যাত্রাটা শুরু হয়েছিল চৈত্রের মধ্য দুপুরে। তীব্র আলোয় পুরো পথটা কোন ক্রোধান্ধ মানুষের চোখের মণির মতো অন্তহীন আর রুক্ষ মনে হচ্ছিলো। আমার সহযাত্রীরা ছিল নির্বিকার। তবুও হয়তো আমার কথা ভেবেই তারা কপালের উপর হাত রেখে চোখে ছায়া টানলেন। পুরো ব্যাপারটা যদিও দেখতে আত্মভূক সরীসৃপের মতোই হাস্যকর, তবু কেউ সে হাসি দেখতে পেলেন না, কারণ সবার মতো আমার শরীরও একটা খোলসে ঢাকা। তাই আমার একান্ত অভিব্যাক্তিগুলো খোলসের নিঃস্পৃহতার নিচে নিখুঁত ভাবে চাপা পরে যাচ্ছিলো। আর সকলের মতো আমিও দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখানে এসেছি। আমার শরীর থেকে ক্লান্তির রেখাগুলো গড়িয়ে পড়বার আগেই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। কখনো কখনো আমি আমার সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়েছি। তাদের শরীরের অগোছালো খোলস দেখে কখনো নিরুত্তাপ থেকেছি, কখনো আবার এর কারণ খুঁজতে নিজের ভিতরে ডুব দিয়েছি। আমি এক বামন বাজিকর, বহু অধ্যবসায়ে শিখেছি বাজির খেলা। আমি জানি কি করে পথক্লান্ত মানুষের অবসন্ন সময় কাটিয়ে দিতে হয়। আমার কাঁধের ঝোলায় লুকোনো আছে রহস্য আর উত্তেজনার যাবতীয় উপকরণ এবং শুধুমাত্র আমিই জানি কিভাবে কখন তাদের ব্যবহার করতে হয়। রহস্যের ঝোলা কাঁধে আমি শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াই আর মোক্ষম সময়ে পৌঁছে গিয়ে মানুষকে বিস্ময়ে বিকল করে রাখি। আজ শেষ বিকেলের আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে একটা নির্দিষ্ট শহরে। এ শহর আমার গন্তব্য নয়, আসলে ভ্রাম্যমাণ মানুষের কোন গন্তব্য থেকে না অথচ সব গন্তব্যই তাকে পেড়িয়ে যেতে হয়। তাই শহরফিরতি অন্যান্য মানুষের মতো আমিও এখানে কোন একটা বাহনের অপেক্ষা করছি।
ক্লান্তির সাথে যতটুকু অপেক্ষা মিশলে মানুষ স্থাণু হয়, ঠিক ততটুকু অপেক্ষার পর রঙচটা এক অদ্ভুত বাহন আমাদের পথে এসে দাঁড়ালো আর তার যান্ত্রিক কর্কশ ডাকে বৃষ্টিভীত পিঁপড়ের মতো সবাই একে ওকে ডিঙ্গিয়ে পিলপিল করে তাতে উঠে বসল। কিন্তু কেউ আমাকে স্পর্শ করলো না, কারণ সবার মধ্যে শুধুমাত্র আমার খোলসটিই ছিল অভিজাত। তারা সমীহের দূরত্বে থেকে আমার দিকে এক এক করে তাকালো, আর আমার খোলসের সম্ভ্রম আমাকে নুইয়ে ফেলল প্রথম গলা তুষারের মতো। আমি আমার খোলসকে ভালবাসতে শুরু করলাম, যেমন করে খোঁজা প্রহরী বেঁচে থাকার শেষ অজুহাতে অক্ষম ভাবে ভালবেসে যায় হেরেমের অসূর্যস্পর্শা রাজকন্যাকে। আমি সে খোঁজার নিষ্ঠায় এই অভিজাত খোলসের একমাত্র প্রহরী; এলোমেলো আর জীর্ণ খোলস পড়া সহযাত্রীদের স্পর্শ বাঁচিয়ে এই জংধরা লোহালক্কড়ের ধূসর রাজত্বে অভিষিক্ত হলাম। সহযাত্রীদের মালিন্য, তাদের সংশয়ী দৃষ্টি আর ঈর্ষাহীন মুগ্ধতা আমার খোলসের ঔজ্জ্বল্যকে এমনভাবে তীব্রতর করে তুলল যে তাদের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা ব্যয় করতেও আমি পিছপা হলাম না।
কিছুক্ষণ কেশে নিয়ে আমাদের এই অদ্ভুত দর্শন বাহনটি ক্ষয়রোগীর মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে শুরু করলো এবং দ্বিতীয়বার কাশতে কাশতে থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলল, এরপর আবার একই ভাবে চলতে থাকল। তার এই মুমূর্ষযাত্রায় আমার সহযাত্রীরা কেউ বিচলিত হলো না, বরং একেই অভ্যাস ভেবে নিজেদের জীর্ণ খোলসগুলোর বাঁধনে কিছুটা আলগা দেয়ার ফুরসৎ পেলো। আর তাতেই অনেকক্ষণের জমে থাকা অপেক্ষার ঘেমো গন্ধটা মুক্তি পেয়ে এ বাহনের ছোট্ট পরিসরটাকে ভারী করে তুলল। হয়তো সে ভারী বাতাসের নিজস্ব একটা মাদকতা ছিল। তাই আমার সহযাত্রীরা শুঁড়িখানার আন্তরিকতায় যার যার নিজস্ব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলো। আসলে তাদের বিচ্ছিন্ন কোন গল্প থাকার কথা ছিল না, কেননা তাদের সবার একই খোলসবন্দী শরীর, একই ভাষা, একই ক্লান্তি, একই অপেক্ষা। তবু কি মুগ্ধ বিস্ময়ে, বিশ্বাসে, অবিশ্বাসে একে অন্যের গল্প শুনছে, অথবা শুনছে না, হয়তো শুধুই বলে যাচ্ছে। আমি সে গল্প শোনার জন্য ভীষণ আগ্রহে কান পাতলাম। কিন্তু খোলসের ভারী পর্দা আমার কানের উপর সঙ্গম স্নেহে এঁটে বসল, যেন কোন মতেই সে গল্পের ভাষা শুনতে দেবে না, যেন এখুনি গভীরতম প্রেমের সময় এসেছে। আমি অচেনা ভাষার গল্প ছাপিয়ে একটা গহীন অরণ্যের শণ শণ গান শুনতে পেলাম, যে গানে মহীরুহ থেকে শুরু করে পরাশ্রয়ী লতারাও কথা বলে। সে কথা পাতার সাথে পাতার স্পর্শে শুধুমাত্র গাছেরা শুনতে পায়। তৃষ্ণার্তের মতো আমি সে গানের শব্দ শুনতে থাকি, আরও বেশী শুনতে থাকি, শুধু একবার সে গানের মানে বুঝবো বলে আমি ছুটতে থাকি, একটা গাছকে জড়িয়ে ধরব বলে আরেকটা গাছকে জড়িয়ে ধরি এবং আরও বেশী জড়িয়ে ধরতে থাকি। গাছগুলোকে নিশিপাওয়া মানুষের মতো মনে হয়, আমাকে এড়িয়ে গিয়ে তারা নিজেদের গান গাইতে গাইতে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। দূরে একটা চিমনি দেখা যায়, চিমনির মুখে ঘন কালো ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে এসে গাছগুলোকে ডাকতে থাকে। গাছগুলো এগিয়ে যায়, আমি দুই হাত ছুঁড়ে তাদের থামতে বলি। অথচ কি আশ্চর্য! তারা যেন আমাকে শুনতে পায় না, অথবা আমি অদৃশ্য! গাছগুলো চিমনির আগুনে ঝাঁপ দেয়, হাসতে হাসতে পুড়তে থাকে, শরীরের খোলসগুলো আগুনের আঁচে মিলিয়ে যেতে যেতে শুধু এক মুহূর্তের জন্য তাদের নগ্ন শরীরগুলো দেখা যায়। কি নাজুক, পেলব সে শরীর, তার ভাঁজে ভাঁজে সময়ের ক্ষত লেখা, সময়গুলো পুড়তে থাকে, পুড়তে পুড়তে শূন্যে মিলিয়ে যায়। চিমনীর মুখে আরও গাছের সারি এসে জড়ো হয়, এবং আরও অনেক গাছ মিছিল ধরে এগোতে থাকে। আমি এ অমোঘযাত্রার পদধ্বনি শুনতে থাকি…
চোখ মেলে দেখি আমাদের বাহনটা শহরে এসে থেমেছে। আমার সহযাত্রীরা এক এক করে নেমে যাচ্ছে শহরের অলিতেগলিতে। আমিও তাদের পেছন পেছন নেমে পড়ি। এর পর অন্য সবার মতো শহরের বুকে হাঁটতে থাকি। বিকেল হয়ে এসেছে। বিকেলের রঙ হলুদ। মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় আমি হাত পেতে হলুদ রঙের গাঢ়ত্ব পরখ করে দেখি। একটা যথার্থ জায়গার খোঁজে আমি মন দিয়ে শহরটার দিকে তাকাই। হলদেটে আলোয় শহরটাকে প্রাচীন কোন পুঁথির মতো মনে হয়। পুঁথিটার পাতায় পাতায় এ শহরের ইট, কাঠ, আর কড়িবর্গার উপাখ্যান লেখা। খুব মন দিয়ে পড়লে জানা যায়, এ শহরের লুপ্ত মানুষেরা একদিন আদিষ্ট হয়ে এ শহর গড়েছিল। তারা ঘাম আর রক্তের লবণে সৃষ্টি করেছিল সুরম্য অট্টালিকা, ঘরবাড়ি, পাথরমোড়া পথঘাট, আর ধর্মশালা। জীর্ণ বস্তিগুলো আগাছার মতো নিজে নিজেই গজিয়ে উঠেছিল শহরতলীর পতিত জমিতে। সব কাজ শেষ হলে পর একদিন পরিশ্রান্ত মানুষেরা জড়ো হয় ধর্মশালার উঠানে। প্রধান পুরোহিত ক্লান্তি মোচনের দৈব মীমাংসা ঘোষণা করেন “শুধুমাত্র আত্মবলিদান মুছে দিতে পারে ক্লান্তির কালিমা”। তখন মানুষেরা একটা প্রচণ্ড অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে আর একে একে সবাই বলিদানের মহোৎসবে শামিল হয়। তাদের দগ্ধশরীরের ভস্ম থেকে জন্ম নেয় খোলসের স্ফটিক স্বচ্ছ আঁশ। অনুবর্তী মানুষেরা সময়ের ক্ষত ঢাকতে পরম মমতায় সে আঁশ জড়িয়ে রাখে শরীরে এবং ভুলে যায় লুপ্ত মানুষের কথকতা।
শেষ বিকেলে সময় ধীর হয়ে আসে। তার অবয়ব দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ ছায়ায়। হাঁটতে হাঁটতে আমি শহরের মাঝখানে এসে থামি। আমার অবচেতন মন আমাকে বলে দেয় এখানেই একদিন বসেছিল আত্নবলিদানের মহোৎসব, তার পোড়া দাগ এখনো পথের পাথরে লেগে আছে। এটাই আমার সম্মোহন খেলার মোক্ষম স্থান। মানুষের ছায়া থেকে অবসন্ন সময়ের অবয়ব মুছে দেব বলে আমি আমার ঝোলা থেকে বের করে আনি জাদুর রশি, রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা বেঁধে দেই। এরপর বাজিকরের নিপুণ কৌশলে রশির উপর এসে দাড়াই। শেষ বিকেলের আলোয় আমার শরীরের খোলস ঝলসে উঠে পথচলতি মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো জড়ো হয় আমার চারপাশে। তাদের দীর্ঘ ছায়াগুলো শরীরের দৈর্ঘ্য ছাপিয়ে নিজেদের অজান্তে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে। মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায়, আমার ঝলমলে খোলসের মায়ায় বিভ্রান্ত হয়। আমি বিনীত হয়ে তাদের অভিবাদন জানাই। নিজেকে কেন্দ্রীভূত করতে আমি কিছুটা সময় নিই। রশিটা মেঘের ভিতর বিদ্যুৎচমকের মতো এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে চলে গেছে। তার চলে যাবার সরলরেখাটাকে অন্তহীন মনে হয়। এই অন্তহীন পথের প্রান্তে এসে দাঁড়ালে অন্ধেরও বুক কেঁপে ওঠে। আমি হৃদপিণ্ডে রক্তের জোয়ার টের পাই। নিজেকে নিজে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বলি, “তুমিই সেই বলির চিতায় লুপ্ত মানুষের শব……”। কেউ আমার কথা শুনতে পায় না, বরং বাজিকরের মন্ত্র ভেবে অবনত হয়। আমি তাদের মুগ্ধতা ও মূঢ়তা দুটোই উপেক্ষা করে যাই। এরপর সময়কে অনুকরণ করে শূন্যে ভর দিয়ে ধীর পায়ে চলতে থাকি। চলতে চলতে থেমে যাই, পড়ে যাবার উপক্রম করতেই মানুষগুলো উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে। আমার প্রতি তাদের পক্ষপাত আমাকে শান্ত করে। হৃৎপিণ্ডে রক্তের প্লাবন তাদের শরীরের খোলসেও রঙ লাগায়, অথবা আমিই তাদের শরীরে প্রতিফলিত হই। শূন্যে দাড়িয়ে সব মানুষকেই মনে হয় বামন বাজীকর, যেন তারাও অন্য কোন বিকেলগ্রস্থ শহরের মাঝখানে দাড়িয়ে আমারই মতো খেলা দেখিয়ে ফিরছে। সেসব শহরেরও বুঝি একই উপাখ্যান!
শূন্যে হেঁটে হেঁটে আমি সময়কে পার করে দেই। মানুষের শরীরের দীর্ঘ ছায়া মুছে যায়। এখন রাত নেমে আসছে। এখন ঘরে ফেরার সময়। ঘর, যেখানে মানুষের শোক, ভালবাসা, স্নেহ, স্মৃতি আর আকাঙ্ক্ষার দলিলদস্তাবেজ স্তুপ করে রাখা। ভোর পর্যন্ত মানুষেরা এইসব দলিলের সোঁদা গন্ধে জারিত হবে, এরপর আবার বেড়িয়ে পড়বে পথে। আমার ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। শুধু খোলসের একান্ত গোপনে জ্বলতে থাকা চিতার আগুন নেভাব বলে একটু বৃষ্টির সাধ হয়। আমি বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকি, হয়তো আর সব বামন বাজীকরেরাও তাদের ঘরের দাওয়ায় এসে বসে আমারই মতো বৃষ্টির অপেক্ষায়। আমাদের সম্মিলিত হাহাকার ঘনীভূত বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে। কতদিন বৃষ্টি হয়নি এ শহরে! কতদিনের জ্বলতে থাকা চিতার আগুণ শান্ত করে বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে যায় সময়ের জমে থাকা ক্ষত! বৃষ্টির ওষধি স্পর্শ নেব বলে আমি শরীর থেকে আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা খোলসটাকে খুলে ফেলি, আমার নাজুক, পেলব শরীরে বৃষ্টির নরম স্পর্শ ছুঁয়ে যায়। অবহেলায় পড়ে থাকে আমার খোলস, রাজ্যপাটহীন রাজকন্যার মত কাঁদতে থাকে। আড়াল থেকে থমকে থাকা সময় ক্রূর হাসি হেসে প্রবোধ দেয়, “দুঃখ কোর না রাজকন্যা! শুধু ভোর হতে দাও…”