(প্রাক-গল্প: #অন্তরালের ডাকে)
===================
অনিকের জীবন যেন এক মায়াজাল। অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চিত যাত্রা তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। পাঁচ-ছয় বছর আগের সেই ঘটনা তার জীবন থেকে দূর হয়ে গেলেও, মনের এক কোণে আটকে ছিল। তৃণার সাথে তার শেষ দেখা ফুটওভার ব্রিজে। বিদায় জানায়নি তৃণা, কিছু না বলেই চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি। তবে তৃণার স্মৃতি যেন এক অদৃশ্য ছায়ার মতো তাকে ঘিরে থাকে।
সময় বদলেছে, অনিকের জীবনও বদলেছে। আজ তার অনেক সম্পদ আছে, সাফল্য আছে। স্ত্রীর নাম সীমানা—সেই ব্যবসায়ী শাহ আমিন চৌধুরীর মেয়ে যে ব্যবসায়ীকে অনিক অপহরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। পরে অনিকের গ্রেফতারের পর সেই ব্যবসায়ীই তাকে জামিন করিয়েছিলেন। অনিক যখন একাকীত্বের যন্ত্রণা ভুলতে জীবনের পিছুটান ছেড়ে আইন হাতে নিয়ে নিজেকে সমাজের ত্রাণকর্তা বানিয়ে অভিযাত্রিক হয়ে উঠেছিল তখন শাহ আমিন চৌধুরী তার মেয়েকে অনিকের হাতে তুলে দিয়ে তার জীবনের শূন্যতা দূর করার চেষ্টা করেন। তাকে বিষয় সম্পত্তি দান করেন। তবে সীমানা এমন একটি মেয়ে, যার ভাষা নেই, কানেও শোনে না। তবুও সীমানার সঙ্গেই তার জীবন, এক অদ্ভুত অনুভূতির মাঝে বাঁধা। সীমানা বোবা, কিন্তু তার চোখ, তার অনুভূতি সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনিক তার প্রতি কোনো ধরনের দয়া বা করুণার অনুভূতি পোষণ করে না, বরং সে এক অদ্ভুত ভালোবাসার মাঝে আবদ্ধ। তবে কোথাও কোথাও মনে হয়, সীমানার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অভাব রয়েছে, যে শূন্যতা অনিক কখনো তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেনি।
তৃণার স্মৃতির শুরুটা হয় প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টারে। তখন অনিক ছিল একরোখা, বেপরোয়া, নিজের পৃথিবীতে মগ্ন। তৃণার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব তাকে আকর্ষণ করেছিল। একদিন কাশেম নামে এক দারোয়ানকে টাকা দিয়ে সে তৃণার সম্পর্কে সব তথ্য জেনে নিয়েছিল—নাম, ক্লাসের সময়সূচি, সব কিছু। তবে, রেস্তোরাঁয় যে ঘটনা ঘটেছিল, তা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
এক সন্ধ্যায় তৃণাকে সে রেস্তোরাঁয় ডেকেছিল। তৃণাকে ভালোবাসত অনিক, তবে সেটি প্রকাশ করার সঠিক উপায় জানত না। কথায় কথায় তার হাত ধরেছিল। তৃণার চোখে ভয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সে সরে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অনিক তাকে থামিয়ে বলেছিল, "তৃণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি বুঝতে পারো না?"
তৃণার গলার স্বর কাঁপছিল, "তুমি আমাকে এমন ভাবছো? বিশ্বাস করেছিলাম, সেটাই আমার ভুল।" তৃণার প্রতিক্রিয়ায় অনিকের মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তৃণাকে কাছে টেনে চুমু খেতে চেষ্টা করেছিল। তৃণা চিৎকার করে উঠেছিল, নিজের হাত ছিনিয়ে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রেস্তোরাঁর দরজার দিকে হাঁটা দিতেই অনিক তার পেছন পেছন দৌঁড়ে গিয়ে চিৎকার করেছিল, "তৃণা, থামো! আমি দুঃখিত!"
তৃণা আর একটিও কথা না বলে বেরিয়ে যায়, অনিককে একবারও তাকিয়ে না দেখে। তৃণার কাছ থেকে এমন সাড়া পাওয়ার পর, সে বুঝতে পারে তার অনুভূতির বাস্তবতা।
পড়ে একাধিক ফোন কল, তৃণার কোচিং এ ফুল নিয়ে গিয়ে সে বেরোতে না চাওয়ায় সেখানে হট্টগোল করা। সেখানে কোচিং এর লোকজনের ধাক্কা খেয়ে বের হয়ে যাওয়া সব অনুভূতি তার মধ্যে আজও অমলিন।
অনিকের এমন আচরণ ছিল তার জীবনের এক কঠিন অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ। ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো, একাকিত্ব, আর তার ভিতরের শূন্যতা তাকে অনুভূতির ব্যাপারে অজ্ঞান করে রেখেছিল। শৈশব থেকে বন্ধুবান্ধবের অভাব তাকে আবেগ প্রকাশের সঠিক পথ শিখতে দেয়নি। তৃণার প্রতি তার অনুভূতি ছিল গভীর, তবে সে কখনোই সেগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করতে জানতো না। তার ভালোবাসার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সে সেটা সঠিকভাবে বোঝাতে পারছিল না। তৃণাকে ভালোবাসা তার কাছে এমন এক অনুভূতি ছিল, যা এক ধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মতো লাগছিল, তবে সে ভুলে গিয়েছিল, ভালোবাসা কখনোই জোর-জবরদস্তি নয়, বরং এটি সম্মান, বোঝাপড়া এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সেই অনভিজ্ঞতা ও একাকিত্বের কারণে, সে তৃণার প্রতি এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিল, যা তাকে তৃণার কাছে হতাশা এবং ভয়ের সৃষ্টি করেছিল।
পাঁচ-ছয় বছর পরেও তৃণার স্মৃতি অনিককে তাড়া করে। সে জানত, তৃণাকে আর কখনো পাবে না, তবুও এক অদ্ভুত টান তাকে বাধ্য করল খুঁজতে। প্রথমে সে প্রজ্ঞা কোচিংয়ের ঠিকানায় গেল, কিন্তু সেখানে এখন শপিং মল গড়ে উঠেছে। ফেসবুকে একে একে তৃণার নাম দিয়ে খুঁজতে লাগল—"Tasfiya Tarannum Trina, Tarannum Trina, Tasfia Trina" এমনকি বাংলায় লিখেও খুঁজেছিল। মেলেনি।
তারপর সে গেল সেই বাসায়, যেখানে তৃণা একসময় ভাড়া থাকত। আশপাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করল, তবে কেউ তৃণার কথা জানত না। তাদের কাছে ছিল অবাক করা প্রশ্ন—"কীভাবে এত বছর পরে একজন মানুষকে খুঁজছে?" তবে, এক অদৃশ্য জোরালো অনুভূতির তাড়া অনিককে ছাড়ছিল না।
এদিকে, সীমানা, অনিকের স্ত্রীর ভেতর ছিল এক অদ্ভুত শান্তি। সীমানা বোবা এবং শ্রবণশক্তিহীন হলেও, তার চোখের ভাষা স্পষ্ট ছিল। সে অনিকের প্রতিটি অনুভূতি বুঝতে পারত। এক রাতে, যখন অনিক তার মনের গহীনে তৃণাকে খুঁজতে চলে, সীমানা তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি সত্যিই তাকে খুঁজছো?"
অনিক হালকা হেসে বলল, "জানি না। হয়তো না। তবে, মনে হয় আমার নিজের ভেতরে কিছু একটা খুঁজছি। জানি না কী।"
সীমানা সব বুঝতে পারত। সে জানত, তার স্বামী কিছু হারিয়েছে, যা সে আর কখনো ফিরে পাবে না। তবুও সীমানা কখনো তাকে ছেড়ে যায়নি, তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে, নিরব ভালোবাসা দিয়ে। অনিকের প্রতি তার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা অগাধ ছিল।
তৃণার সঙ্গে অনিকের শেষ দেখা হয় একদিন। সে স্কুলে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন এক অভিভাবক তার মেয়েকে নিতে এসেছিল। ভিড়ের মধ্যে এক পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে অনিকের শ্বাস আটকে গিয়েছিল—তৃণা। তৃণা তখন তার মেয়েকে নিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন, সে অনিককে একবার তাকিয়েছিল। কিন্তু অনিকের দিকে তাকিয়েই তৃণা এক ঝলক পিছু হটে, দ্রুত মেয়েটির হাত ধরে চলে যায়। অনিক কিছু বলার সাহস পাননি, শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন।
বাড়ি ফিরে এসে, তার মনের মধ্যে নানা অনুভূতির স্রোত বয়ে যেতে লাগল। সে জানত, তৃণাকে খুঁজে বের করার চেয়ে নিজের ভেতরের শূন্যতাকে পূর্ণ করা বেশি জরুরি। তৃণা তার জীবনে এসেছিল, কিন্তু থাকার জন্য নয়। সীমানা তখন ঘরে বসে সেলাই করছিল। অনিক তার পাশে গিয়ে বসে। সীমানা ইশারায় জানতে চেয়েছিল, "তুমি কি শান্তি পেয়েছো?"
অনিক মৃদু স্বরে বলল, "শান্তি পেয়েছি কি না জানি না, তবে আমি বুঝতে পেরেছি, তৃণাকে খুঁজে আমার কোনো লাভ নেই। তৃণা ছিল আমার জীবনে শিখানোর জন্য, তবে সে আর কখনো ফিরে আসবে না।"
সীমানা তার হাত শক্ত করে ধরে রইল। তার নিরব ভালোবাসা অনিকের জীবনে নতুন দিশা দেখিয়ে দিল। অনিক জানে, কিছু মানুষ জীবনে আসে না থাকার জন্য, আসে শিখানোর জন্য। তৃণাকে সে কোনো অভিযোগ ছাড়াই বিদায় জানায়, তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় সীমানার সঙ্গে।
এভাবেই, তৃণার স্মৃতি অনিকের জীবনে এক সুন্দর অধ্যায় হয়ে থেকে যায়, যা তাকে জীবনের গভীরতর সত্য শেখায়। তার কাছে এখন সীমানা আছে, যার নিরব ভালোবাসা তাকে সবসময় আশ্রয় দেয়।
==============================
(সমাপ্ত)