Posts

গল্প

ঘর বাঁধিবার ছলে

December 9, 2024

হুযাইফা মুহাম্মাদ

১।


 

নারীর নাকি নিজস্ব কোন ঘর হয়-না।বাড়ি হয়না। যা হয় তা হচ্ছে বাপের বাড়ি। অতঃপর স্বামীর বাড়ি। এই দুই বাড়ি, এই দুইঘর ব্যাতিত নারীর কোন ঘর নেই। 


 

এমনটাই প্রচলিত জনশ্রুতি। 


 

এই জনশ্রুতি আরো জনমুখর করে তুলেছে আমাদের জননীরা। অলস দুপুরের ঘরের উঠুনে পিরি পেতে বসে একজন অপরজনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বাপের বাড়ির গল্প জুড়ে।বৃদ্ধ শাশুড়ী তার ছেলের বউয়ের কাছে ফিরিস্তি দেয়, স্বামীর বাড়ির শুরুর দিনগুলোর দুঃখ-কষ্ট। আবেগি হয়ে গল্প শোনায় ___ 'বাপের ঘর ছেড়ে যখন স্বামীর ঘরে নতুন এসেছিলুম...


 

এভাবেই আলাপ আলোচনা হতে থাকে বাপের ঘর থেকে স্বামীর ঘরের প্রত্যাবর্তন নিয়ে। কিন্তু বউ শাশুড়ীর পান চিবানো এইসব গল্পে কখনো বাপ- স্বামীর ঘর গড়ার গল্প উঠে আসেনা।'বাপের বাড়ি' আর স্বামীর ঘর' কথাটি মুখেরবলি হয়ে থাকলেও এই ঘরের ভাঙা-গড়া নিয়ে কেউ কখনো কথা তুলেনা। শুধু বউ শাশুড়ী নয়,পুরুষের তিলে তিলে গড়ে তুলা ঘরের গল্প অবহেলাতেই অপ্রকাশিত থেকে যায় সবার কাছে। বিস্ময়কর বেপার হচ্ছে, এই অবহেলাটাও কিন্তু একদিক থেকে ঘর তৈরির সরঞ্জাম। 


 

একটা কথা আছেনা? 

'পুরুষ ঘর ছাড়ে ঘর বাঁধার জন্য।' আর একবার পুরুষ  ঘর ছাড়লে,নিজে ঘর তৈরির আগ পর্যন্ত আর ঘরে ফেরা হয়ে উঠেনা। পুরুষ তখন হয়ে যায় ঘরের মেহমান।সেই এক ঈদ কিংবা কোন পারিবারিক উৎসবে ঘরে আসা হয়।তারপর বর্ষা পেরোয়।শীত গড়ায়।ঘরে ফেরার বসন্ত আর আসেনা।


 

পাঠক হয়তো ভাবছেন ঘর বাঁধা এ আর এমন কি জিনিস? দোচালার সামনের উঠোনটায় আরেকটা দোচালা ঘর তুলবে এই তো?


 

আজ্ঞে হ্যা। তবে এই 'এইতো' এর মাঝেই অনেক  কথা আছে। 


 

'পুরুষের ঘর' বলতে কেবল একটি ঘর-ই নয়।"পুরুষের ঘর" বলতে সাধারণত একটি পরিবার বা সমাজে সেই স্থান বা অবস্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে একজন পুরুষের দায়িত্ব, কর্তব্য, এবং ভূমিকা থাকে। এটি হতে পারে তার নিজের বাড়ি, যেখানে তিনি পরিবারের জন্য কাজ করেন, দায়িত্ব পালন করেন এবং পরিবারের সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক নিরাপত্তা প্রদান করেন। এটি বিশেষ করে পুরুষের পরিবারের প্রধান ভূমিকা হিসেবে দেখা যায়, যেখানে তিনি পরিবারের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন।


 

আমরা শুধু ঘর দেখি, ঘর বাঁধার পিছনের গল্পটি দেখিনা।একটা ছেলে ভবঘুরে থেকে হটাৎ পুরোদস্তুর সাংসারিক হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজি না। ভাবি পুরুষ হয়ে জন্মেছে-ই তে ঘর বাঁধার জন্য, এটা নিয়ে ভাবার-ই বা কি আছে?




 

২।



 

এক বিষাদগ্রস্ত সকালের কথা।আমি তখন ক্ষুদ্র দেহের নির্বোধ নাবালক। বাসা থেকে আসা-যাওয়া করে পড়ালেখার অধ্যায় চুকিয়ে ঘর ছাড়ার পড়ালেখায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আমাকে বিদায় দেওয়ার আগে আব্বু মামণি-কে নিয়ে মোনাজাত ধরলেন। আব্বুকে যেন সেদিনই প্রথম দেখলাম কান্না করতে।আর মামণির গাল বেয়ে পরা অশ্রুর ফোঁটাগুলোয় __সকালের সূর্যের মিষ্টি কিরণ ঝলমলিয়ে উঠছিলো।

আমার জন্য কেউ কাঁদছে। বিষয়টা তখনই আমাকে একরকম পিচাশিক আনন্দ দিতো।

তখন বুঝতাম না কেন এই কান্না তাদের। কেন এই অশ্রু। আজ বহুবছর পরে যখন এইসব ভাবি___আমার হিসেব মিলে।আমি বুঝি, ঘর গড়ার জন্য এভাবেই ঘর ছাড়ার আনুষ্ঠানিকতা হয়ে থাকে।


 

বলেছিলাম না? 

'পুরুষ একবার ঘর ছাড়লে, নিজে ঘর বাঁধার আগ পর্যন্ত আর ঘরে ফেরা হয়ে উঠেনা। পুরুষ তখন হয় তারই ঘরের মেহমান '


 

এতটুকুন বয়সে আমিও আমার ঘরের মেহমান হয়ে গেলাম। 


 

সপ্তাহে একবার কিংবা দু'সপ্তাহে একবার আমার ঘরে আমি দাওয়াত পেতাম। দিন-রাতের সাথে সাথে সাথে দাওয়াত পাওয়ার দিনগুলো-ও দীর্ঘ হতে থাকলো। দেখা যায় মাস পেরিয়ে যায়।আপন ঘর থেকে দাওয়াত আর আসেনা।আস্তে আস্তে বোধ হচ্ছিল। আসলে এটা আমার ঘর না।


 

তাহলে আমার ঘর কোনটা?


 

আমার কোন ঘর নেই।আমার ঘর নেই বলেই তো ঘর বাঁধতে ঘরছাড়া হলাম।

বাসায় যাওয়ার আগ্রহ আস্তে আস্তে দমতে লাগলো। 

মামণি ফোন দেয়।বলে___আব্বু বাসায় কবে আসবা?

আমি মুখে বলি আসবো।কিন্তু হৃদয়ের ভিতর থেকে কে যেন বলে____বসন্ত আসুক মামণি। ঘর বাঁধা হয়ে গেলে ঠিকই আসবো।


 

৩।


 

সময় গড়ায় স্রোতের মতন।


 

আমরা চাইলেও সময়কে ধরে রাখতে পারবোনা। কিন্তু চাইলে আমরা মানুষকে ধরে রাখতে পারি।তাই সময়ের মূল্যায়নের পাশাপাশি, মানুষকেও মূল্যায়ন করতে হয়।


 

অথচ ঘর বাঁধতে গিয়ে বুঝতে পারলাম,ঘর বাঁধতে হলে মানুষ হারাতে হয়।

আমিও হারালাম। আমার আত্মীয় স্বজন। বন্ধু বান্ধব। পরিচিতজন।আদরেরজন।সব ছেড়ে ছুঁড়ে একদিন শহরের পথে পারি জমালাম। 


 

চেনা শহর।চেনা পথ।চেনা মাটি।মাটির গন্ধ।অলিতে-গলিতে হাজারো স্মৃতির সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ঘর বাঁধার নেশায় ঢাকায় গিয়ে উঠলাম।


 

ক্রংক্রিটের শহর।ধূলিময় রাজপথ। ইট-বালুর শহরেতে পা রেখে নিজেকে এই বলে বোধ দিলাম যে__উন্নত ঘর বাঁধার জন্য ইট-বালুরও প্রয়োজন হয়।

ঘর বাঁধার স্বপ্নে স্বাপ্নিক হয়ে জীবনের সাথে তুমুল যুদ্ধে লেগে গেলাম।

আমি মফস্বল থেকে শেকড় ছিঁড়ে উঠে আসা মানুষ। মানুষ তো সবসময় শেকড়ের সন্ধানেই থাকে।আমিও থাকলাম। 


 

আমার ব্যচলর বাসার এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে বেশ ভাব জমে গেলো।উনার গায়রে হাজিরে দু-এক ওয়াক্ত নামাজের ইমামতিরও দায়িত্ব পালন করা হয় প্রায়শই। ইমাম সাহেব মামা বলে ডাকেন এমন একজন পৌঢ়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমায়।আমিও ইমাম সাহেবের সাথে তাল মিলিয়ে ভদ্রলোক-কে মামা বলেই সম্মোধন করি।আমার উপর দায়িত্ব এসেছে মামার মেয়েকে আরবী পড়ানো।আমার অসুবিধে হবেনা জেনে কাল থেকে পড়ানোর ডেট কনফার্ম করলেন।শেকড় ছাড়া এই ধূসর শহরে মামা বলতে একটা শেকড় পেয়ে গেলাম।ঘর বাঁধতে কি শেকড়েরও প্রয়োজন হয়?

হয়তো হয়।


 

৪।


 

আমার সামনে পাঁচ কি ছয় বছরের চঞ্চল একটা মেয়ে শান্ত হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি অবনত।সামনে খোলা কায়দা। ওড়না দিয়ে মাথা শরীর সম্পূর্ণ ঢাকা। 


 

ও-ই হচ্ছে মামার মেয়ে।যাকে আরবী পড়ানোর গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে অর্পিত হয়েছে।ওদের  বাসায় যখন ঢুকছিলাম তখনও ওর চিল্লাপাল্লায় মনে হচ্ছিলো তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলো বোধহয়। টম এন্ড জেরি ঝগড়া করার পরে বাসাটার অবস্থা যেমনটা হয়, পাশের রুমে বসে বসে মনে হচ্ছে ওই রুমটাও টম এন্ড জেরির বাসার মতো ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। উপলব্ধি করতে পারছিলাম ওপাশে কেউ একজন খাট থেকে ফ্লোরে লাফ দিচ্ছে। আবার ফ্লোর থেকে খাটে ঝাপিয়ে পরছে।দেয়ালে ঢিল ছুড়ছে। সিলিং এ আঘাত করছে।অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করছে।মা'কে ডাকছে। কিছু একটায় হইতো লটকি মেরে মুখে আওয়াজ করছে 'ঝিপাং'। এর মাঝখানে চিল্লিয়ে বলতে শুনলাম 'ও যদি আমাকে একটা পড়ার জন্য ধমক দেয়,তাহলে আমি এই জামা আর পরবোনা বলে দিলাম। আমাকে নতুন লাল জামা কিনে দিবা।কাল যেটা দেখছি।'

মামী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো 'ধমক দেওয়ার সাথে জামার কি সম্পর্ক?


 

ও দ্বিগুণ চিল্লায় বললো 'হ্যা, এটাই কথা....


 

অথচ আমার সামনে যে পিচ্চি-টি বসে আছে, তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না; যে একটু আগে ইনি একটা আন্দোলন সম্পূর্ণ করে এসেছেন। 


 

এত চুপচাপ। শান্ত। কথাও বলছেনা। একবার শুধু তাকাতে দেখেছি। তাও চোখে চোখ পরতে দৃষ্টি নত করে ফেললো। 


 

এমন ডাবল কারেক্টার নিয়ে একমাত্র মেয়েরা-ই জন্মায়। ছেলেরা সাধারণত ডাবল কারেক্টার হয় না।ছেলেরা বাসার বাহিরে যদি ভুদাই হয়,তবে বাসার ভিতরেও ভুদাই।কিন্তু মেয়েরা বাসার বাহিরে রহিমা খালা হলেও, বাসায় এসে দেখবেন মেয়ের মাথায় শিং গজিয়েছে। পিঠের দিকটায় পাখনা বের হয়েছে, এখন শুধু আপনার মাথা খাওয়া বাকি।


 

আমি আদর করে জিগ্যেস করলাম,তোমার নাম কি? ও যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায়-ই অপেক্ষমান ছিলো। প্রশ্নের সাথে সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে বললো: 'আদিবা আইরিন আয়েশা'


 

ওরে বাবা এত বড় নাম? এখানে তো তিনটা নাম হয়ে গেলো।


 

ও মাথা নিচু করেই বললো: আব্বু,আম্মু,দাদু,তিন জন তিন নাম রেখেছে।পরে কারোর টা-ই আর ফালানো হয়নি।


 

তিনটা নাম থেকে তোমার পছন্দের নাম কোনটা?


 

ও বললো: 'আয়েশা'


 

আয়েশা নাম কি তোমার আব্বু রেখেছে?


 

:না।


 

:আম্মু? 


 

: না, আমার দাদু।দাদু জীবিত নেই,কিন্তু উনার দেওয়া নামটা আছে!


 

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করলাম 'দাদু জীবিত নেই 'কথাটা ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো।কোন রকম কষ্টের আভাস তার সুন্দর ছোট্ট মুখখানায় প্রকাশ পায়নি। ও কি বুঝে মানুষ হারানোর বেদনা? না হয়তো।এইটুকুন বয়সে দুঃখ-বেদনা অনুভব করার কথা না।নাকি মনের কষ্ট চেহারায় প্রকাশ না করার 

দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে এখনই? 


 

আমি বললাম: তাহলে তোমাকে আমি 'আয়েশা' নামেই ডাকবো।


 

ও কিছুটা প্রফুল্ল হয়ে বললো: তাহলে আমি তোমাকে কি নামে ডাকবো?


 

খেয়াল করলাম প্রথমবারের মতো ও আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো।ওর প্রশ্ন শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এতটুকু মেয়ে আমাকে নামে ডাকবে!?


 

নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলাম: আমরা কেউ-ই কাউকে কোন নামে ডাকবো না।তুমি আমাকে ডাকবে ভাইয়া...


 

মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে প্রায় সাথে সাথেই  বললো:আর তুমি আমাকে ডাকবে আপু।


 

ওর মুখে হাসি।ঝকঝকে সকালের মত স্নিগ্ধময় হাসি।আমি বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখতে থাকলাম। এই বয়সে ও যথেষ্ট ভাবগম্ভীর। বাচ্চাদের এই বয়সে মুখে অনেক জড়তা থাকে। ওর কথা অনেক স্পষ্ট। আর ও কথাও বলে খুব গুছিয়ে। 

অন্য বাচ্চাদের মত হাত নাড়িয়ে ঢং করে নয়।


 

আমাদের আপু- ভাইয়ার দিনগুলো কাটতে লাগলো স্বাভাবিক সময়ের স্রোত ধরে। আমাদের মাঝে ভাব জমতে সময় লাগলো না। 


 

ওর দিকে তাকালে যেন আমার বহুদূরে রেখে আসা বোনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কাছে থাকলে হয়তো আয়েশার মতো করে নিজের বোন-কেই সময় দিতাম। ঘর বাঁধতে এসে পাতানো বোন কে সময় দিচ্ছি। সব শিকড়, সব সম্পর্কের মূলে হয়তো এই ঘর বাঁধার বিষয়টি নিবিড় ভাবে জড়িত। সত্যি-ই কি তাই?


 

৫।


 

মামাকে পেলাম গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের ওখানে। সচিবালয়ে পাহারারত পুলিশদের সাথে সাধারণ জনতা মিক্স হয়ে যে জায়গাটায় গণহারে সবাই বিড়ি খায়, মামাও ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো।জিগ্যেস করলাম মামা কেমন আছেন?


 

উনি সলজ্জ হেসে সিগারেট টা রাস্তায় ছুড়ে বললেন:মন-মেজাজ ভালো না মামা।


 

জিগ্যেস করলাম: কেন?


 

: বস অপমান করছে।বলেছে, কবরস্থান আর আমাদের অফিসের মাঝে কোন পার্থক্য নাই।মুর্দারা যেমন কিছু করতে পারেনা,আমরাও নাকি কিছু করতে পারিনা।তবে একটু নাকি তফাৎ আছে।কবরস্থানে মৃত মানুষেরা থাকে।আর আমাদের অফিসে থাকে নাকি সব জীবিত ছাগল।ছাগলটাও বলেছে অপমান করে।ছাগল 'ছ'  দিয়ে না বলে 'স' দিয়ে বলেছে, 

'সাগল'।


 

মামাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হেসে ফেললাম। মামা ভ্রুক্ষেপ করলো না।উনার দৃষ্টি জিরো পয়েন্টের দীর্ঘ জ্যামে।আমি উনার কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম: মামা! আপনার ছোট হয়েও একটা উপদেশ দেই, শীত আর অপমান যতোই গায়ে লাগাবেন,ততই নিজে কষ্ট পাবেন। এইসব গায়ে লাগাতে নেই।


 

উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই তাকানোর অর্থ হচ্ছে 'দামি কথা বলেছো ভাগিনা'


 

:বাসায় যাবেন না মামা?


 

উনি কিছুটা উদাস হয়ে বললেন: বাসায় গিয়েই বা কি হবে? তোমার মামীর সাথেও বোঝাপরা খুব একটা ভালোনা।


 

আমি কৌতুক করে হেসে বললাম: হ্যা শুনলাম তো আয়েশা’র কাছে।ওরে জিগ্যেস করেছি তোমাকে কে বেশি আদর করে? আব্বু না আম্মু?

ও বললো একজনও না।আব্বু সবচেয়ে বেশি আদর করে আম্মুকে,আম্মুও সবচেয়ে বেশি আদর করে আব্বুকে।আমাকে কেউ আদর করেনা।


 

মামার মুচকি হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হলো।এই হাসি দেখার মাঝেও তৃপ্তি আছে। 


 

৬।


 

ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাকে ভাইয়া!


 

আয়েশার ডাকে সংবিৎ ফিরে পাই।এতক্ষণ মনে হচ্ছিল আমার সামনে আয়েশা নয়,যেন আমার বোনই ওড়না মাথায় পড়তে বসেছিলো।বোনও এমন ভাবে ঘুরার আবদার করতো।কিন্তু অহেতুক অজুহাতে বোনকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হয়নি কখনো।অথচ পাতানো বোনকে নিয়ে সেদিন ঠিকই ঘুরতে বের হয়েছিলাম। এই শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত হতে গিয়ে বারবার নিজ শিকড়ের কথা মনে পরে যাচ্ছিলো।


 

বিশেষ করে বোনের কথা।যতবার আয়েশা কে দেখি বোনটার জন্য বুকের ভেতর হু হু করে উঠে।একদিন ঠিক করে ফেললাম, নিজের ঘরে মেহমান হবো।অনেক ধরে নিজের ঘরের মেহমান হয়ে উঠা হয়না।


 

নিজের এলাকা।পরিচিত মাটি ছোঁয়া হয়না।মায়ের হাতের রান্নার ঘ্রাণ নেওয়া হয়না।এবার তো যাওয়া-ই যায়।আমার এলাকার বন্ধু সামির সাথে সাথে কথা বলি।একসাথে বাড়ি যাবো।স্মৃতি গুলো তাজা করবো।


 

এইসব ভেবে ভেবে ভেবে এক মহান বৃহস্পতিবার বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। মার জন্য সস্তায় শাড়ি নিলাম। বোনের জন্য জামা।আরো কত ছোট খাটো ঘরোয়া জিনিসপত্র কিনা হলো। 


 

বন্ধুকে বললাম দুপুরের পরই রওনা দিবো,তোর অফিস শেষ হলে।

প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। 


 

বাড়ি যাওয়ার কথা আগেই মামা-মামীকে জানানো হয়েছিলো।আয়েশাকেও বলা হয়েছে।দুদিন আসবোনা। শুনে বোধহয় মনটা খারাপ হয়েছে ওর। কিন্তু বুঝতে দেয়নি। সামি আধা ঘণ্টার ভিতরে চলে আসবে,ও আসলেই বের হবো।


 

কি মনে করে যেন ভাবলাম যাওয়ার আগে আরেকবার মামীকে বলি নেই। ভাবতে ভাবতেই দেখি মামীর কল।টাইমিং দেখে মনে মনে খুশি-ই হয়েছিলাম। কিন্তু খুশিটা স্থায়ী হয়নি।কল রিসিভ করার পরই শুনলাম মামীর চিৎকার। কি কি বলে যেন কান্না করছে চিৎকার করে।কিছুই বুঝলাম না। শুধু এতটুকু বুঝলাম মামী বিপদে পরেছে।বড় বিপদ!


 

পরিহিত কাপড়েই মানিব্যাগ আর ফোনটা পকেটে পুরে ভোঁদৌড় দিলাম মামার ফ্লাটের দিকে। যেয়ে দেখি ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে প্রায়। মামী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শুধু চিৎকার করছে আর কি যেন বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কান্না আর কথা একাকার হয়ে ভয়ংকর আওয়াজ বের হচ্ছে কেবল।


 

আয়েশার মাথার পিছনটা থেঁতলে আছে।রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন।কি হয়েছে। কিভাবে হয়েছে শোনার সময় নেই। কোলে করে রাস্তায় নেমে এলাম।একটা সিএনজি নিয়ে ছোটে গেলাম মিটফোর্ডে।ইমারজেন্সিতে ঢুকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম লম্বা করিডোরে।শরীর অবশ লাগছে ।মাথার ভিতরটায় সবকিছু ভোঁভোঁ করছে।চোখে স্পষ্ট কিছু দেখছিনা।আলো-আঁধারিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে পুরো হসপিটাল। আমার এমন লাগছে কেন?

আমি কি এখন সেন্সলেস হয়ে যাবো?


 

৭।


 

শুক্রবার। সময় দুপুর ১ টা বেজে ২০ মিনিট। 


 

আয়েশার জ্ঞান ফিরলো মাত্র। মামী কাঁদতে কাঁদতে আয়েশার মতই অবস্থা। মামাকে বাইরে থেকে যতটা শক্ত মনে করেছিলাম মানুষটা ভিতর থেকে ততটাই নরম।স্ত্রী-কে কি স্বান্তনা দিবে নিজেই মেয়েদের মতো টানা কাঁদতেই আছে।জ্ঞান ফেরার পর আয়েশা প্রথমেই আমাকে বললো: ভাইয়া তুমি আমার সাথেই ছিলে?


 

:হ্যা আপু।


 

:এই জন্যই তো আমার ভয় করেনি।তুমি কি এখন আমাকে ফেলে বাসায় চলে যাবে ভাইয়া?


 

:তোমাকে নিয়ে যাবো আপু,তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা।


 

আয়েশার মাথা ভর্তি বেন্ডেজ। শরীরে লাগানো স্যালাইন। অথচ মেয়েটা হাসছে।সকালের রোদের মতো স্নিগ্ধ হাসি।কে বলবে ও একটুর জন্য মরতে বসেছিলো?

খাট থেকে আলনায় লটকি দিয়ে ঝিপাং খেলার সময় আলনা সহ ফ্লোরে পরে মাথা ফেটেছিলো কে বলবে?


 

গতকাল সামি ঠিক সময়ই এসেছিলো।কিন্তু পাতানো বোনের এক্সিডেন্টের উপরে আপন বোনকে প্রাধান্য দিতে পারিনি।সামিকে বলে দিয়েছিলাম শপিং গুলো যেন বাসায় পৌঁছে দেয়। এবারের মতো আমার আর ঘরের মেহমান হওয়া হচ্ছে না।


 

জুমার নামাজের পর মোনাজাতে খুব করে কাঁদলাম। কেন কাঁদলাম জানিনা। বুকটা ভারি লাগছিলো খুব,কেঁদে হালকা করলাম। বাড়িতে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম আসবোনা।মোনাজাতের পর আম্মুকে আবার কল করি।


 

আম্মু স্বভাব সূলভ জিগ্যেস করলো:কি করো আব্বু? 


 

: ঘর বাঁধি মামণি।

সেই যে ছেলেবেলায় ঘর বাঁধিবার ছলে বের হয়েছিলাম, এরপর থেকে আমার আর ঘর বাঁধা ছাড়া তেমন কিছু করা হয়না'


 

এইসব কথা বলিনি,বলা হয়না কখনো।

কি করো এর প্রতিত্তোরে আমি শুধু বললাম: কিছুনা মামণি।


 

সমাপ্ত

Comments

    Please login to post comment. Login