কপালপোড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট এখনো রাজনৈতিক বিভাজন। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। যেনতেনভাবে অন্যকে সমূলে উৎপাটন করাই হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের একমাত্র ব্রত। মানুষে মানুষে কোনো সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব, মায়া, প্রেম ও সহনশীলতা নেই। যার ফলশ্রুতিতে ২০২৪ এর জুলাই নেমেছিল বাংলাদেশে। কোল খালি হলো কত মায়ের! অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাজারো মানুষ! একাত্তরের ভয়াল ট্রাজেডি পার হয়ে আসা একটা জাতিরাষ্ট্রের এমন দিন কেন দেখতে হবে? কেন আমরা নিজেদেরকে শুভবোধে বদলাতে পারি না? কেন অতীতের গতানুগতিক, সস্তা ও ক্লীশে ছায়া থেকে বের হতে পারি না?
কেন কবি হরিশচন্দ্র মিত্র এই দেশের জন্য আর কবিতা লিখতে পারেন না:
আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।
আগের কথা নাইবা বলি। গেল ১৭ বছর বাংলাদেশের মানুষকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখানো হয়েছে, অনুধাবন করতে বলা হয়েছে, এক লহমায় সেই ইতিহাস আজ বাতিল বলে গণ্য হয়েছে। নাহ্! স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌল বিষয় কেউ অস্বীকার করেনি। বাদ গেছে একজন ব্যক্তি ও একমাত্র দল বন্দনা। স্পষ্টভাবে ৩০ লাখ শহীদের কথা এখন আর বলা হচ্ছে না বটে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের ২০২৪ এর ক্রোড়পত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছেন, 'লাখ লাখ শহিদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা' তিনি তাঁর বাণীতে বিজয় দিবসকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গৌরবময় এবং স্মরণীয় দিন বলে উল্লেখ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর বাণীতে বলেছেন, 'লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।'
ক্রোড়পত্রের একটা জায়গায় এসে খটকা লেগেছে। রাষ্ট্রপতি বলছেন, 'স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও নানা চড়াই উতরায় পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায় দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।'
অপরদিকে '১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ এক নতুন বিজয় দিবস' শীর্ষক নিবন্ধে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, 'সমগ্র বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের) বাঙালি সৈনিকগণের উপর হামলা হলেও আত্মরক্ষা করা ছাড়া তারা সংঘটিত হতে পারেনি। এর মধ্যে বহু তরুণ অফিসার এবং সৈনিকদের শহিদ করা হয়। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সমগ্র জাতি দিকনির্দেশনা বিহীন থাকে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত।
অবশেষে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্রের রিলে যন্ত্রের মাধ্যমে ৮ম বেঙ্গলের মধ্য র্যাংকের অফিসার, মেজর (পরবর্তীকালে সেক্টর কমান্ডার, সেনাপ্রধান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান স্বউদ্যোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তাহলে এক ক্রোড়পত্রে আমরা দুই দুইটা স্বাধীনতার ঘোষণা দিবস পেলাম। যতদিন না স্বাধীনতার এই ফান্ডামেন্টাল বিষয়ে এই জাতি এক হতে পারবে ততদিন আসলে বিজয় বা মুক্তির কথাগুলো খুবই হাস্যকর শোনাতে থাকবে।
আজকের বিজয় দিবসের সরকারি ক্রোড়পত্রে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ও স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি শেখ মুজিবের নাম নেয়া হয়েছে। ঐ সময়ের একমাত্র নেতাও বলা হয়েছে। তবে অনেকটা তাচ্ছিল্যভরে।
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে লিখেছেন, 'বলা হয় যে, ওই সময় মানে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ গভীর রাতে শেখ সাহেবের চিরকুট নিয়ে কেউ একজন তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজেবি) এর প্রধান কেন্দ্র পিলখানায় স্থাপিত বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ দাবি যৌক্তিকতা একেবারেই নেই বলে আমি মনে করি। কারণ যখন পরিকল্পিতভাবে পাক-বাহিনী ২৫ তারিখের আগের প্রহরেই সমস্ত প্রচারযন্ত্র, রেডিও এবং সমস্ত ওয়্যারলেস কেন্দ্র দখলে নিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে তৎকালীন ইপিয়ার এর মতো পিলখানায় অবস্থিত বেতারকেন্দ্র (ওয়্যারলেস) স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বাঙ্গালীদের দোসর হয়ে কাজ করবে এমন তথ্য ধোপে টেকে না।'
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শহিদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদের লেখা 'নেতা ও পিতা' বইতেও এমন রেফারেন্স আছে। মিজ আহমদ বলেছেন, '২৫ মার্চ রাতে তাঁর বাবা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করে নিয়ে গেলেও শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর পাননি।'
যেহেতু এটি এখনো মীমাংসিত বিষয় নয়, তাই শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে আমরা 'প্রশ্নবোধক' মার্কিং-এ রাখলাম। তাই বলে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'- মিথ্যা হয়ে যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, পিএইচডি তাঁর 'বিজয় দিবস: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনিবার্য বিজয় ঘোষণার স্মৃতিবহ দিন' শীর্ষক নিবন্ধে ১৯৬২'র ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৭০ এর নির্বাচন; সবই উল্লেখ করেছেন। নেই শুধু শেখ মুজিব। একাত্তর পূর্ববর্তী এসব রাজনৈতিক বাঁকবদল তো হাওয়া থেকে হঠাৎ উদয় হয়নি, তাই না? কেউ না কেউ তো এসবের পেছনে কারিগর হিসেবে ছিলেন।
তবে ইতিহাসের দাবি মেনে স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনিবার্যভাবেই তাঁর নাম আসতে হবে। তবে বিএনপি বর্ণিত স্বাধীনতাযুদ্ধের একচ্ছত্র ও একমাত্র নেতা জিয়াউর রহমান এমন ভাবনার সাথেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বড় কন্ট্রাডিক্ট করে।
প্রথমে এককভাবে দিলেও চূড়ান্তভাবে শেখ মুজিবের পক্ষেই মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, এটাই সত্য। কারণ চৌকষ সেনা অফিসার হিসেবে জিয়া জানতেন স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার ম্যান্ডেট ভোটের মাধ্যমে শেখ মুজিবকেই দিয়েছে মুক্তিকামী বীর জনতা।
ঐতিহাসিক সত্য এই স্বীকৃতিটুকু মেজর জিয়াকে দিতে কৃপণতা ও হীনমন্যতাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটিকে চরম Despotic & Single-minded করে তুলেছিল। সবখান থেকে তারা এখন হাওয়া -তিপ্পান্ন বছরে এটাই তাদের খুব বাজে অর্জন!
আজকের রাষ্ট্রীয় ক্রোড়পত্রে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা, কাদেরিয়া বাহিনী, ক্র্যাকপ্লাটুন, বিচ্ছু বাহিনী এবং বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেসের অগ্রগামী ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নেই শুধু মুজিব-তাজউদ্দিন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির ভূমিকা।
মোটাদাগে এর প্রধানতম কারণ কী?
বিগত সরকারের প্রধান নির্বাহী আমরা যাকে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলি এবং মার্কিন গণমাধ্যম 'টাইমস ম্যাগাজিন' যাকে আইরন লেডি বলে উল্লেখ করত; তিনি আসলে জীবনের আসল আয়রনি বুঝতেন না। তার চারপাশে এক অদ্ভুত আয়না সাজিয়ে রেখেছিলেন। যে আয়নাতে কেবলই তার 'পিতার মুখ, নিজের মুখ আর স্বজন হারানোর বেদনা' দেখতে পেতেন। বিরাট নার্সিজমে ভুগতেন তিনি। একই ঘূর্ণাবর্তে চক্কর খেতে খেতে বাংলাদেশ বলতে পিতা-মাতা ও স্বজন বুঝতেন। কার্যত ওই নার্সিসিস্ট মিরর তাকে দলবলসহ ডুবিয়েছে। বহু গবেষণা, স্টাডি ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে ইতিহাসের প্রশ্ন খণ্ডন করবার সামর্থ্য অর্জন শিকেয় তুলে ক্ষমতার জোরজবরদস্তিকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন তিনি। সত্যনিষ্ঠ জ্ঞান ও যথার্থ উপলব্ধি চিরকালীন মর্যাদা পায়, পক্ষান্তরে ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করে।
আজকের বিজয় দিবসে শেখ মুজিব নেই এর একমাত্র ও প্রধান কারণ ওই ভুলভাল আয়না। যে আয়নায় সবাই কেবল নিজের মুখ দেখেই আত্মতুষ্টি পায়। এই আয়না যতদিন না ভাঙবে এই অচলায়তনও সচল হবে না। সবার কাঙ্খিত সুন্দর সহাবস্থানে দেশও আর এতটুকু এগোবে না।
লেখক: সাংবাদিক
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪