প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম পুরস্কার পাওয়া কিংবা একটি সাধারণ 'ধন্যবাদ' বলা—এসব মুহূর্ত মা-বাবার মনে আজীবন গেঁথে থাকে।

কিন্তু কখনো কখনো সন্তানরা এই ভালোবাসা এবং ত্যাগের মূল্য বুঝতে পারে না। তারা মা-বাবার অবদানকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। অথচ মা-বাবার হৃদয় সবসময় সন্তানের সাফল্যে আনন্দিত হয় এবং তার কষ্টে কেঁদে ওঠে।

এই অধ্যায়ের মূল বার্তা হলো—"সন্তান শুধু মা-বাবার জন্য একটি দায়িত্ব নয়, বরং তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং আনন্দের উৎস।"

তাই সন্তানের উচিত মা-বাবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্য বোঝা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা। কারণ মা-বাবার কাছে সন্তানই সেই অমূল্য ধন, যা কোনো সম্পদের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।

অধ্যায় ৩: নির্লোভ ভালোবাসার গল্প
ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ রয়েছে। কিন্তু নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ ভালোবাসার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলো মা-বাবার ভালোবাসা। এই ভালোবাসা কোনো প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করে না। বরং নিখাদ ত্যাগ, সহ্যশক্তি, এবং অপরিসীম স্নেহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মা-বাবা কখনোই সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় ভালোবাসা দেন না; তাদের একমাত্র চাওয়া সন্তানের সুখ এবং সাফল্য।

একটি ছোট গল্পের মাধ্যমে মা-বাবার এই নির্লোভ ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করা যেতে পারে।

গল্প: সুমন ও তার মা
সুমন ছিল এক সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার মা একজন গৃহিণী এবং বাবা দিন মজুর। খুব সাধারণ আর্থিক অবস্থা সত্ত্বেও মা-বাবা নিজেদের সমস্ত চাহিদা উপেক্ষা করে সুমনের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। তারা তাদের জন্য নতুন জামা-কাপড় না কিনে পুরোনো জমা-কাপড় পরেছেন।তাদের প্রিয় খাবার না খেয়ে সুমনের জন্য রেখে দিয়েছেন।

একদিন সুমন শহরে একটি বড় চাকরি পেয়ে দূরে চলে যায়। কর্মব্যস্ত জীবনে সে ধীরে ধীরে মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। মা প্রতিদিন সুমনের ফোনের অপেক্ষায় থাকতেন। কিন্তু সেই ফোন খুব কমই আসতো মায়ের কাছে। একদিন সুমনের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও তিনি তার অসুস্থতার কথা ছেলেকে জানাননি। কারণ, তিনি জানতেন সুমন সব সময় কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকেন।

মা-বাবার এই নির্লোভ ভালোবাসা এমনই। তারা সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না, বরং নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখেন।

মা-বাবার ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য
ত্যাগ: সন্তানের সুখের জন্য মা-বাবা নিজের চাওয়া-পাওয়া ত্যাগ করতে দ্বিধা করেন না।

সহ্যশক্তি: সন্তানের জন্য তারা সব ধরণের কষ্ট ও প্রতিকূলতা সহ্য করতে প্রস্তুত।

অসীম স্নেহ: সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কোনো শর্তে বাঁধা থাকে না।

ভালোবাসার মূল্যায়ন
অনেক সময় সন্তানেরা এই নির্লোভ ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। তারা মা-বাবার ত্যাগকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতে এই ধরনের ভালোবাসা খুবই বিরল।

সন্তান হিসেবে আমাদের উচিত মা-বাবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্যায়ন করা। তাদের সময় দেওয়া, তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং তাদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া।

"আপনি কি কখনো ভেবেছেন, মা-বাবার এই নির্লোভ ভালোবাসার জন্য আপনি কতটা কৃতজ্ঞ?"

অধ্যায় ৪: সংকট ও ত্যাগের মহিমা
মা-বাবার ভালোবাসা শুধু সুখের মুহূর্তেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সন্তানের জন্য কঠিন মুহূর্তগুলোতে তারা যে ত্যাগ ও ধৈর্যের পরিচয় দেন, সেটিই তাদের ভালোবাসার প্রকৃত মহিমা প্রকাশ করে।

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি পরিবারে কোনো না কোনো সময় সংকট আসে। সেই সময় কখনো আর্থিক অসচ্ছলতা, কখনো শারীরিক অসুস্থতা, আবার কখনো সামাজিক চাপের মুখোমুখি হন মা-বাবা। এই সংকটের সময়েও তারা নিজেদের কষ্ট উপেক্ষা করে সন্তানের জন্য আশ্রয়, ভালোবাসা এবং সুরক্ষা দিয়ে যান।

গল্প: বাবার শেষ সম্পদ
রবিউল হোসেন একজন দিন মজুর ছিলেন। তার একমাত্র মেয়ে মায়া ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন মায়া বড় হয়ে একজন ডাক্তার হবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন রবিউল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাজ করতে না পারায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।

মায়ার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মতো টাকা তখন রবিউলের হাতে ছিল না। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের শেষ সম্বল একটি পুরনো জমি বিক্রি করে তিনি মায়ার পড়াশোনা চালিয়ে যান। যখন কেউ জিজ্ঞাসা করত, "আপনার নিজের চিকিৎসার কথা ভাবছেন না?" তখন রবিউল বলতেন, "আমার জন্য বড় কথা নয়, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎটাই বড়।"

রবিউলের এই ত্যাগ এবং সংকট মোকাবিলার ধৈর্য মায়াকে শুধু ডাক্তারই নয়, একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

মা-বাবার সংকটকালীন ত্যাগের দিকগুলো
অর্থনৈতিক সংকটে ত্যাগ: মা-বাবা নিজেদের প্রয়োজন উপেক্ষা করে সন্তানদের জন্য শেষ সম্বলও ব্যয় করেন।

শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা: অসুস্থতা বা ক্লান্তির মধ্যেও তারা সন্তানের সেবা ও যত্ন নিতে পিছপা হন না।

মানসিক ধৈর্য: সামাজিক বা পারিবারিক চাপেও তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে ধৈর্যের পরিচয় দেন।

ত্যাগের মহিমা
মা-বাবার ত্যাগের আসল মহিমা হলো তারা কখনোই কোনো প্রতিদানের আশা করেন না। সন্তান সুখে থাকলেই তাদের সব কষ্ট সার্থক হয়ে যায়। সন্তান হিসেবে আমাদের উচিত মা-বাবার এই ত্যাগকে সম্মান করা। তাদের সংকটের সময় পাশে থাকা এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

"আপনার জীবনের কোনো সংকটকালে মা-বাবার ত্যাগ ও ধৈর্যের কথা কি আপনি মনে করতে পারেন?"

অধ্যায় ৫: মা-বাবার সম্পদের আসল অর্থ
মা-বাবার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তাদের সন্তান। তাদের প্রতিটি স্বপ্ন, আশা, ত্যাগ, এবং ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু থাকে সন্তানকে ঘিরে। তবে এই সম্পদের আসল অর্থ শুধু সন্তানের শারীরিক উপস্থিতি নয়; বরং সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার মর্যাদা, সম্পর্কের গভীরতা, এবং তাদের ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন।

মা-বাবার প্রত্যাশা
মা-বাবা সাধারণত সন্তান থেকে খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন না। তারা অর্থ, বিলাসিতা বা অন্য কোনো বস্তুগত জিনিসের জন্য সন্তানকে বড় করেন না। তাদের একমাত্র প্রত্যাশা হলো:

সন্তানের সুখ: সন্তান ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক—এটাই তাদের প্রথম চাওয়া।

সন্তানের দায়িত্ববোধ: সন্তান যেন মা-বাবার ত্যাগ এবং ভালোবাসার মূল্য বুঝে এবং জীবনে সঠিক দায়িত্ব পালন করে।

স্নেহ ও সম্মান: মা-বাবা শুধু চান সন্তান তাদের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান দেখাক, যা তাদের জীবনের পরিপূর্ণতা এনে দেয়।

গল্প: প্রাপ্তির আনন্দ
রাকিব একজন সফল প্রকৌশলী। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও সে তার মা-বাবাকে ভুলে যায়নি। প্রতি সপ্তাহে তাদের খোঁজ নেওয়া, অসুস্থ হলে পাশে থাকা, এবং তাদের সময় দেওয়া—এসব বিষয় রাকিবের জীবনের একটি অংশ।

একদিন রাকিবের মা বলেন, "তুমি আমাদের জন্য কী কী করছো, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, তুমি আমাদের সময় দিচ্ছো, আমাদের ভালোবাসার মূল্য দিচ্ছো। আমাদের এই বয়সে এটা-ই আমাদের আসল সম্পদ।"

রাকিবের মা-বাবার কথা থেকেই বোঝা যায় মা-বাবার সম্পদের আসল অর্থ হলো সন্তানের সান্নিধ্য, ভালোবাসা, এবং তাদের জীবনে যে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা সন্তান দেখায়।

ভালোবাসার মূল্য
সন্তানেরা যদি মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, যত্ন এবং সম্মান প্রদর্শন করে তবে তা হবে মা-বাবার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এটি শুধু একটি পারিবারিক সম্পর্ক নয় বরং জীবনের মূল্যবোধ এবং মানবতার প্রকৃত শিক্ষা।

শিক্ষা 
এই গল্পের শিক্ষা হলো—মা-বাবার সম্পদ হলো তাদের সন্তান। আর এই সম্পদের আসল অর্থ হলো ভালোবাসা, যত্ন, সম্মান এবং সম্পর্কের গভীরতা। সন্তান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো মা-বাবার এই অমূল্য সম্পদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা। তাদের ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাদের পাশে থাকা।

শেষ প্রশ্ন—"আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার মা-বাবার কাছে আপনি কতটা মূল্যবান?"

 

Comments

    Please login to post comment. Login