Posts

গল্প

আইনস্টাইন ও ইন্দুমালা

December 17, 2024

Aditta

Original Author বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

119
View

আইনস্টাইন কেন যে দার্জিলিং যাইতে যাইতে রানাঘাটে নামিয়াছিলেন বা সেখানে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে ‘On…ইত্যাদি ইত্যাদি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে উৎসুক হইয়াছিলেন—এ কথা বলিতে পারিব না। আমি ঠিক সেইসময়ে উপস্থিত ছিলাম না। কাজেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আমি আপনাদের নিকট সরবরাহ করিতে অপারগ, তবে আমি যেরূপ অপরের নিকট হইতে শুনিয়াছি সেরূপ বলিতে পারি।

আসল কথা, নাৎসি জার্মানি হইতে নির্বাসিত হওয়ার পর হইতে বোধ হয় আইনস্টাইনের কিছু অর্থাভাব ঘটিয়াছিল, বক্তৃতা দিয়া কিছু উপার্জন করার উদ্দেশ্যে তাঁর ভারতবর্ষে আগমন। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়া বেড়োইতেছিলেনও এ কথা সকলেই জানেন, আমি নূতন করিয়া তাহা বলিব না।

কৃষ্ণনগর কলেজের তদানীন্তন গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় একজন উপযুক্ত লোক ছিলেন। সেনেট হলে আইনস্টাইনের অদ্ভুত বক্তৃতা ‘On the Unity & Universality of forces’ শুনিয়া অন্য পাঁচজন চিন্তাশীল ব্যক্তিদিগের মতো তিনিও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার কলেজে আইনস্টাইনকে আনাইয়া একদিন বক্তৃতা দেওয়াইবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু প্রিন্সিপাল আপত্তি উত্থাপন করিলেন।

তিনি বলিলেন—“না রায় বাহাদুর, আমার অন্য কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এমন দিনে একজন জার্মান—”

রায়বাহাদুর উত্তেজিত হইয়া বলিলেন (যেমন ধরনের উত্তেজিত হইয়া তিনি উঠিতেন সন্ধ্যায় রামমোহন উকিলের বৈঠকখানায় ভাগবত পাঠের সময়, অন্য কেহ যদি কোনো বিরুদ্ধ তর্ক উত্থাপন করিত)—”সে কী মহাশয়! জার্মান কী? জার্মান? আইনস্টাইন জার্মান? ওঁদের মতো মহামানবের, ওঁদের মতো ঋষি বৈজ্ঞানিকের দেশ আছে? জাতের গণ্ডি আছে? আমি বলিলাম।

প্রিন্সিপাল বলিলেন—”আমিও বলছিনে যে তা আছে। কিন্তু বর্তমানে যেমন অবস্থা—” দুই প্রবীণ অধ্যাপকে ঘোর তর্ক বাধিয়া গেল।

প্রিন্সিপাল দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিত, তিনি মধ্যযুগের স্কলাস্টিক দর্শনের প্রধান আচার্য জন স্কোটাসের উদাহরণ দেখাইলেন। আয়ার্লন্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াও নবম শতাব্দীর গোঁড়াদিগের দ্বারা উৎপীড়িত হইয়া ফ্রান্সে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হন। আয়ার্লন্ডে আর ফিরিতে পারিয়াছিলেন কি? আসল মানুষটাকে কে দেখে! তাঁর মতামতেরই মূল্য দেয় লোকে।

যাহা হউক, শেষপর্যন্ত যখন প্রিন্সিপাল রাজি হইলেন না তখন রায়বাহাদুরকে বাধ্য হইয়া নিরস্ত হইতে হইল। ইতিমধ্যে তাঁহার কানে গেল আইনস্টাইন শীঘ্রই দার্জিলিং যাইবেন। ভারতবর্ষে আসিয়া অবধি নানাস্থানে বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত থাকার দরুন তিনি হিমালয় দেখিতে পারেন নাই, এইবার এত কাছে আসিয়া আর দার্জিলিং না-দেখিয়া ছাড়িতেছেন না।

রায়বাহাদুর ভাবিলেন দার্জিলিঙের পথে রানাঘাটে নামাইয়া লইয়া সেখানে এক সভায় আইনস্টাইনকে দিয়া বক্তৃতা দেওয়াইলে কেমন হয়?

রায়বাহাদুর গ্র্যান্ড হোটেলে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করিলেন।

আইনস্টাইন বলিলেন, “ভারতবর্ষের দর্শনের কথা আমায় কিছু বলুন।”

রায়বাহাদুর প্রমাদ গণিলেন। তিনি গণিতের অধ্যাপক; দর্শন, বিশেষত ভারতীয় দর্শনের কোনো খবর রাখেন না, তবু ভাগ্যে গীতা মাঝে মাঝে পড়া অভ্যাস ছিল, সুতরাং অকূল সমুদ্রে গীতারূপ ভেলা (কোনো আধ্যাত্মিক অর্থে নয়) অবলম্বন করিয়া দু-এক কথা বলিবার চেষ্টা করিলেন। ‘বাসাংসি জীর্ণানি’ ইত্যাদি।

আইনস্টাইন বলিলেন, “ম্যাক্সমুলারের বেদান্তদর্শনের উপর প্রবন্ধ পড়ে একসময়ে সংস্কৃত শেখবার বড়ো ইচ্ছে হয়। দর্শনে আমি স্পিনোজার মানসশিষ্য। স্পিনোজার দর্শন গণিতের ফর্মে ক্রমানুসারে সাজানো। স্পিনোজার মন গণিতজ্ঞ স্রষ্টার মন, সেজন্য আমি ওঁর দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু বেদান্ত সম্বন্ধে ম্যাক্সমুলারের প্রবন্ধ পড়ে আমি নতুন এক রাজ্যের সন্ধান পেলাম। ইউক্লিডের মতো খাঁটি বস্তুতান্ত্রিক মন স্পিনোজার, সেখানে কূটতর্কও বাঁধা পথে চলে। আমি কিন্তু ভেতরে ভেতরে কল্পনাবিলাসী—I’

রায়বাহাদুর অবাক হইয়া আইনস্টাইনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘‘আপনি!”

আইনস্টাইন মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “কেন, আমার কালের সঙ্গে ক্ষেত্রের একত্র মিলনকে আপনি কল্পনার ছাঁচে ঢালাই-করা বিবেচনা করেন না নাকি?”

রায়বাহাদুর আরও অবাক। আমতা আমতা করিয়া বলিলেন “নতুন ডাইমেনশানের সন্ধানদাতা আপনি, নিউটনের পর নববিশ্বের আবিষ্কারক আপনি আপনাকে কল্পনাবিলাসী বলতে—”

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান যুগের এই শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীর কবিসুলভ দীর্ঘ কেশ ও স্বপ্নভরা অপূর্ব চোখের দিকে চাহিয়া রায়বাহাদুরের মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। কল্পনা প্রখর না–হইলে হয়তো বড়ো বৈজ্ঞানিক হওয়া যায় না, রায়বাহাদুর ভাবিলেন। কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, আইনস্টাইন পাশের ছোটো টেবিল হইতে চুরুটের বাক্স আনিয়া রায় বাহাদুরের সম্মুখে স্থাপন করিলেন। নিজের হাতে একটা মোটা চুরুট বাহির করিয়া ছুরি দিয়া ডগা কাটিয়া রায়বাহাদুরের হাতে দিলেন। রায়বাহাদুরের বাঙালি মন সংকুচিত হইয়া উঠিল। অত বড়ো বৈজ্ঞানিকের সামনে সিগার ধরাইবেন তিনি, জনৈক হেঁজিপেজি অঙ্কের মাস্টার? তা ছাড়া সাহেবও তো বটে, সেটাও দেখিতে হইবে তো। সাহেব জাত কাঁচাখেকো দেবতার জাত। রায়বাহাদুর একটা সিগার তুলিয়া বলিলেন—”আপনি?”

—”ধন্যবাদ। আমি ধূমপান করিনে।’

—”ও!”

—”আমি একটা কথা ভাবছি।”

—”কী, বলুন। “

—”রানাঘাটে সভা করলে কেমন লোক হবে আপনার মনে হয়? কেমন জায়গা রানাঘাট?”

—”জায়গা ভালোই। লোকও হবে।”

—”কিছু টাকা এখন দরকার। যা ছিল জার্মানিতে রেখে এসেছি। ব্যাঙ্কের টাকা এক মার্কও তুলতে দিলে না, একরকম সর্বস্বান্ত।”

—”আমি রানাঘাটে বিশেষ চেষ্টা করছি, সার।”

—’ওখানে বড়ো হল পাওয়া যাবে কি?”

—”তেমন নেই। তবে মিউনিসিপ্যাল হল আছে, মন্দ নয়, কাজ চলে যাবে।” রায়বাহাদুর কিছুক্ষণ পরে বিদায় লইতে চাহিলেন, ভাবিলেন এত বড়ো লোকের সময়ের ওপর অত্যাচার করিবার দরকার নাই।

আইনস্টাইন বলিলেন—’’আমার কিছু ছাপা কাগজ ও বিজ্ঞাপন নিয়ে যান। যে বিষয়ে বক্তৃতা হবে, সে আপনাকে পরে জানাব, টিকিটের দাম কত করব?”

—’খুব বেশি নয়—এই ধরুন—”

-–”তিন মার্ক—দশ শিলিং?”

—”আজ্ঞে না সার। সর্বনাশ! এসব গরিব দেশ। দশ শিলিং আজকাল দশ টাকার কাছাকাছি পড়বে। ও-দামে টিকিট কেনবার লোক নেই এদেশে, সার।’’

—”পাঁচ শিলিং?”

—”আচ্ছা, তাই করুন। ছাত্রদের জন্যে এক শিলিং।”

আইনস্টাইন হাসিয়া বলিলেন, “ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। আমি নিজেও স্কুল-মাস্টার। আমার ওপর তাদের দাবি আছে। বম্বে ও বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতেও তাই হয়েছিল। ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। এই নিয়ে যান ছাপা হ্যান্ডবিল ও কাগজপত্র—”

রায়বাহাদুর হ্যান্ডবিল হাতে পাইয়া পড়িয়া দেখিতে গিয়া বিষণ্ণমুখে বলিলেন —”এ কী সার? এ যে ফরাসি ভাষায় লেখা!”

—”ফরাসি ভাষায় তো বটেই। প্যারিসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ছাপিয়েছিলাম। কেন, ফরাসি ভাষা বুঝবে না কেউ? আমি তো সেদিন শুনলাম এখানে ইউনিভার্সিটিতে ফরাসি পড়ানো হয়?”

—’’আজ্ঞে না। সে হয়তো এক-আধজন বুঝতে পারে। সেভাবে ফরাসি ভাষা পড়ানো হয় না। এখানে ইংরেজিটাই চলে। কেউ বুঝবে না সার।”

—’তাই তো! আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে ওখানে কোনো প্রেসে ছাপিয়ে নেবেন দয়া করে?”

—’তা—ইয়ে…তা—আচ্ছা স্যার।”

রায়বাহাদুর মনে মনে ভাবিলেন—এখান থেকে বালিগঞ্জে গিয়ে বিনোদের শরণাপন্ন হইগে। ছোকরা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে। কাঁহাতক আর একজন এত বড়ো লোকের সামনে ‘জানিনে মশাই’ বলা যায়! বিনোদ চৌধুরী তাঁর বড়ো শালা। পণ্ডিত লোক। অনেকরকম ভাষা তার জানা আছে। সে উৎসাহের সঙ্গে হ্যান্ডবিলগুলির বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ করিয়া দিয়া বলিল—”আমি চাটুয্যেমশায়, রানাঘাট যাব সেদিন। আমার থিওরি অব রিলেটিভিটির সঙ্গে পরিচয় অবিশ্যি লিন্ডেন বুলটনের পপুলার বই থেকে। তবুও আইনস্টাইনকে আমি এ যুগের ঋষি বলে মানি। সত্যকার দ্রষ্টা ঋষি। সত্যকে যাঁরা আবিষ্কার করেন, তাঁরাই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। লম্বা লম্বা লাঙল মার্কা ইকোয়েশন বুঝতে না-পারি, কষতে না-পারি, কিন্তু কে কী দরের সেটুকু— ।”

রায়বাহাদুর দেখিলেন চতুর শ্যালকটি তাঁহাকে ঠেস দিয়া কথা বলিতেছে। হাসিতে হাসিতে বলিলেন,—”অর্থাৎ সেই সঙ্গে আমার দরটাও বুঝি ঠিক করে ফেললে বিনোদবাবু? বেশ, বেশ।”

—”রামোঃ! চাটুয্যেমশায়, ছি ছি, তেমন কথা কী আমি বলি?”

—”বলো না?”

Comments

    Please login to post comment. Login