Posts

উপন্যাস

ভোরের পাখির গান

December 16, 2024

গোলাম কিবরিয়া লিমন

112
View

১.
আজও ঘুম ভেঙে গেল লতিফা বানুর।মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন।আজও হলেন।কিন্তু প্রতি রাতেই ঘুম তার এই বিরক্তিকে সামান্য পরিমাণ সম্মানটুকু না দিয়েই বিদায় নেয়।
যদিও সময়টা লতিফা বানু জানেন।এরপরও ঘড়ির দিকে তাকালেন।রেডিয়াম লাইটের ডিজিটাল ঘড়িতে স্পষ্টতই রাত সাড়ে তিনটা।আধ ঘণ্টা দেরিতে ঘুম ভাঙায় বেশ অবাকই হলেন।প্রতি রাতে ঘুম ভাঙার পর তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন রাত তিনটা;আজ সাড়ে তিনটা।অনিয়মেরও অনিয়ম হওয়ায় তার মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেলো।
লতিফা বানু চোখ বুজে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছেন।তার ছেলেটা পড়াশুনার জন্য ভিন্ন শহরে যাওয়ার পর থেকেই তার ঘুম আরো কমে গেছে।ছেলে প্রায়ই যোগাযোগ করে,ইদানিং কমিয়ে দিয়েছে।ছেলেটা শারীরিকভাবে কিছুটা দূর্বল প্রকৃতির,প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে।সেই চিন্তায় তাও ঘুম হয় না।অবশ্য তার মেয়ের জামাই তাকে নিয়মিত তত্ত্বাবধানেই রাখে।ছেলটা চিকিৎসক,লতিফা বানুকে ঠিক নিজের মায়ের মতোই খেয়াল রাখে।

শুয়ে এপাশ ওপাশ করতেও তার ভালো লাগছে না।ছেলেটার জন্য মন কেমন কেমন করছে।তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন।একবার ভাবলেন ছেলেকে ফোন করবেন।কিন্তু এ মধ্যরাতে তো তার ছেলে নিশ্চয়ই সজাগ হয়ে বসে নেই।
লতিফা বানু একটা টুল নিয়ে এসে জানালার পাশে বসলেন।আকাশ থেকে খুব ধীরে ধীরে বোধ হয় কালচে ভাব সরে যেতে আরম্ভ করেছে।তাজা বাতাস লতিফা বানুর চেহারায় আবেশ বুলিয়ে যাচ্ছে।দিনের প্রথম বাতাস নাকি অতি স্বাস্থ্যকর।
সায়েরাকে ডেকে গল্প করতে পারলে ভালো লাগতো।সারদিন ব্যস্ত থাকে মেয়েটা।একটু পরই উঠে রাজ্যের ঝামেলায় ঢুকে পড়বে।ঘুমুচ্ছে ঘুমোক।
সায়েরা বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করার মেয়েটি।ও-ই লতিফা বেগমকে আগলে রাখে।সকাল আটটা থেকেই বাড়ির সমগ্র দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে লতিফা বেগমের মা হয়ে যায়।তিনি যেন হয়ে যান সায়েরার ছোট্ট খুকি।
লতিফা বানুর কেমন যেন একা একা লাগতে থাকে।বাইরের অতি শান্ত ঝিরিঝিরি বাতাসের ঝাপ্টা তার একাকীত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।


২.
"কিরে,আইজকা উঠবি না নাকি?"
যদিও কথাটা ধমকের সুরে বলা কিন্তু তার মাঝেও গভীর স্নেহ মাখানো আছে।
চোখ খুলে নুরি দেখে টাটকা মিষ্টি রোদ ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।বিছানার সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন জাহানারা ভাবী।
নুরি উঠে বসলো।আসলেও ঘুমটা বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছে।তবে এতো মাস পর এমন প্রশান্তির ঘুম লম্বা হওয়াটা খুব একটা গুরুতর অন্যায়ের মধ্যে পড়ার কথা না।
" নে...উঠ উঠ," জাহানারা ভাবী বললেন,"নাশতার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।রান্না করছে তোর ভাই নিজে।ব্যাটা মানুষ যে ক্যামনে এতো সুন্দর খিচুড়ি রান্না করা শিখলো!"
দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নুরি মাঠে এলো।একটা উৎসব উৎসব ভাব চারদিকে।সবার চেহারাই বেশ হাসিখুশি।মূলতঃ ইব্রাহিম ভাই এর রান্না করা খিচুড়ি নিয়েই সবার উৎসাহ।
নুরিকে দেখে ইব্রাহিম ভাই বললেন,"কিরে উঠলি! আইজকার দিনটা ভোরে উঠতে পারলে ভালো হইতো,বাংলাদেশর প্রথম সূর্যটা উঠতে দেখতে পারতি।এই চান্স আর কোনো দিন আইবো না।"
জাহানারা ভাবী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,"থামেন...হইসে।এইটুকুন মাইয়া ম্যালা দিন পর ভালো ঘুমাইসে।"
এরপর নুরির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন,"আয় বইন,বস্।"
ষোল বছর বয়সী নুরীকে গতকাল এই প্রাইমারি স্কুল ভবনে গড়ে ওঠা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেছে কমান্ডার ইব্রাহিমের মুক্তিবাহিনীর এই দলটি।যুদ্ধ শুরুর কিছু দিন পর নুরিকে তার বাড়ি থেকে ধরে আনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।তার আগে নুরির মা-বাবাকে ঘরের ভেতর হাত পা বেঁধে সেই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।নুরির তখন ঘোর লাগা অবস্থা।এক ছ'ফুটি জওয়ানের ডান হাতের ভাঁজে সে আটকে ছিলো।এর মাঝেও চিৎকার করেছে,ঝাপটাঝাপটি করেছে।কাজ হয়নি।
খিচুড়ি খেতে খেতে কমান্ডার ইব্রাহিম বললেন,"আজকে কিন্তু মনে হয় আমাদের অনেকেরই এক লগে শেষ খাওয়া।"
কথাটায় সবারই মন খারাপ হয়ে গেলো।দীর্ঘ ছয় মাস সবাই এক সাথে স্বামী স্ত্রী ইব্রাহিম ও জাহানারার দলে থেকে যুদ্ধ করেছে।কতো সুখ দুঃখের স্মৃতি জমা হয়েছে একসাথে।ঢাকার শাহেদ,নেত্রকোনার বীরেন,লালমনিরহাটের পলাশ-ছ'মাস আগে এক সাথে যাত্রা শুরু করলেও ওরা আজ নেই,লড়তে লড়তেই ঘুমিয়ে গেছে বাংলাদেশের পবিত্র মাটির উষ্ণ ভাজে।
ইব্রাহিম কিছুটা থেমে বললেন,"নুরিকে ওর আত্মীয়ের বাড়িতে দিয়া আসতে হবে।এই দায়িত্ব আমি ফারুককে দিলাম।"
ফারুক দলের অন্যতম সাহসী যোদ্ধা।বলা চলে গেরিলা দলটির দক্ষিণ হাত।যুদ্ধ শুরুর সময় সে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।আক্রমণের রাতেই প্রাণ বাঁচিয়ে হল থেকে পালিয়ে আসে।এক দেড় মাস বনে বাদাড়ে লুকিয়ে থেকে লোক মুখে জানতে পারে মুক্তি বাহিনী গঠিত হওয়ার কথা।এরপর খুঁজতে খুঁজতে দেশের ভেতরের এক দূর্গম অঞ্চলে বাঙালি সেনা অফিসারদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে কমান্ডার ইব্রাহিমের দলে সাথে অপারেশনে নামে।নুরিকে মূলতঃ ফারুকই উদ্ধার করেছে।
কমান্ডারের কাছ থেকে শেষ নির্দেশ পেয়ে ফারুক সম্মতি জানালো,"জ্বি আচ্ছা ভাই।"
নুরি মাথা নিচু করে তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছিলো।ফারুকের কণ্ঠ শুনে তার চোখের কোণা দিয়ে ফরুককে একটু দেখেই আবার চোখ নামিয়ে ফেললো।ফারুককে তার জ্বীনের মতো মনে হচ্ছে। গতকাল যখন ঘাটি গেড়ে থাকা  পাক বাহিনীর প্রধান মেজর লোকটি পরাজয় নিশ্চিত বুঝে সকল বন্দী মেয়েকেগুলি করে তাকে শেষ করার জন্য রিভলবারের নল তাক করেছে;ট্রিগার টেনে ধরার আগ মুহূর্তে ফারুক প্রায় উড়ে এসে মেজরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।গুলিটা ছিটকে দেয়ালে ঢুকে যায়।এরপর ফারুক খালি হাতেই দানবটাকে কাবু করে ফেলে।ভীত আর ঘোর লাগা চোখে নুরি সব দেখেছিলো।এমন শক্তি কোনো মানুষের গায়ে থাকতে পারে? কখনোই না!
কমান্ডার ইব্রাহিম বললেন,"নুরি,তোর ফুফুর বাড়ি কই জানি কইলি;নইলতাপাড়া গেরাম না?"
নুরি দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই হালকা করে ওপর নীচ মাথা নাড়লো।
"তাইলে রওনা দিয়া ফালা দুই এক ঘণ্টার মধ্যে," খাওয়া শেষে কমান্ডার ইব্রাহিম হাত ধুতে ধুতে বললেন,"আইজকা সবাই উল্লাসে আছে।রাস্তায় ভ্যান ট্যান পাইলে উইঠা যাইস।"


৩.
ঘরটার সামনে নুরি দাঁড়িয়ে আছে।ন'মাস আগে এই ঘরেই তাকে আছড়ে ফেলা হয়েছিলো।সঙ্গে নানা বয়সী আরো পাঁচ ছ'জন মেয়ে।রাত হতেই এক জওয়ান তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেলো।সেখানে বসা ছিলো সুপুরুষ  চেহারার পাকিস্তানি মেজর।নুরিকে তার সামনে ছুঁড়ে দিতেই জওয়ানকে তিনি বললেন,"হেরেমকি নেয়ি ফুল!"
জওয়ান দাঁত বের করে হাসি দিয়ে তাকে ফেলে চলে গেলো।
সেই থেকে শুরু,এরপর দিনের পর দিন প্রতিনিয়ত নুরিকে যেন জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ করা হয়েছে।একটা সময় তার যন্ত্রণার অনুভূতি বোঝার ক্ষমতাটুকুও চলে গেলো।সব সময়ই মনে হতো,যেন একটা অনন্ত নিঃশেষ অন্ধকারে সে আটকে গেছে।যে অন্ধকারে স্বয়ং মৃত্যুর ফেরশতাও বোধ হয় তাকে দেখতে পাচ্ছে না!
নুরি ঘরটায় আস্তে আস্তে ঢুকলো।গতকালও এটা ছিলো হাবিয়া দোযখের অংশ।ঘরের দেয়ালে রক্তের দাগ।তার সঙ্গেই ধৃত থাকা মেয়েদের রক্ত।কাউকেই পাক সেনারা বাঁচিয়ে রাখেনি।শুধু চরম ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছে সে।
নুরি রক্তের ওপর হাত দিয়ে তার তার অত্যাচারিতা বোনদের অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।ঝিনুতি গ্রামের শানু,পাংশা গ্রামের নববধূ মিনা বা এই স্কুলেরই শিক্ষিকা হুমায়রা আপা- প্রত্যেকেই প্র্যত্যেকের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলো।
নুরি নয় মাসে পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিলো।চোখ দু'টো হয়ে গিয়েছিলো পাথরে খোদাই করা চোখ।তাই শত চেষ্টায় সে কাঁদতে পারেনি।কিন্তু আজ এই অদ্ভুত আনন্দের সময়ে তার কান্না পাচ্ছে। যে জায়গাটায় সুরাইয়াকে এনে ফেলা হয়েছিলো,সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে নুরি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।দুধ দাঁতও না পড়া মেয়েটাকে ধরে এনেছিলো পাকিস্তানি পশু গুলো।ঘরে আনার পর নুরির সাথে লেপ্টে বসে ছিলো টানা চার পাঁচ ঘণ্টা।মুখ দিয়ে কোনো কথা বলেনি কিন্তু ভয়ে কেঁপেছে ম্যালেরিয়া রোগীর মতো।রাতে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় "আফা,আমারে বাঁচান" বলে যে আর্ত চিৎকার ছেড়েছিলো তাতে হয়তো পৃথিবীর কঠিনতম হৃদয়ের মানুষটিরও মন গলে যাওয়ার কথা।তবে পাক সেনাদের মধ্যে অন্তর নামের ব্যাপারটিই নেই,তাই তা গলার প্রশ্নও আসে না।
নুরি সহ বাকি মেয়েরা জওয়ানটাকে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো।বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার পর মেজরের রুম থেকে বড় জোর পাঁচ মিনিট শিশু কণ্ঠের চিৎকার শোনা গিয়েছিলো।এরপর আর কখনোই নুরি বা ওর সঙ্গের মেয়েরা সুরাইয়াকে দেখেনি।
নুরির কাধে হাত পড়তে সে ঘাড় ঘুরিয়ে জাহানারা ভাবীকে দেখতে পেলো।তিনি নুরিকে ধরে দাঁড় করালেন।এরপর বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,"আল্লাহর নাম নিয়া নতুন জীবন শুরু কর্,বইন।"
'নতুন জীবন' কথাটা নুরিকে ধাক্কা দেয়।নতুন জীবনই শুরু করতে হবে তাকে।
পুরোনো জীবনটা তার খারাপ ছিলো না।গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে বাবা মা আর দাদীর সাথে বেশ চলছিলো।কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু'দিনের মধ্যেই তাদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে।তাদের বাড়িতে ঢুকে প্রথমে দাদীকে গুলি করে হত্যা করে।এরপর বাবা মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে নুরিকে ধারে নিয়ে আসে।
নুরির শুধু এক ফুপু আছেন নইলতাবাড়ি গ্রামে।বেঁচে আছেন কিনা তাও তো সে জানেনা।থাকলেও নুরির মতো 'নষ্ট ' হয়ে যাওয়া মেয়েকে কি তিনি আদৌ গ্রহণ করবেন!
নুরির তেমন মনে হয় না।হয়তো তার বাকি জীবনটা কাটবে কোনো নিষিদ্ধ পাড়ায়।সমাজের অচ্ছুৎদের মাঝে সেই সম্প্রদায়েরই একজন হয়ে।

নুরি জাহানারা ভাবীর সাথে স্কুল মাঠে ফিরে এলো।ফারুক তৈরি হয়ে আছে যাওয়ার জন্য।কাঁধে রাইফেল।রাস্তায় এখনও নাকি দুই একজন রাজাকার-মিলিটারি ঝামেলা করার চেষ্টা করছে।তাদের থেকে নিজেদের রক্ষার্থে কমান্ডার এটা দিয়েছেন।পরে অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় ফেরৎ দিয়ে দেবে।
নুরি স্কুল ভবনের ডান দিকের ঘরের বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালো।ওখানেই মেজরকে বেঁধে রাখা হয়েছে।অন্য সব পাকি জওয়ানকে মেরে ফেলেছিলো মুক্তিযোদ্ধারা।
নুরির ইচ্ছে করছিলো ঘরে ঢুকে মেজরের চোখ দু'টো তুলে আনে।
স্কুলের পেছনের দিকে তার সঙ্গের চার বন্দিনীর কবর।সে জাহানারা ভাবীকে বললো,"ভাবী,কবর জিয়ারত কইরা আসি?"
জাহানারা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,"যা...তাড়াতাড়ি শেষ করিস।"
নুরি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগলো।ইব্রাহিম ভাইয়ের গেরিলা দল আরেকটু আগে স্কুলের মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে হয়তো সব বন্দিনীই বেঁচে যেতো।কিন্তু নুরির মনে হচ্ছে সে নয়,সত্যিকার অর্থে কবরে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা তার ঐ  বোন গুলোই বেঁচে গিয়েছে।


৪.
পথে আক্ষরিক অর্থেই উৎসবের আমেজ ছিলো।নয় মাসের চাপা ভয় যেন হঠাৎ উবে গেছে।একটু পর পরই 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে মিছিল বের হচ্ছে।ফারুকের কাঁধের রাইফেল আর পরনের পোশাক দেখেই মানুষ বুঝে ফেলছে যে সে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা।কাজেই কোলাকুলি ও করমর্দন করতে করতে ফারুকের ঘাম ছুটে গেলো।
আপাতত ফারুকের চিন্তা নুরিকে নিরাপদে নইলতাবাড়ি পৌঁছে দিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব কুষ্টিয়ায় তার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া।মা-এর সাথে যোগাযোগ হয় না প্রায় তিন চার মাস হয়ে গেলো। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তা-ও সে জানে না।বয়স্কা মানুষ;তার চিন্তায় রাতের পর রাত জেগে থাকতেন। মা এর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়ার আশংকায় ফারুক নিজেই তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো।
মানুষজনের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে ফারুক ও নুরি নইলতাবাড়ি গ্রামে পৌঁছে গেলো।ফুপ বাড়ির উঠোনে বসে ছিলেন।নুরি হরিণের মতো দৌড়ে গিয়ে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়লো।
ফুপু ভূত দেখার মতো চমকে উঠে কয়েক মুহূর্ত নুরিকে দেখলেন;তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন,"তুই ক্যামনে আইলি মা!"
ঘরের ভেতর থেকে নুরির ফুপাও বের হয়ে এলেন।চোখ মুছতে মুছতে জড়িয়ে ধরলেন ফারুককে।
মিলিটারিরা নুরির দুই ফুপাতো ভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।তাদের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ফুপু দুপুরের খাবারের আয়োজন করলেন।ভাত আর পাটশাক।তাদের বাড়ির পোষা গরু-ছাগল ও হাস মুরগী গুলো মিলিটারি এবং রাজাকাররা লুট করে নিয়ে গেছে।
খাওয়া শেষে ফারুককে বিশ্রামের জন্য একটি ঘর দেওয়া হলো।সে প্রচন্ড ক্লান্ত;দীর্ঘ পথ হাঁটায় পা দু'টো টনটন করছে।ঘুমোনো দরকার।
হঠাৎ ফুপা ঘরে ঢুকলেন।ফারুককে দ্রুত উঠে বসতে দেখে বললেন,"তাড়া নিয়েন না,বাজান..."
ফারুক বললো,"জ্বী ঠিক আছে।"
তিনি ঘরের কোণায় রাখা একটা জলচৌকিতে বসতে বসতে বললেন,"আমার দুই পোলা এই ঘরে থাকতো।দুই জনেরই রাজপুত্তুরের মতো চেহারা ছিলো। জুলাই মাসে ওদের এক লগে বিয়া ঠিক করছিলাম।"
ফারুক স্মিত হাসলো।
ফুপা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।চোখের কোণা থেকে পানি মুছে ফারুকের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত কণ্ঠে বললেন,"একটা কথা ছিলো।"
"বলুন।"
"নুরি অনেক মাস ক্যাম্পে আটকা আছিলো তাই না?"
"জ্বী,ও সহ আরো অনেক মেয়েকে ওরা আটকে রেখেছিলো..."
"জানোয়ার গুলিরে," ফুপা হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন।কিন্তু পর মুহূর্তেই থেমে গিয়ে আবার বিষাদ মাখা কণ্ঠে বললেন,"তয় বাজান...আমরা তো সমাজে থাকি।দশ গেরামের মানুষ কি অহন আমাগো নুরিরে মাইনা নিবো!"
ফারুক বিস্মিত হয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো।ফুপা  আমতা আমতা করে বললেন,"নুরির ফুফুজান কইলো যে অয় নাকি পোয়াতি।"
ফারুক হঠাৎ বুঝতে পারলো যে নুরির  ফুপা নুরিকে তার বাড়িতে রাখতে চাইছেন না।
ফুপা বলে চলেছেন,"বিয়া বাদে মাইয়া পোয়াতি।আমার তো সমাজে চলা লাগবো,মানে বাজান ব্যাপারটা তো বুঝতেছেনই..."
কথা শেষ না করে তিনি কপালে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলেন,"খোদা,আবার কোন নতুন পরীক্ষায় ফালাইলা..."


৫.
গ্রামের শেষ মাথায় একটা লম্বা দিঘী।বর্ষায় টইটম্বুর থাকে,এই শীতে ঋতুতে পানি তেমন নেই।টলটলে পানির নীচে ছোট ছোট মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে।মাঝে মাঝে ঠোকর দিচ্ছে নুরির কোমল পায়ে।
নুরি দীঘির পানিতে পা চুবিয়ে বসে আছে।ওর তেমন একটা শীত লাগছে না।কান্নাও পাচ্ছে না।নুরি জানে,তার মতো নষ্ট মেয়েদের চোখের পানি আসলে আবর্জনার মতো।সে ঠিক করেছে ফারুক নামের লোকটা চোখের আড়াল হলেই গলায় ইট পেঁচিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেবে।বন্দী দশায় নতুন দিনের আশায় দাঁতে দাঁতে চেপে সে বেঁচে ছিলো।এখন ঐ ভুলটা শোধরাতে হবে।
ফারুক নিজে একটু দূরে পায়চারি করছে।মা-এর চিন্তাটা বেশি হচ্ছে।ভেবেছিলো নুরিকে ওর ফুপুর বাড়িতে দিয়েই রওনা দেবে।কিন্তু তিনি তো নিজ ভাতিজিকে গ্রহণ করতে পারলেন না।
ফারুক হেঁটে হেঁটে নুরির সামনে গেলো।ছিপছিপে গড়নের ছোট্ট একটা মানুষ।চেহারায় কিশোরিসুলভ কমনীয়তা যেন মিইয়ে গেছে।এই মেয়েটার কি চমৎকার জীবন হওয়ার কথা ছিলো। হয়ত ওর অজস্র স্বপ্ন ছিলো,উঠানময় ছোটাছুটি ছিলো।পাকি হায়েনা আর দেশি শ্বাপদরা নুরির মতো কতো মেয়ের জীবন এমন খুবলে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছে!
ফারুকের নিজের জীবন নিয়ে কি কম স্বপ্ন ছিলো।কথা ছিলো ক'মাস পর অনার্স ফাইনাল দেবে।এরপর একটা চাকরি খুঁজে নিয়ে মা এর পছন্দে বিয়ে করবে।সুন্দর একটা সংসার হবে ওর।
পৃথিবীর মতো একটা চমৎকার জায়গা হঠাৎ নুরির মতো মানুষ গুলোর জন্য এমন কঠিন কেন হয়ে গেলো।ওদের তো কোনো অপরাধ নেই।
ফারুক নুরির কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো,রাইফেলটা কাঁধ থেকে নামালো।সে যা করতে যাচ্ছে এর মূল্যে হয়তো তাকে তার মা এর ভালোবাসা থেকে চিরকাল বঞ্চিত থাকতে হবে।সমাজ তার দিকে থুতু ছিটাবে।কিন্তু নুরির মতো একটা নিষ্পাপ মেয়েকে সে নিজের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারে না।
সে নুরির হাত ধরে বললো,"চলো..."
নুরি বোকার মতো ফারুকের মুখের দিকে তাকালো।ফারুক তাকে টেনে উঠিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।ফুপুর বাড়ির দিকে।
ফুপু তখনও উঠানে বসে কপালে হাত দিয়ে কাঁদছেন।ফাুপা বিমর্ষ মুখে বসে আছেন।
নুরিকে টানতে টানতে ফারুক ঝড়ের বেগে উঠানে প্রবেশ করলো।ফুপা ফুপু দুই জনের হতভম্ব চোখে চোখ রেখে ফারুক বললো,"আমি নুরিকে আজকেই বিয়ে করতে চাই। আপনারা কি আপনাদের মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবেন?"
নুরির এক হাত ফারুকের শক্ত পাঞ্জার মধ্যে আবদ্ধ।বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নুরি ফারুককে দেখছে।লোকটার মাথা খারাপ-এ ব্যাপারে ওর আর কোনো সন্দেহ নেই।



নুরির কেমন যেন অবাস্তব ধরনের একটা অনুভূতি হচ্ছিলো।দুই দিন আগেও তার বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় ছিলো,অথচ এখন সে একজন সুদর্শন সাহসী যুবকের স্ত্রী।এটা কি করে সম্ভব তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এখনই ঘুম ভেঙে যাবে,দেখবে সে এখনও শুয়ে আছে ঐ নোংরা ক্যাম্প ঘরটাতে। কোথা থেকে যেন একটা বুনো ফুলের গন্ধ আসছে।আচ্ছা! স্বপ্নে কি গন্ধ পাওয়া যায়! 
ফারুক লোকটা আসলেই জ্বীন।কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে তো তাকে বিয়ে করার কথা না।ফারুকের মনে কোনো খারাপ মতলব নেই তো! ওকে যদি হঠাৎ ত্যাগ করে!
কিন্তু এই মানুষটিই তো গতকাল নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করেছে।আজ সে একদম তার নিজের মানুষ,এই মানুষকে নুরি সন্দেহ করে কি করে!
ফারুক জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের জোছনা দেখছে।রাইফেলটা একটা চেয়ারের ওপর।খাটের ওপর মাড় দেওয়া সবুজ রঙের শাড়ি পরা এক কিশোরি বধূ।তার স্ত্রী। এতোক্ষণ বুঝতে পারেনি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে স্রষ্টা নুরিকে এক অন্য রকম সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করেছেন।হঠাৎ-ই যেন জগতের কোনো দুঃখ ওকে স্পর্শ করতে পারছে না।
ফারুক হারিকেনের আলো নিভিয়ে দিলো।নুরির হাত ধরে টেনে জানালার কাছে নিয়ে এলো।
নুরি লজ্জা মিশ্রিত চেহারায় নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ওর হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ ফারুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার জন্ম দিচ্ছে।
সে নুরিকে বললো,"চাঁদের আলোটা সুন্দর না?"
নুরি কিঞ্চিৎ মাথা নাড়লো।
মেয়েটার জড়তা কাটনো দরকার,ফারুক ওকে কিছুটা সহজ করতে জিজ্ঞেস করলো,"কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছো?"
নুরি মিনমিন করে বললো,"ক্লাশ সেভেনের ফাইনাল দিসিলাম,পাশ করতে পারি নাই।"
"আর পড়োনি কেন,পড়াশুনা ভালো লাগে না বুঝি?"
নুরি দৃষ্টি না উঠিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো।
ফারুক হেসে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে নুরিকে নিজের কাছে টেনে নিলো।
"নুরি,ঐ যে চাঁদটা দেখছো,আমরা হচ্ছি ঐ চাঁদের মতো," ফারুক বলে চললো,"কখনও আমরা জীবনে জোছনার আলোকচ্ছটায় উদ্বেলিত হই,আবার কখনও রাতে গভীর অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই। কিন্তু কখনও আমরা বেঁচে থাকা ছেড়ে দেই না।"
নুরি ফারুকের কথায় আগা মাথা বুঝতে পারছে না।মানুষ তো মানুষই,চাঁদ সূর্য হতে যাবে কেন!
ফারুক জিজ্ঞেস করলো,"তুমি কি আমার ব্যাপারে কিছু জানতে চাও?"
নুরি জিজ্ঞেস করলো,"আপনি কি জ্বীন?"
"না আমি মানুষ," ফারুক হেসে জবাব দিলো।এরপর এক হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,"ছুঁয়ে দেখো।"
নুরি আলতো করে হাতটা স্পর্শ করলো।এই হাত শক্ত কিন্তু পবিত্র।এই হাত অবলম্বন করে সে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে চায়।
ফারুক বললো,"নুরি,বাড়িতে আমার মা আর এক বোন আছেন।আমি জানি না তারা আমাদের মেনে নেবেন কিনা।
কিন্তু আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। স্ত্রী হিসেবে তুমি যে মর্যাদার অধিকারী তা রক্ষার জন্য আজীবন আমি তোমার পাশে থাকব।"
নুরিকে বুকে টেনে নিলো ফারুক।তার বুকে মিষ্টি স্পর্শে নুরি শান্তি বোধ করছিলো।তার এই একার পৃথিবীর একমাত্র নিরাপদ আবাস স্থল আজ থেকে ফারুকের বাহুডোর। সে জানে ফারুক তাকে ছেড়ে কখনও যাবে না।


৭.
ফারুক তার কথা রাখেনি।
গোপনে ফারুক স্ত্রীকে নিয়ে কুষ্টিয়া ফিরে গিয়েছিলো। নুরির শ্বাশুড়ি নুরিকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন।তিনি ফারুকের প্রতি গর্বিত ছিলেন।তবে ছেলে ও নবপুত্রবধূকে তিনি নিজের কাছেও থাকতে দেননি।তার মনেও একটাই ভয় ছিলো-সমাজ!
মা এর পরামর্শে ফারুক নুরিকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে এসেছিলো।যেখানে কেউ ওদের চিনতো না।সেখানে তারা দু'জন নতুন সংসার পাতলো।তৎকালীন নবগঠিত বাংলাদেশে ফারুক একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে ফেলেছিলো। ফারুকের আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবরা জানলো সে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ।
নুরির প্রথম সন্তানটি বাঁচেনি।খুব অল্প বয়সের জীবনে অজস্র দুঃখ নুরি পেয়েছে।তবে যে সন্তানের নিরাপত্তার জন্য নুরি নিজের পরিচয় পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হলো,সেই সন্তানকে হারিয়ে নুরি পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো।
তবে সময় খুবই অদ্ভুত জিনিস।যে কোনো আঘাতেই কীভাবে যেন মলম লাগিয়ে দেয়। এভাবে তার জীবনের অনেক দুঃখেই স্রস্টা শান্ত্বনার প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন।পরবর্তীতে দু সন্তানের জননী লতিফা বানু এক সময় তার নুরি নামটাও ভুলে গেলো।আজ তার এক মেয়ে ডাক্তার,ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।জীবন নামের বিস্ময়কর যে যাত্রার শেষটা নুরি ৭১ এর ডিসেম্বরেই একদিন দেখে ফেলেছিলো,ফারুক নামের মানুষটির হাত ধরে সেই পথের বহুখানি পথ সে বিজয়িনীর বেশে পাড়ি দিতে পেরেছে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ফারুক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কয়েক বছর আগে।অথচ পঞ্চাশ বছর আগের এক মায়াবী রাতে সে ষোলো বছর বয়সের নুরির হাত ধরে ওয়াদা করেছিলো,এই যাত্রায় সে শেষ অব্দি নুরির পাশে থাকবে।
আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিলো।লতিফা বানুর আকাশের দিকে তাকালো।পঞ্চাশ বছর আগের নুরির চোখ আকাশের কোথাও সেই রাতের ফারুককে খোঁজে প্রতিনিয়ত।ফারুকের কণ্ঠ শোনার জন্য নুরির কান ছটফট করে। ফারুক মিশে আছে এই বাংলায় বয়ে চলা বাতাসের প্রতিটি স্পর্শে। গান হয়ে সাহস দিয়ে যায় দেশের সকল ক্রান্তিকালে।
জানালার কার্নিশে মাথা রেখে লতিফা বানু অন্ধকার ছিন্ন  করে আসা অপরিচিত গান শোনে;ভোরের পাখির গান।






 

Comments

    Please login to post comment. Login