মাত্র ৭,০৯৬ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট দেশ সিকিমের জনগণও স্বাধীনতা চেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন সিকিমে ‘ভারতের সাথে তারা যুক্ত হতে ইচ্ছুক কিনা’ এ প্রশ্নে গণভোট হয়েছিল। সিকিমের জনগণ প্রত্যাখ্যান করে এ প্রস্তাব। কিন্তু এরপর তিরিশ বছর না পেরোতেই এক বিশ্বাসঘাতক, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর কূটচাল ও সিকিমের রাজার সরলতায় সিকিম হয়ে ওঠে ভারতের প্রদেশ।
সিকিমের ভারতের প্রদেশ হয়ে ওঠার সফরটা বুঝতে হলে একটু ব্রিটিশ-ভারতের সময়ে ফিরে তাকানো দরকার। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিকিমের উপর আধিপত্যবাদীদের লোভাতুর দৃষ্টি ছিল সবসময়ই। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে প্রতিনিয়ত নেপালের গোর্খা রাজ্যের হামলায় উৎকণ্ঠিত ছিল সিকিম। গোর্খা রাজ্য হামলা চালাত সংলগ্ন ব্রিটিশ ভারতের রাজ্যগুলোতেও। তাই সহজেই সে সময় সিকিম ও ব্রিটিশ রাজ গোর্খাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ১৮১৪ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ-নেপাল যুদ্ধে নেপাল পরাজিত হয়। আর এক চুক্তি অনুসারে সিকিম ফিরে পায় নেপাল অধিকৃত তার অংশগুলো।
আর এ সুযোগে বৃটিশরা সিকিমের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তারা সিকিমের রাজাকে চাপ প্রয়োগ করে দার্জিলিং নিজেদের করায়ত্ত করে নেয়। এ পাহাড়ি এলাকাটি চমৎকার অবকাশ যাপন কেন্দ্রের পাশাপাশি তিব্বতের সাথে তাদের বাণিজ্যিক পথ স্থাপনের সুবিধা করে। তবে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি হয়েছিল যে, দার্জিলিংয়ের জন্য তারা সিকিমকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করবে।
কিন্তু এ কর নিয়ে অচিরেই ব্রিটিশ ভারত ও সিকিমের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। এছাড়া সিকিমের শ্রমিক শ্রেণীর অনেক অধিবাসীই উন্নত জীবনব্যবস্থার জন্য ব্রিটিশ অধিকৃত অংশে জীবনযাপন শুরু করে। সিকিমের রাজা জোরপূর্বক তাদের ফেরত আনার চেষ্টা করলে ব্রিটিশরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৮৪৯ সালে দুই ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তি সিকিমে এলে সিকিম প্রশাসন তাদের বন্দী করে রাখে।
এসব কিছুর জের ধরে সিকিমে আবার ব্রিটিশ সৈন্যদের আগমন শুরু হয়। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশরা গোটা দার্জিলিং সহ সিকিমের অনেকখানি অংশ পুরোপুরি দখল করে ফেলে। আবার নতুন চুক্তি হয়। সিকিম ব্রিটিশ ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়, সিকিমে ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়। এসবের ফলে সিকিম অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকলেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। এরপর ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্ক অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যায়। তবে ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসেবে সিকিমের স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিল।
এ সময় ভারতের সাথে যোগ দেয়ার প্রশ্নে সিকিমে সেই বিখ্যাত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। আর সিকিমের সাধারণ জনতা ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ নামক একটি দল সে সময় রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তাদের চাপে ১৯৫০ সালে সিকিমের ১১তম চোগিয়াল (সিকিমের রাজার উপাধি ছিল চোগিয়াল) থাসি নামগয়াল ভারতের সাথে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন।
এ চুক্তি অনুসারে ব্রিটিশদের মতো নেহেরুও সিকিমকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে ভারতের হাতে সিকিমের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে সিকিম ছিল পরিপূর্ণ স্বাধীন। এছাড়া ভারত কর্তৃক একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধিও নিয়োগপ্রাপ্ত হয় সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে। বলা যায়, এর মাধ্যমেই রোপিত হয়েছিল সিকিমের পরাধীনতার বীজ।
ইতিহাসের এ পর্যায়ে এসে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের দিকে নজর দেয়া দরকার। কাজী লেন্দুপ দর্জি, সিকিমের পরাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত নাম। লেন্দুপ দর্জির ও সিকিমের রাজপরিবারের মধ্যে ছিল দীর্ঘস্থায়ী বংশগত শত্রুতা। তিনি রাজতন্ত্রেরও বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে সিকিম প্রজামন্ডল নামক একটি দল গঠন করে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সিকিমের আরো কয়েকটি দলকে একীভূত করে গঠন করেন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’। এ দলের মূল লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের অবসান করে গণতন্ত্রের প্রচলন করা।
এদিকে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন চোগিয়াল থাশি নামগয়াল এবং ১৯৬৪ সালে নেহেরু মারা গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। এ সময় ভারতের ক্ষমতায় আসেন ইন্ধিরা গান্ধী। তিনি সিকিমের প্রতি নেহেরুর মতো ততটা সদয় ছিলেন না। নেহেরু এই ক্ষুদে সিকিমকে ‘বিরক্ত’ করে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা’ হিসেবে নিজের খ্যাতির বারটা বাজাতে চাননি। ১৯৬০ সালে এক সাক্ষাৎকারে নেহেরু বলেছিলেন, “জোরপূর্বক সিকিম দখল করা হবে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো ঘটনা।” তবে নেহেরুর আগ্রহ না থাকলেও সেই মশা মারতে তার কন্যার আগ্রহের কমতি ছিল না।
অবশ্য ইন্ধিরার এ আগ্রহের পেছনে বেশ কয়েকটি প্রভাবকও ছিল। প্রথমত, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ভারতের কাছে সিকিম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, ভৌগলিক দিক থেকে সিকিমের পশ্চিমে নেপাল, উত্তর-পূর্বে চীনের তিব্বত, পূর্বে ভুটান এবং দক্ষিণে পশ্চিম বাংলা। এছাড়া ভারতের ভয় ছিল সিকিম হয়তো স্বাধীনতার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে পারে বা চীনের সাহায্য চাইতে পারে। আর রাজা পানডেলকেও সন্দেহের চোখে দেখত ভারত। তার আমেরিকান স্ত্রীর সম্পর্কে সিআইএ এজেন্ট হওয়ার গুজবও প্রচলিত ছিল।
তাই এ সময় ভারত ঘরের শত্রু বিভীষণ হিসেবে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। তারা লেন্দুপ দর্জিকে সহায়তা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে লেন্দুপ দর্জি স্বীকার করেন যে, ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স থেকে তাকে অর্থ এবং করণীয় বাতলে দেয়া হতো। ভারতের মতো একটি শক্তিকে পেছনে পেয়ে লেন্দুপ দর্জি একের পর এক ক্ষমতার সিঁড়ি টপকাতে শুরু করে।
‘র’-এর তৎকালীন পরিচালক অশোক রায়নার বই ‘ইনসাইড র‘ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালেই ভারতের সিকিমকে দখল করবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এর পরের দুই বছর ‘র’ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কাজ করে যায়। সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে তারা সেখানকার নেপালী হিন্দুদের, বৌদ্ধ চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে এবং দাবি তোলে রাজতন্ত্রের অবসানের । আন্দোলন, খুন-জখম ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে এতটাই ঘোলাটে করে ফেলা হয় যে, সিকিমের অভিজাত হিন্দু সমাজ ভাবতে শুরু করে, “এ বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে থাকার চেয়ে আমাদের জন্য ভারতীয় হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে“।
এদিকে এ সবকিছু যে ভারতের ইন্ধনে হচ্ছে তৎকালীন চোগিয়াল পালডেন তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। তিনি মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরুর ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তাদের উত্তরসূরীরা যে তার সিকিমের রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে উঠতে পারে, ঘোর দুঃস্বপ্নেও তা তার মাথায় আসেনি।
অবশ্য ভারতও তাকে বুঝতে দেয়নি। তারা ডাবল গেইম খেলছিল। একদিকে তারা পালডেনকে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগিয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে তাকে ভারতের বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা কানে তোলেননি। সেসময় পালডেন দাবার চালগুলো একটু বুদ্ধি খাটিয়ে খেললে আজ হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো।
১৯৭০ সালের দিকে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস দেশব্যাপী নতুন করে সুষ্ঠু নির্বাচন ও নেপালী জনগোষ্ঠীর অধিক অংশগ্রহণ দাবি করে। এরপর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে। আর দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলনে সিকিমের আরো কয়েকটি দল যোগ দিলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়। এ আন্দোলন একসময় পরিণত হয় রাজতন্ত্রের পতন আন্দোলনে।
পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে চোগিয়াল ভারতের সাহায্য কামনা করেন। ভারত প্রশাসন তাকে চাপে ফেলে চোগিয়ালের ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে খর্ব করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এ সংবিধান অনুসারে প্রায় সব ক্ষমতাই চলে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। এরপর ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জি অস্বাভাবিক ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসনই তার দল লাভ করেছিল।
নির্বাচনে জিতে লেন্দুপ দর্জি সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তখনও চোগিয়াল সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রয়ে গিয়েছিলেন। পরে ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জি কেবিনেট মিটিংয়ে রাজতন্ত্র বিলোপের প্রশ্নে গণভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অচিরেই চারদিক থেকে গণভোটের ফলাফল আসতে শুরু করে যে, “জনগণ রাজতন্ত্র চায় না“। অবশ্য অভিযোগ আছে, পুরো বিষয়টিই ছিল সাজানো। ভারতীয় সেনাবাহিনী জনগণকে বাধ্য করেছিল রাজতন্ত্রের বিপক্ষে ভোট দিতে।
এভাবে অবসান ঘটে চোগিয়াল পদের। এরপর ৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে সকালে উঠে চোগিয়াল পানডেল দেখতে পান ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে তার প্রাসাদ। প্রাসাদের ২৪৩ জন পাহারাদারকে কব্জা করতে পাঁচ হাজার ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধা ঘন্টার বেশী লাগেনি। পানডেল বন্দী হন আর সিকিমের পতাকাকে হটিয়ে সিকিমের আকাশ দখল করে ভারতের তেরঙ্গা পতাকা।
এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। ভারতের কেনা গোলাম লেন্দুপ দর্জি সিকিমকে প্রদেশ করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানান। এরপর ১৪ এপ্রিল আবার এক ‘গণভোটে’ সিকিমের জনগন এ আবেদনে ‘সম্মতি’ জানায়। অবশেষে ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিম অফিশিয়ালী ভারতের ২২তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, জাতিসংঘে চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ এ দখলদারি নিয়ে উচ্চবাচ্যও করেনি।
সিকিমের তরুণ প্রজন্ম তাদের এ সকল নেতাদর কীর্তির কথা ভেবে আজও লজ্জায় মুখ লুকোয়, যাদের কল্যাণে একসময়কার স্বাধীন সিকিম আজ পরিচিত ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ হিসেবে, আর রাজধানী গ্যাংটক ‘ভারতের অন্যতম পর্যটন শহর’।