দ্বিতীয় ক্রুসেড (১১৪৪-১১৪৯ খৃষ্টাব্দ)
তুর্কি সেলজুকদের যুগ ছিল মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির গৌরবময় শেষ অধ্যায়।সেলজুকদের অনৈক্যের পরিস্থিতিতে ইমাদুদ্দীন জঙ্গীর মতো একজন মহান শাসকের আবির্ভাব ঘটে। সেলজুক সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ১১২৭ সালে ইমাদুদ্দীন জঙ্গীকে মসুলের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি জঙ্গী বংশের শাসনের গোড়াপত্তন করেন। তিনি হালাব, হারবান এলাকা জয় করে নিজ রাজ্যের সীমানাভূক্ত করেন। ইমাদুদ্দীন ইথারব দুর্গ ও মিসরের সীমান্ত এলাকা থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করেন। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ক্রুসেডারদের পরাজিত করে দামেস্ক সহ সিরিয়ার বৃস্তীর্ণ এলাকায় মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন যা তার সব থেকে বড় কৃতিত্ব। তিনি যে সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ক্রুসেডারদের প্রতিহত করেন, তা ইসলামের ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায় হয়ে আছে।
১১৪৬ সালে ইমামুদ্দিনের মৃত্যুর পর মসুলে তার স্থলাভিষিক্ত হন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুদ্দিন জঙ্গি এবং আলেপ্পোতে তার দ্বিতীয় পুত্র নূরদ্দীন জঙ্গী স্থলাভিষিক্ত হন। নূরুদ্দীন জঙ্গীকে দ্বিতীয় ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি বিবেচনা করা হয়। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিরত্বের সাথে একের পর এক যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করতে থাকেন। মিসর জয়ের পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এক করা ও বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরায় মুসলমানদের হস্তগত করাই নুরুদ্দিনের স্বপ্ন ছিল যা অর্জনের জন্য আজীবন তিনি লড়াই করে গেছেন। ফোরাত ও নীল নদের মধ্যবর্তী সব মুসলমানকে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালান নুরুদ্দিন জঙ্গি। ইতোমধ্যে রাওহা শহরটিকে তিনি মুসলমানদের দখলে আনতে সক্ষম হন। এরপর ক্রুসেডারদের থেকে তিনি এডেসা বন্দর দখল করে নেন। এডেসা পতনের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট শুরু হয়।
ক্রুসেডারদের পরাজয়ের খবর সারা ইউরোপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে পোপ তৃতীয় ইউজিন দ্বিতীয় ক্রুসেডের ঘোষণা দেন। ফ্রান্সের শাসক সপ্তম লুই এবং জার্মানির রাজা তৃতীয় কনরাডের নেতৃত্বে নয় লাখ সৈন্যের বিশাল ক্রুসেডার বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইউরোপ থেকে রওনা হয়। এই বাহিনীতে নারীরাও ছিল। প্রথম ক্রুসেডের মতো খৃষ্টানদের সম্মিলিত এই বাহিনীর সৈন্যরাও স্থানীয় মুসলমানদের সাথে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করে। কিন্তু সপ্তম লুইয়ের বাহিনীর একটি বড় অংশ সালজুকদের হাতে ধ্বংস হয়। তারা যখন আন্তাকিয়ায় পৌছে তখন তাদের তিন-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। রাজা লুই এবং রাজা কনরাডের অবশিষ্ট সম্মিলিত বাহিনী ১১৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমে পৌছায়। তারা অগ্রসর হয়ে দামেস্ক অবরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সাইফুদ্দীন জঙ্গী ও নূরুদ্দীন জঙ্গীর সম্মিলিত বাহিনীর প্রচেষ্টায় ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়। সপ্তম লুই ও কনরাডের বাহিনীকে আবার ইউরোপের সীমান্তের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেডের চিন্তা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। ১১৪৯ সালে সাইফুদ্দীন জঙ্গী মারা গেলে ইমামুদ্দিন জঙ্গীর তৃতীয় পুত্র কুতুবুদ্দিন মওদুদ মসুলে স্থলাভিষিক্ত হন।
ক্রুসেডের রাজনৈতিক কারণ
মক্কা বিজয়ের পর থেকে বিশ্বব্যাপী ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। রাসুল (সা) এর মৃত্যুর পর চারজন খলিফার প্রত্যেকেই ইসলামি সম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। চার খলিফার মৃত্যুর পরেও সম্রাজ্য বিস্তারের এই ধারা বিভিন্ন বংশধরভিত্তিক খলিফাদের হাত ধরে অব্যাহত থাকে। আফ্রিকা, এশিয়া, আলজিরিয়া, ভূমধ্য সাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রসমুহ সাইপ্রাস, সিসিলি, আইবেরীয় উপদ্বীপ(স্পেন-পুর্তগাল) ইত্যাদি মুসলিম শাসনের অধীনে চলে আসে। এভাবে সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ইসলামী বিশ্বে তখন ঐক্যের অভাব দেখা দেয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফত(৭৫০-১২৫৮খ্রী.), মিসরের ফাতেমী খেলাফত(৯০৯-১১৭১খ্রী.), তুর্কি সেলজুক শাসকগোষ্ঠী(১০৩৭-১১৯৪ খ্রী.) কিংবা স্পেনের মুসলিম শাসকগোষ্ঠী(৭১১-১৪৯২ খ্রী.) কারও মধ্যে ঐক্যের কোন পরিস্থিতি ছিল না। যখন সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি কমে আসে তখন খৃস্টানরা তাদের পূর্ব পুরুষের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুজতে থাকে।
আগেই বলা হয়েছে মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির গৌরবময় শেষ অধ্যায় ছিলো তুর্কি সেলজুকদের যুগ। বাইজেন্টাইন শাসক মাইকেল ডোকাস সে কারনে সেলজুকদের শক্তিতে ভীত হয়ে তুর্কিদের সম্ভাব্য অগ্রগতি প্রতিহত করতে ১০৯০ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর কাছে সাহায্য চান। পুরো খৃষ্ট জগৎ তার আহবানে তৎক্ষণাত সাড়া দেয়। এভাবে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে প্রাচ্যের বাইজেন্টাইন গীর্জা ও পাশ্চাত্যের গীর্জার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা হয়ে যায় এবং উভয় গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড যুদ্ধে অংশ নেয়।
ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ
ইউরোপ থেকে যারা তীর্থযাত্রী হিসেবে জেরুজালেম নগরীতে আসতেন তারা দেশে ফিরে ইসলামী বিশ্বের প্রাচুর্যের গল্প শোনাতেন সবাইকে। ইউরোপীয়রা উপলব্ধি করতো যে প্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলো যা অর্জন করতে পেরেছে তা ইউরোপের দেশগুলো পারেনি। ইউরোপের ধর্মান্ধ কুচক্রী মহলগুলো সম্পদ অর্জনের উপায় হিসেবে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য ধর্মযুদ্ধের নামে এই অনৈতিক অভিযানে অংশ নেয়। তাছাড়া অপকর্মের কারনে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী যারা বঞ্চিত হতো, তাদের একটা গোষ্ঠী সম্পদ অর্জনের জন্য এই ধর্মীয় উন্মাদনা উষ্কে দেয়। ধর্মের অজুহাতে তাদের লক্ষ ছিল লুটপাট করে ধনসম্পদ অর্জন করা।
আরেকটা কারন হলো মধ্যযুগে ইউরোপের সরকার ব্যবস্থা ছিলো সামন্ততান্ত্রিক। সামন্ত প্রথার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কৃষকদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। অর্থের সমস্ত উৎস গীর্জার যাজক ও জমিদারদের আয়ত্তে ছিল। জনসাধারণের দুর্দশার কমতি ছিলোনা। তাই শাসক ও গীর্জার যাজকরা ধর্মকে ব্যাবহার করে জনগণের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রোধ করার চেষ্টা চালায়।তাছাড়া রোমানরা চাচ্ছিলো ফিলিস্তিন ও সিরিয়া দখল করে আগের মতো নিজেদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক উন্নতি সাধন করতে। কারন মুসলিম আধিপত্বের কারণে রোমান সম্রাজ্যের একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল।