শহরের কোলাহলে ডুবে থাকা মানুষগুলোর মাঝে এক নিঃসঙ্গ অস্তিত্ব, অনিক। সে কাজ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, হিসাবরক্ষণ বিভাগে। ছোট্ট এক ডেস্কে সারাদিনের হিসাবের খাতা ঘাঁটাঘাঁটি তার রোজকার কাজ। এ কাজ তাকে অর্থ দেয়, কিন্তু তৃপ্তি দেয় না। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে তার মাথায় ঘুরপাক খায়—কেন এ শহরে অন্যায় আর দুর্নীতি এতটা প্রবল? প্রতিদিন সংবাদের পাতা খুললেই দেখা যায় চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের খবর।
অনিকের জীবন যেন একটি নিস্তরঙ্গ নদীর মতো—ধীরগতির, নির্জন। তার বন্ধু নেই বললেই চলে। একসময় সে সমাজবিজ্ঞান পড়েছিল, কিন্তু বাবা-মায়ের অকালমৃত্যু তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি আত্মীয়দের লোভে টুকরো হয়ে যায়। এখন সে একা, শহরের এক কোণে ছোট্ট একটা বাসায় দিন কাটায়।
শহরের ব্যস্ত বিকেল। অফিস থেকে ফেরার পথে অনিক প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে চলে আসত "প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টার" এর সামনে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনিক সব সময় অপেক্ষা করত এই কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষিকাকে দেখার জন্য। মেয়েটি চঞ্চল, আত্মবিশ্বাসী—কিন্তু সহজ-সরল এক হাসি তার মুখে লেগেই থাকত। কিছুদিন তাকে দূর থেকে দেখে সাহস সঞ্চয় করল অনিক।
একদিন, দীর্ঘসময় ধরে লক্ষ্য করার পর, সাহস করে সে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। মেয়েটি কোচিং সেন্টারের গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় অনিক এগিয়ে যায়।
“আপনার নাম তৃণা, তাই না?”
তৃণা একটু থেমে তাকায়, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”
অনিক কিছুটা নার্ভাস হয়ে, গলায় এক টান দিয়ে বলল, "আমি অনিক। আপনাকে কিছুদিন ধরে এখানে দেখছি। নামও জানলাম। ভাবলাম, পরিচিত হয়ে নিই।"
তৃণা কৌতূহলী দৃষ্টিতে অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার সাথে? কেন?”
অনিক একটু হাসে, তারপর বলল, "আপনার আত্মবিশ্বাস আর সরলতা দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। সবসময় এত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও, আপনি হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলেন। আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হয়।"
তৃণা এবার চোখে চোখ রেখে কঠোর স্বরে বলে, "এই বয়সে কেউ এভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু মেয়ে দেখার জন্য জিনিসটা ব্যাক্তিত্বের সাথে যায়? আপনি কী করেন?"
অনিক তার কর্মক্ষেত্র সম্মন্ধে বলে।
তৃণা এবার হেসে বলে, “আপনি বেশ লক্ষ করেছেন আমাকে। কিন্তু এর মানে তো এটা নয় যে, এমনভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন।”
এই সহজ কথাবার্তায় তাদের পরিচয়ের শুরু। এরপর থেকে অনিক প্রায়ই তৃণার সাথে কথা বলার চেষ্টা করত। তৃণা অবশ্য তার প্রতি খুব একটা বিরূপ ছিল না। মাঝে মাঝে কাজ শেষে দু’জনের দেখা হয়ে যেত।
একদিন তৃণা হেসে বলে, “অনিক, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে তোমার সময়টা অন্য কাজে লাগাও। পৃথিবীতে অনেক কিছু করার আছে।”
অনিক হেসে উত্তর দেয়, “তুমি ঠিক বলেছো। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ব্যস্ত শহরে কেউ যদি একটু কথা বলে, সেটাই অনেক।”
এই কথাগুলো তৃণাকে স্পর্শ করেছিল। একদিন সে নিজেই অনিককে কফি খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। সেদিন থেকে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর হতে থাকে।
তবুও, অনিকের জীবনটা ছিল শূন্যতায় ভরা। দিন শেষে রাতগুলো তার কাছে এক ভিন্ন পৃথিবীর রূপ নিত। প্রতিদিন রাতের বেলা শহরের আঁধারে ডুবে যেত সে। রাত যত গভীর হতো, ততই তার মনে হত যেন শহরটা অন্যায়ের এক বিশাল প্রেক্ষাগৃহ।
অনিক চুপচাপ শহরের নির্জন রাস্তাগুলোতে হাঁটত। ফুটপাতে শুয়ে থাকা অভুক্ত মানুষগুলোকে দেখে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব হতো। কোনো এক চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলিতে হারিয়ে যেত সে। মাঝে মাঝে সে দুর্বৃত্তদের চাঁদাবাজি করতে দেখত, কিন্তু কিছুই করার সাহস পেত না।
রাতে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজেকে প্রশ্ন করত, “এত অন্যায়, এত অরাজকতা... কেউ কি এর প্রতিবাদ করবে না? নাকি সবাই চোখ বুজে থাকবে?” তার মনে হত, হয়তো তাকেই কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারত না।
একদিন সে দেখতে পায়, এলাকার এক দোকানদারকে কিছু দুর্বৃত্ত মারধর করছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে তার মনে হয়, এই শহরের মানুষগুলো কতটা অসহায়। এই দৃশ্য তার ভেতরে দাগ কাটে।
একদিন সাহস করে তৃণাকে ডিনারের প্রস্তাব দেয়। তৃণা রাজি হয়। অনিক তাকে নিয়ে যায় শহরের এক নির্জন, বদ্ধ রেস্টুরেন্টে। অন্ধকার ডিম লাইটের লাল-নীল আলোয় একজনের চেহারা আরেকজন দেখতে পারেনা। রেস্টুরেন্টের পরিবেশ তৃণাকে প্রথম থেকেই অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
“তুমি এমন জায়গা বেছে নিলে কেন?” তৃণা কৌতূহলী দৃষ্টিতে অনিকের দিকে তাকায়।
অনিক বলে, “এখানে আমরা নিরিবিলি কথা বলতে পারব। মনে হলো, আমাদের জন্য এটা উপযুক্ত।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ অনিক তৃণার মুখে একটি চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে। তৃণা দ্রুত হাত দিয়ে তার মুখ সরিয়ে নেয়।
“তুমি কী করছো, অনিক? তুমি কি আমাকে এমন মেয়ে মনে করেছ ?”
“আমি... আমি আসলে...” অনিক কিছু বলতে পারে না।
তৃণা হনহন করে বের হয়ে চলে যায়, আর অনিক তার পেছন পেছন তাকে থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
এরপর সে অনেক চেষ্টা করেছে, ফোন করেছে। কিন্তু তৃণা তার সাথে কথা বলেনি। তৃণার কোচিং এর পাশে ফুল নিয়ে দাঁড়ালে সেদিন এক ঘটনা ঘটে। তৃণা তাকে দেখে কোচিং থেকে বের হতে চায় না। অনিক সেখানে ঢুকে হট্টগোল শুরু করলে কোচিং এর লোকজন তাকে জোর করে বের করে দেয়। বলে আরেকবার আশেপাশে দেখলে পুলিশ ডাকবে।
তৃণার চলে যাওয়ার পর অনিকের জীবন আরও শূন্য হয়ে পড়ে। তার রাতের হাঁটা যেন আরও দীর্ঘ হতে থাকে। সমাজের অন্যায় আর দুর্নীতির ভার যেন তাকে পিষে ফেলে।
সে ভাবে, এই শহরের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তার মনে হয়, সে নিজেই হয়তো হতে পারে এই শহরের ত্রাণকর্তা।
অনিকের রাতের জীবন এক অদ্ভুত মোড় নিতে শুরু করে। দিনগুলো অফিসের হিসাব-নিকাশে ডুবে থাকলেও রাতের বেলা সে হয়ে উঠত এক রহস্যময় প্রতিরোধের প্রতীক। শহরের অন্ধকার পথে যখন ছিনতাইকারী বা অপরাধীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত, তখন সেই অন্ধকারে এক ছায়ামানুষের অস্তিত্ব টের পেত তারা।
রাতের গভীরে লুকিয়ে থাকা ছিনতাইকারীদের দল একের পর এক নিখোঁজ হতে শুরু করে। শহরের খবরের কাগজে অজানা একজন প্রতিরোধকারীর কথা শোনা যায়, যে অপরাধীদের নির্মমভাবে শেষ করে যাচ্ছে। কেউ জানে না সে কে। শুধু জানা যায়, শহরের অপরাধীরা তাকে ভয় পেতে শুরু করেছে।
এক রাতে, একটি ব্যস্ত ফুটওভার ব্রিজের নিচে, এক তরুণীকে ছিনতাইকারী দল ঘিরে ধরে। অনিক ছায়ার মতো হাজির হয় সেখানে। হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে একে একে সবাইকে কাবু করে। তাদের রক্তমাখা দেহ রাস্তায় পড়ে থাকে। তরুণী ভয়ে কাঁপতে থাকে, কিন্তু অনিক কোনো কথা না বলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ধীরে ধীরে এই শহরের গল্পে “রাতের প্রতিরোধ” নামে এক কিংবদন্তি তৈরি হয়। মানুষ বুঝতে পারে, একজন অচেনা ব্যক্তি অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু কেউ জানে না তার আসল পরিচয়।
শহরের এক কুখ্যাত ডন কুমির নাজিম, যে অপহরণ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে, তার জলাশয়ে ছিল শতশত কুমির। জীবন্ত মানুষকে কুমির কে খাওয়াতো তার কথা মত কাজ না হলে। তাকে টার্গেট করে অনিক। সেদিন রাতে ক্লাব থেকে ফূর্তিবাজি করে বের হওয়ার সময় তার ড্রাইভারকে ছুরি ধরে আগেই জিম্মি করে রাখে। তারপর নাজিম গাড়িতে উঠতেই তার বডিগার্ডদের ফেলে রেখে গাড়ি টান দেয় অনিক। ড্রাইভ করে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে নাজিমকে তার অপরাধের জন্য দায় স্বীকার করায় এবং একটি ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। ভিডিওটি দ্রুত ভাইরাল হয়।
এরপরই শুরু হয় পুলিশের খোঁজ। তারা জানতে পারে, এই ছায়ামানুষটি এক জটিল চরিত্রের অস্তিত্ব। ডনের মুক্তির জন্য তার সাঙ্গোপাঙ্গরা অনিকের পেছনে লেগে যায়। কিন্তু অনিক নিঃসঙ্গ যোদ্ধা হিসেবে নিজের যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
এক অপহরণের শিকার ব্যবসায়ীকে বাঁচানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অনিক। তার পরিচয় উদ্ঘাটন হলে শহরের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা বলে, “এই মানুষ আমাদের রক্ষাকর্তা। তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে?”
অনিকের কাজের জন্য সেই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহ মো: আমিন চৌধুরী, যাকে সে একবার অপহরণ থেকে বাঁচিয়েছিল, তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। এই মানুষটি অনিকের জন্য কৃতজ্ঞ। তিনি জানান, “এই শহরের জন্য সে যা করেছে, সেটা কেউ করতে পারেনি।”
জামিনের পর অনিক মুক্ত হলেও তার জীবনে আর কিছুই স্বাভাবিক থাকে না। পত্রিকাগুলোর শিরোনামে এখন তার নাম। মানুষ তাকে হিরো মনে করে। কিন্তু তার নিজের মনে এক গভীর নিঃসঙ্গতা কাজ করে।
একদিন ফুটওভার ব্রিজ পার হতে গিয়ে তৃণার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। অনেক বছর পর মুখোমুখি হয় তারা। তৃণা প্রথমে থমকে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “তোমার কথা পত্রিকায় পড়েলাম। জানলাম, অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছ।”
অনিক বলে, “পত্রিকায় একটু বাড়িয়েই বলেছে, আমি সামনে ঘটছে এমন অন্যায়কে প্রতিরোধ করব না!”
“না, যা পড়লাম সব অন্যায় কি তোমার সামনে ঘটেছিলো কিনা। সমাজে আইন আছে, পুলিশ আছে! সে যাক গে”-এই বলে তৃণা আর কথা বাড়ালো না। কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই সে বলছিল, কোন আবেগের ছাপ ছিলনা।
অনিক কিছু বলতে পারে না। শুধু তৃণার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তৃণা একপাশে সরে যায়। বিদায় না জানিয়ে হেঁটে চলে যায় অন্যপথে। অনিক তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর নিজের পথে হাঁটতে শুরু করে।
অনিক আবারও রাতের পথে হাঁটতে শুরু করে। অন্ধকার রাস্তা, নিঃসঙ্গ বাতিগুলো তার সঙ্গী হয়। শহরের অন্যায় হয়তো সে পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি, কিন্তু সে জানে, রাতের অন্ধকারে কেউ তাকে অনুভব করবে—একজন ছায়ামানুষ, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
============================================
(সমাপ্ত)