বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, বেতালপঞ্চবিংশতি সংস্কৃত ভাষায় রচিত একখানা গল্পগ্রন্থ। ১৮০৫ সালে 'বৈতাল পচ্চিসী' নামে এর একটি হিন্দি অনুবাদ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে প্রকাশিত হয়, যা ওই কলেজের পাঠ্য ছিল। পরে কলেজের অধ্যক্ষ জি.টি মার্শালের অনুরোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ সালে এটি বাংলায় অনুবাদ করেন।
মৃত রাজা চন্দ্রভানুর প্রেতাত্মার নাম বেতাল। তৎকর্তৃক কথিত পঁচিশটি উপাখ্যানের সমাহার হচ্ছে বেতালপঞ্চবিংশতি। বেতাল ঘটনাচক্রে রাজা বিক্রমাদিত্যের স্কন্ধে ভর করে তাঁকে গল্পগুলি পরপর শোনায়।
প্রাচীন ভারতের রাজ-পরিবারের ভোগ-বিলাস ও নৈতিক স্খলনের নানা চিত্র গল্পগুলিতে ফুটে উঠেছে।
ধারনা করা যায়, ভারতের বাংলাদেশ নীতি এখন পুরাই ওই বৈতাল পচ্চসী'র বেতালের দখলে। বেটা বেতাল সেখানকার রাজরাজড়াদের স্কন্ধে ভর করে যা খুশি তাই করিয়ে নিচ্ছে, যা খুশি তাই বলিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশে ভারতের পতাকা পদদলন করেছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। সারাদেশবাসী এর সাথে সংহতি প্রকাশ করেনি, করবেও না। আমরাও এর নিন্দা করেছি। প্রতিবাদ জানিয়েছি।
কিন্তু ভারত তো মশা মারতে কামান দাগানোর পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলছে। ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে ভারতে থাকা আমাদের হাইকমিশনে আক্রমণ করে বসেছে। যেখানে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা পোড়াচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারদাবার বন্ধ করবার হুমকি দেয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মতো নেত্রীও রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে খোদ নরেন্দ্র মোদির প্রতি আর্জি জানাচ্ছেন, যেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের তরফে শান্তিরক্ষী পাঠানো হয়!
বিশ্বশান্তি কিংবা আন্তঃদেশীয় মিত্রতা রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বড। ভারতের সেই গণমাধ্যমগুলো একজোট হয়ে প্রোপাগান্ডার মেশিনে রূপ পরিগ্রহ করেছে। বড়ত্বের এই আচরণ? তিলকে তাল বানিয়ে বিশ্বজুড়ে বাহ্বা পাওয়া যায়? বিশ্বমানুষের চোখকান খোলা নেই, এমন ভাবনা মোটেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।
বাংলাদেশের পতাকা ক্যাচালের আগে আপনারা নিজেদের টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা চ্যানেলের সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের যাত্রাপালার দিকে নজর দিন। এইতো কয়েকদিন আগে পুরো চট্টগ্রাম বেল্টকে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন, কৈ আপনারা তো 'রা'ও কাটলেন না। ও আচ্ছা বাংলাদেশ ভারতের ভোগে গেলেই আপনারা খুব খুশি?
একাত্তরে ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ মানুষের রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত। সেই বাংলাদেশ নিয়ে এমন বালখিল্যপূর্ণ চিন্তা কেন করবেন আপনারা?
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পতাকা অবমাননা করেছে। এটা অতি অবশ্যই সমালোচনাযোগ্য ও নিন্দনীয়। কিন্তু তার আগে আপনারা যে, দেশের পুরো মানচিত্রই অমান্য করলেন, তার বেলা?
বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুর ওপর বিচ্ছিন্নভাবে হামলা হচ্ছে। আওয়ামী রেজিমও হিন্দুদের সুরক্ষায় শতভাগ শুদ্ধ ছিল না। হামলা-নিপীড়ন তখনও ঘটেছে। কিন্তু ভারতের মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। তাদের মিডিয়ায় নিপীড়ন বন্ধের কোনো ন্যারেটিভ বা সাজেশন নেই, ভুলভ্রান্তি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই; থাকে শুধু উত্তেজনা আর উস্কানি। এসবের ফলাফল, জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসংখ্যানে রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। বিশ্বে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় ভারতের অবস্থান বরাবর শীর্ষেই থাকছে। অথচ ভারতীয় মেধাবীরাই বিশ্বের বৃহৎ টেক সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে।
সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র কারাবন্দী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী স্বামী বিবেকানন্দ, লোকনাথ ব্রহ্মচারী কিংবা শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু নন যে, তার জন্য পুরো ভারতপ্রশাসনকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এমনকি মিস্টার ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে তার সাবেক সংগঠন ইসকনও বেশকিছু অপরাধের অভিযোগ এনেছে। যার মধ্যে শিশু নিপীড়নের কথাও বলা হয়েছে। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে যেভাবে ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পর্যন্ত মাথা ঘামাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে কিছু তারা যেন রাখতেই চাইছে না। তাদের অনুধাবন করবার সময় এসেছে তাদের চিন্তায় একমাত্র মিত্র শেখ হাসিনা রেজিম এখন আর বাংলাদেশ সার্ভ করে না। গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন এক রেজিম দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সেই নতুনদের সাথে বনিবনা না হওয়াটা উভয়দেশের সম্মাজনক সুসম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলেই প্রতীয়মান হবে।
পৃথিবীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে কেউ আসেনি। আজকে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আছে, কাল তারা থাকবে এই গ্যারান্টি তো কেউ দিতে পারবে না। বাস্তবতা হলো সত্যটাকে সহজে মেনে নিতে হবে। সেটা না পারলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বোঝাপড়া'র শরণ নিতে হবে:
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে--
লেখক: সাংবাদিক
৪ ডিসেম্বর ২০২৪