Posts

চিন্তা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গভীর টানাপোড়েন

December 4, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

73
View



গেল তিপ্পান্ন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এইসময় সবচেয়ে তলানিতে অবস্থান করছে। বুয়েটে পতাকা পদদলন থেকে এই ঘটনার সুত্রপাত এমন ভাবনা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। বরং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকেই দেশটা মোটাদাগে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে চলেছে। ক্ষমতাসীনরা সেই বিভক্তি না ঘুচিয়ে রাজনৈতিক হীনস্বার্থে জিইয়ে রাখবারই প্রয়াস পেয়েছে। বিভাজিত সমাজকে তারা ঐকতানের গান শোনাতে পারেনি। 

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় অবদানকে ঈশ্বরের বর মনে করে প্রতিবেশি দেশটির সকল আবদার মেটাতে ব্যস্ত থেকেছে। এরা চায়নি তারা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউ ভারতের মিত্র হয়ে উঠুক। 

অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা মনে করে ভারত তাদের নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো করেছে। তাদের ধারণা বাংলাদেশ পাকিস্তানমুক্ত হলেও ভারতের আগ্রাসনের বাইরে এক চিলতেও সরতে পারেনি। 

সর্বশেষ আওয়ামী লীগ রেজিমের তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ন্যারেটিভকে শক্ত ভিত দিয়েছ। ২০১৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেই ঝামেলার শুরু, সেটি ২০১৮ সালের রাতের ভোট হয়ে ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে সমাপ্ত হয়েছে। 

কার্যত এইসময় আওয়ামী লীগ ছাড়া শক্তিশালী ভিন্ন রাজনৈতিক দলবিহীন এই তিনটি নির্বাচনই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভারতবিরোধী করে তুলেছে। বলা হয়, একাত্তরের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে ভালো সুসম্পর্ক হলো কংগ্রেসের। একাত্তরে কংগ্রেস নেত্রী ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেন এবং প্রায় কোটি শরণার্থীকে নিজেদের দেশে আশ্রয় দেন। 

এই কংগ্রেসের সাথে যাদের সবচেয়ে বৈরি সম্পর্ক সেই বিজেপির নেতৃত্বে থাকা সরকারই কিনা ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে '২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যায়। আর সমর্থনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের পর ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের করুণ পতন হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। দেশছাড়া ওই নেত্রীকেই কিনা আশ্রয় দিয়ে রেখেছে মোদি প্রশাসন। যেহেতু একটি সফল গণ-আন্দোলন শেষে বাংলাদেশ এখন আওয়ামী বিরোধী শিবিরের করায়ত্তে, খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারত বিরোধিতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সব যেন একসাথে বের হয়ে আসছে। 

এতে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল করণীয় কি? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করতে পারে যে, তারা আর কারো আধিপত্য মেনে নেবে না। ভিনদেশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর এই দেশে হবে না। এটা যদি অন্তর্বর্তী সরকার না পারে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ প্রতিবেশির সাথে উভয়পক্ষের জন্য সমান সম্মানজক সুসম্পর্ক না রেখে কোনো দেশই আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে না। 

বুয়েটে ভারতীয় পতাকা অসম্মানিত করবার পর পাল্টা দিতে কলকাতাতেও বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছে। কলকাতার কবি সাহিত্যিকরাও এই ঘটনার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। এরপর ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হলে সেটি নিয়ে দুইদেশে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে হিন্দু ও সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশেও চিন্ময় দাস গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। 

কোনোপক্ষেই যেন থামাথামি নেই। ঘটনার পারদ ক্রমাগত আরো চরছেই। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে -এমন অভিযোগ করা থেকে ভারত সরকার কিংবা তাদের গণমাধ্যমকে কেউ বারিত করতে পারছে না। ভারতীয় নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ হচ্ছে‌ বাংলাদেশেও। 

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় গতকাল সোমবার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর ও বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি সহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকরা। এই সংগঠনগুলো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তথা ভিএইচপি'র সহযোগী সংগঠন। 

যদিও আগরতলার এই ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'দুঃখজনক' উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানিয়েছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়।
মুম্বাই মিশন এবং কলকাতার উপ হাইকমিশনকেও নিশানা করেছে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। 

গতকাল আরেকটি দুঃখজনক ও বিব্রতকর মন্তব্য এসেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে। গতকাল সোমবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা অধিবেশনে বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠাতে জাতিসংঘের কাছে আরজি জানাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আনুষ্ঠানিক এমন বিবৃতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশের শামিল। 

এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিজেপির বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশে 'আলু-পেঁয়াজ বন্ধ করে দেয়া'র হুমকিও জারি রেখেছেন। 

এরইমধ্যে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে  পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সরকার সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা সহ্য করবে না। দেশে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ নেই। বিশৃঙ্খলা হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এছাড়াও তিনি আরো বলেন, পারস্পরিক স্বার্থ ঠিক রেখে ভারতের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক, ভালো ও সুসম্পর্ক চায় বাংলাদেশ। ভারত-বাংলাদেশ উভয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী। 

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে বিশ্ব মিডিয়াও পিছিয়ে নেই। গেল ২৮ নভেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত 'Two South Asian Neighbors, Once Friendly, Are Now at Bitter Odds' -শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, Bangladesh’s Hindus have long faced prejudice and persecution, and their numbers have shrunk in the face of growing intolerance and rising Islamist militancy. Ms. Hasina ran a police state that coordinated closely with India and kept a lid on some of the extremist elements who have come out in the open since her fall. But deadly attacks against Hindus took place during her reign as well. 

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিত্র শেখ হাসিনা। ভারতে তাঁর অব্যাহত উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকার ও মোদি সরকারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করেছে। দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনার সবশেষ স্ফুলিঙ্গ ছিল হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ হিন্দু জনসংখ্যা ১০ শতাংশের কম। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি স্বীকার করেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে শেখ হাসিনাকে ভারতের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভারতের 'অপপ্রচারের' কথা উল্লেখ করেন তিনি। 

ওই প্রতিবেদনের শেষাংশে বলা হয়, বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার কিছু খারাপ চর্চা, যেমন বিরোধীদলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণমামলা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, 'রাষ্ট্রদ্রোহ' ও 'পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র'-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যা তারা আগেও দেখেছেন। 

দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখার কোনো বিকল্প চিন্তা রাষ্ট্রতত্ত্বে নেই। আর এই সম্পর্ক নবায়নে সবার আগে জরুরি নিজের দেশের বিশৃঙ্খলা দূর করা। 

এই মুহূর্তে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তা কারো‌ জন্যেই সুখকর নয়। দেশের মানুষ নিজেদের জানমাল বরবাদ করে সরকার পরিবর্তন করে শান্তি ও সংহতি স্থাপনের জন্য। সেই শান্তিই যদি অধরা থাকে তাহলে পরিবর্তন কোনো ফলপ্রসূ মানে তৈরি করবে না। 

পতাকা অবমাননা, কূটনৈতিক মিশনে হামলা, আবেগনির্ভর মন্তব্য চালাচালি, রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে দেয়া রাষ্ট্রীয় বিবৃতি এবং গণমাধ্যমের ক্রমাগত প্রোপাগান্ডা; কোনোকিছুই সম্পর্ক বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে না। কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে মনখুলে কথা বলবার পরিবেশ সৃষ্টি না করা গেলে তিক্ততা ও অগণন ঘৃণার ঘূর্ণাবর্ত থেকে কারোরই মুক্তি মিলবে না। 

আর নয় আধিপত্যবাদ, কূটচাল এবং স্বার্থকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র। সকল ঘটন-অঘটন পেছনে ফেলে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সমন্বিত স্বার্থেই মিত্রতা জরুরি। এই জরুরতটা বুঝতে হবে প্রথমত সরকারকে, অতঃপর জনগণকে। টানাপোড়েন জিইয়ে রেখে আমরা খুব বেশিদূর এগোতে পারব না। বাংলাদেশের দায় আছে, তবে বড় দেশ হিসেবে গুরুদায়িত্ব ভারতকেই নিতে হবে সবার আগে। 

লেখক: সাংবাদিক
৩ ডিসেম্বর ২০২৪
 

Comments

    Please login to post comment. Login