Posts

গল্প

ছিন্ন অঙ্ক

December 6, 2024

মোঃ আশিকুর রহমান

সুনান রহমান, এক কিশোর, তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। গত এক বছরে, তার জীবন যেন ক্রমাগত এক অদৃশ্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছিল। তার পিতা,আরিফুর রহমান একজন প্রখ্যাত জাদুকর,  রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছিলেন। পুলিশ তদন্ত করলেও কিছুই স্পষ্টভাবে বের করতে পারেনি। সুনান জানতো, তার পিতার মৃত্যু কোন সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, কিন্তু তা কি ছিল? সে এক রহস্যের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে, সুনান নিজেই তার পিতার মৃত্যুর তদন্ত শুরু করে, কিন্তু তার পথ ছিল অন্ধকার এবং বিপজ্জনক। একদিন, সে একটি পুরনো ক্যাসেট টেপ পায়, যেটি তার পিতার ড্রয়ারে লুকানো ছিল। ক্যাসেটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এতে তার পিতার জীবনের শেষ কিছু মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু, ক্যাসেটটি খোলার পর সে বুঝতে পারে, এটি তার পিতার শেষ সময়ের কোনো প্রমাণ নয়—এটি ছিল একটি ভিন্ন দৃশ্য, যেখানে তার পিতা এক অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে শেষবার কথা বলছিল। আর অবাক হওয়ার বিষয় হলো, সেই অপরিচিত ব্যক্তির নাম ছিল "মাহমুদ"—একজন রহস্যময় লোক, যাকে সুনান কখনো দেখেনি।

সুনান পিতার মৃত্যু সম্পর্কে আরো কিছু খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে, মাহমুদও একজন বিখ্যাত জাদুকর ছিল—সে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সবচেয়ে গোপনীয় তথ্য চুরি করে এবং তা বিক্রি করতো। তার মধ্যে এক বিশেষ ক্ষমতা ছিল—সে মানুষের স্মৃতি বদলাতে পারতো, তাদের মস্তিষ্কের কোষে এক নতুন তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারতো। তার কাজ ছিল, স্মৃতি বিকৃত করা, ভুল তথ্য তৈরী করা, আর কখনো কখনো মানুষের কাছে তাদের আসল সত্যকে অস্বীকার করিয়ে দেয়া।


একদিন, সে জেগে উঠে দেখে যে তার কাছে নতুন কিছু স্মৃতি আছে—মাহমুদ নামক এই লোকের সাথে তার পিতার গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কিভাবে এই স্মৃতিগুলি তার মধ্যে ঢুকলো? সে তো মাহমুদকে কখনো দেখেনি! তার চোখে তখন এক ভয়াবহ দৃষ্টির অবস্থা, তার চারপাশের সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে যায়। এক মুহূর্তে, সে ভাবতে থাকে, "এটা কি সত্যি? নাকি আমি ভুল কিছু মনে করছি?

সুনান বুঝতে পারে মাহমুদকে খুঁজে বের করলেই এই রহস্যের জট খুলবে। সে পথে পথে ঘুরে, এক সময় একটি পুরনো বাড়িতে পৌঁছায়। সেখানে তাকে কোনো নির্দিষ্ট লোক না পাওয়ার পর, সে লক্ষ্য করে যে বাড়িটি তার পিতার পুরনো স্টুডিও, যেখানে তার পিতা কাজ করতেন। সেখানে গিয়ে সে আরেকটি সিক্রেট ডায়েরি খুঁজে পায়। ডায়েরিতে লেখা ছিল, "সবকিছুই ভ্রম। একমাত্র সত্য হলো, তোমার নিজস্ব মন।"


সুনানের মনে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে—সে যেন নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। সে ধীরে ধীরে অনুভব করে যে, সব কিছুই যেন এক জাল—তার পিতা, মাহমুদ, সেই ক্যাসেট টেপ, সবই যেন মিথ্যা। কিন্তু তারপরও, সুনান ভাবতে থাকে, "আচ্ছা, আমার কি এখানে কিছু করার ছিল না? আমি কি এটা ঠিক বুঝতে পারলাম?"
সুনান সেদিন ওয়াশরুমের ভ্যান্টিলেটরের খালি জায়গায় ভাঁজ করা একটা কাগজ পেল। যেখানের লেখা পড়ে সে জানতে পারে, মাহমুদ একটি গোপন সংস্থার সদস্য—যারা মানুষের স্মৃতি ও মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সংস্থাটি মানুষের মস্তিষ্কে প্রবাহিত তথ্য পরিবর্তন করার বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা তার পিতার মৃত্যু ও তার নিজের বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা হতে পারে।


তবে সুনান যখন ওই সংস্থার সম্পর্কে আরো খোঁজ নেয়, তখন সে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পারে—সংস্থাটি কোনো সাধারণ সংস্থা নয়, বরং এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি এমন এক গোপন প্রকল্পের অংশ, যা মানুষের স্মৃতি ও বাস্তবতা বদলে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। সে জানতে পারে, তার পিতা আরিফুর রহমান এই প্রকল্পের অংশ ছিলেন, এবং সেই প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে আরিফ ভুলবশত এমন কিছু দেখেছিলেন, যার জন্য মাহমুদ তাকে হত্যা করে।
সুনানের চোখ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করলো। চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট, কিন্তু একটা ঘোলাটে আলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সে নিজেকে একটা ছোট ঘরে দেখতে পেল। তার চারপাশে কিছু যন্ত্রপাতি, ডায়েরি, আর পিতার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার মনে হতে লাগল যেন কিছু একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে, কিন্তু কী ছিল তা পরিষ্কার নয়। তার হাত-পা বাঁধা। ধীরে ধীরে তার বুঝতে বাকি রইলোনা যে, সে মাহমুদের ওই সংস্থার গবেষণাগারে আছে, এবং সবই তার ষড়যন্ত্রের অংশ। একজন মধ্য বয়সী লোক সুনানের দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটাকে দেখে সুনানের যেন রক্ত সেদ্ধ হতে শুরু করলো। এই তো সেই মাহমুদ! তার বাবার খুনী!


মাহমুদের চেহারা শান্ত, কিন্তু তার চোখের ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে কোনো গভীর ব্যথা। সে সুনানের সামনে একটি ছবি ধরে। ছবিটিতে সুনানের বাবা আরিফ এবং আরেকটি ছোট ছেলে দেখা যায়। 
সুনান ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, "এটা আমার বাবা, আর আমি।" 
মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে, "তুমি কি নিশ্চিত?" 
সুনান বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সে ভাবে, এটা কেমন প্রশ্ন? 
মাহমুদ তাকে আয়না দেখায়, সুনান নিজেকে দেখে আঁতকে উঠে। বিশ্বাসই করতে পারেনা নিজের চোখকে!
“আমি বিশ্বাস করিনা মাহমুদ। আমি জানি তুমি আমার ব্রেইনকে কন্ট্রোল করছ। ঘটনাগুলো তোমারই সৃষ্টি। আমি জানি আমার বাবার মৃত্যুর পেছনে তুমিই দায়ী!“
মাহমুদ শান্ত গলায় বললেন, "তুমি আরিফুর রহমানের পুত্র নও, বরং তুমি নিজেই আরিফ। তোমার মন এক বিভ্রান্ত জগত তৈরি করেছে, যেখানে তুমি নিজের কল্পনায় পুত্র সুনানকে জীবিত রেখেছ।"
সুনান উত্তেজিত হয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়তে চায় তবে তা বাঁধাছিল।


ডাক্তার স্নিগ্ধা আজ হাসপাতালে নতুন জয়েন করেছেন। মাহমুদ তাকে সুনানের ফাইল হাতে দিলেন যার উপর লেখা ছিল: মো: আরিফুর রহমান, বয়স: ৪২ বছর, আইডি ২০০১০১২১৫. তারপর  মাহমুদ, যিনি আসলে ডাক্তার মাহমুদুর রশিদ, ডাক্তার স্নিগ্ধাকে সুনানের কেইস বোঝাতে শুরু করলেন:


লোকটা আসলে সুনান নয়, বরং মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, যিনি এক সময় খুব নাম করা লেখক ছিলেন। তার ছোট ভাই শফিকুর রহমান গত সপ্তাহে তাকে নিয়ে এসে ছিলেন। আরিফের রোগের নামটা হলো, Dissociative Identity Disorder (DID)। এ ধরণের রোগে সাধারণত রোগিরা প্রাথমিক ভাবে নিজেকে ভিন্ন পরিচয়ে উপস্থাপন, কাল্পনিক চরিত্রের উপস্থিতি অনুভব, অতীতের ঘটনা ভুলভাবে মনে করা, অপরাধবোধ এবং নিজেকে শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা।
আরিফ সবসময় বাইক চালানোর সময় গতি পছন্দ করত। তার এই দ্রুতগতির অভ্যাস নিয়ে তার স্ত্রী মাইশা প্রায়ই তাকে সতর্ক করতেন। 


সেদিন সন্ধ্যায় আরিফ বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল তার ১৪ বছর বয়সী কিশোর পুত্র সুনান রহমান। পিতা-পুত্রের আনন্দময় সময় কাটানোর জন্য তারা শহরের বাইরে খোলা রাস্তায় গিয়েছিল। কিন্তু একসময় আরিফের বাইক একটি বাসকে অতিক্রম করার সময়  হঠাৎ উলটো দিক থেকে আসা আরেকটা বাস দেখতে পায়। সেটা থেকে বাঁচতে সে দ্রুত পাশের বাসের সামনে গিয়ে  একটি বাঁক নেওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক দিকে হেলে যায়। আরিফ তৎক্ষণাৎ টান দিয়ে বাইককে সামলে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই আকস্মিক ঝাঁকুনিতে পেছনে বসা সুনান ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। আরিফ মুহূর্তেই বুঝতে পারেনি কী ঘটে গেছে। যখন পেছনে তাকিয়ে দেখল সুনান পড়ে গেছে, তখনই একটি দ্রুতগতির বাস এসে তাকে আঘাত করে। সুনানের ছোট্ট দেহটি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকে।


সুনানের মৃত্যু আরিফকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তার মনে হয়, এই দুর্ঘটনার জন্য সেই দায়ী। নিজের অসাবধানতার জন্য সুনানকে হারানোর বোঝা তার মনকে গ্রাস করতে শুরু করে। ক্ষোভে অভিমানে মাইশাও তাকে ছেড়ে চলে যায়।  এ ঘটনা থেকে পালিয়ে থাকতে আরিফ এক সময় নিজের মনেই বিকৃত স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে, যা তাকে এক অন্যজগতে নিয়ে যায়। আরিফ নিজেকে তার কিশোর পুত্র সুনান ভাবতে শুরু করে। অত:পর আরিফের ভেতরে ২ রকম চরিত্র বসবাস করতে লাগল, একটা আরিফ নিজেই এবং অন্যজন তার পুত্র সুনান। তদুপরি, একটা লোককে শত্রু হিসেবে দাঁড় করায় সেটা হলো মাহমুদ (প্রকৃতপক্ষে ডাক্তার মাহমুদুর  রশিদ)। 


আরিফ, তার নিজের চরিত্রে জানত আসল সত্যিটা—সে-ই তার পুত্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু এই কঠিন সত্য মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সে নিজের মনেই বিকৃত ধারণা তৈরি করে, যা তার 'সুনান' চরিত্রকে বিভ্রান্ত করে রাখত। ডায়েরির পাতা থেকে শুরু করে ওয়াশরুমের ভ্যান্টিলেটরে লুকানো কাগজ, এমনকি পুরনো ক্যাসেট—সবই আরিফের কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টি যার সবই ছিল তার নিজের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল।
-------------------------------------------------------------
(সমাপ্ত)

Comments

    Please login to post comment. Login