আমাদের সমাজে কাউকে যদি একজন একনায়কের নাম বলতে বলা হয় তবে হয়ত প্রায় সবাই চোখ বন্ধ করে উত্তর কোরিয়ার নেতা "কিম জং উনের" নাম বলে দিবেন যে কি না তার একনায়কত্ব আর রাষ্ট্র পরিচালনায় অদ্ভুত কর্মকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত। "Dictator " বা একনায়ক শব্দটি দ্বারা সাধারণত এমন সব শাসককে বুঝানো হয় যারা কোন দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে কারো পরামর্শ নেন না বা নিজের পছন্দ মতো সব কিছু করে থাকেন। এদিক থেকে চিন্তা করলে মনে হতেই পারে যে এধরনের শাসকরা নিশ্চয়ই প্রচণ্ড শক্তিমান বা তারা নিজের মাঝে এমন সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে যেটি তাদের একা চলতে এবং রাষ্ট্র চালাতে সাহায্য করে থাকে। তবে এধরনের ধারণা একবারেই উড়িয়ে দিয়ে একনায়ক সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করেছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন লেখক ও অধ্যাপক Bruce Bueno এবং Alastair Smith তাদের বিখ্যাত বই The Dictator Handbook তে। এখানে তারা একনায়ক নিয়ে সমাজে প্রচলিত মিথ যেমন ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তেমনি কিভাবে একজন একনায়ক ক্ষমতায় আরোহণ থেকে শুরু করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা ও পরবর্তী একসময় পতনের দিকে যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷
একনায়কদের প্রচণ্ড ক্ষমতা ও শক্তিমত্তা নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় কোনো শাসক এমনকি সে যতোই একনায়কই হন কখনও নিজের একক শক্তিবলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন না। এমনকি সকল সিদ্ধান্ত যেমন তারা একা নিতে পারেন না তেমননি রাষ্ট্র কোথায় কি ঘটছে সে সম্পর্কে সকল কিছু তার একার পক্ষে অবগত থাকাও সম্ভব হয় না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাকে তৈরি করতে হয় এমন একটি গ্রুপ বা কোয়ালিশনের যেখানে থাকা লোকেরা শুধু তার জন্যই কাজ করবে। তবে এই কাজ করা যে নিঃস্বার্থে হবে এমন নয়। বরং বাস্তবে পুরোপুরি তার বিপরীত। একনায়করা সাধারণত একটি সুবিধাভোগী গ্রুপ তৈরি করে থাকে যারা তার কাছ নিয়মিত আর্থিক ও আনুষঙ্গিক সুবিধা ভোগ করেন। ফলে তাদের মাঝে একটি বিশ্বাস ও লোভ তৈরি হয়। ফলে এই সুবিধার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এই গ্রুপের সদস্যরা একনায়কের জন্য এমন কিছু নেই যেটি তারা করতে পারে না। আবার যেহেতু তারা সুবিধাভোগী ফলে কখনও যদি তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে কিংবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আরও বেশি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তবে একনায়কের পেছন থেকে সরে যাওয়ার দৃষ্টান্তও অসংখ্য।
রাষ্ট্র শাসন করতে একজন একনায়ক এমনকি একজন গণতান্ত্রিক নেতাকেও প্রতিনিয়ত যাদের মুখোমুখি হতে হয় এবং তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা না থাকার বিষয়টিতে কমবেশি যারা প্রভাব বিস্তার করেন তাদেরকে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
১। পরিবর্তনশীল জনগোষ্ঠী
২। প্রভাবশালী গোষ্ঠী
৩। সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গ
এখানে পরিবর্তনশীল জনগোষ্ঠী বলতে একটি গণতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণের সেই অংশকে বুঝানো হয় যারা কিছুদিন পরপর তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বদল করেন এবং রাষ্ট ক্ষমতায় একই ব্যক্তি বা দলকে দীর্ঘদিন দেখতে চায় না। ফলে গনতান্ত্রিক দেশে যখন ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সুযোগ হয় তখন তারা নতুন নেতৃত্বকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার চেষ্টা করে। তবে একনায়তান্ত্রিক দেশ যেখানে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই বা থাকলেও সেটা শাসকগোষ্ঠী দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সেখানে তাদের ভোট প্রদানের বা মতপ্রকাশের সুযোগও থাকে না। এবং এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে তাদের খুব বেশি কিছু করারও থাকে না। ফলে শাসকগোষ্ঠী বিশেষত একনায়কের কাছে তাদের মূল্যও তেমন একটা থাকে না। প্রকৃতপক্ষে এরাই হলো দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যারা প্রতিনিয়ত দেশের রাজা বা শাসক দ্বারা শোষিত হন কিন্তু কেউই এদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজ করে না। একারণে পৃথিবীর প্রায় সকল একনায়কতান্ত্রিক দেশেই একটি সাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। আর সেটি হলো এই দেশগুলোর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। এর কারণ হলো মানুষ যখন উচ্চ শিক্ষিত হয় তখন তাদের উপর শোষণ অব্যাহত রাখা যায় না। তবে এদেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষার মান অপেক্ষাকৃত ভালো হয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের অংশগ্রহণও বেশি থাকে। ধারণা করা হয় যেহেতু রাষ্ট্র চালাতে প্রয়োজন হয় ট্যাক্সের আর সেটি আসে জনগণের পকেট থেকে তাই তাদেরকে অন্তত মৌলিক কিছু শিক্ষা দিতেই হয় যেটির মাধ্যমে তারা কিছু হলেও উপার্জন করতে পারে এবং সরকারও তাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে পারে। আবার শুধু যে রাষ্ট্র চালানোর জন্যই কর সংগ্রহ করা হয় ব্যাপারটি এমনও নয়। বরং একনায়কদের অনুগত গোষ্ঠী যারা একনায়কের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য অপরিহার্য তাদের হাতে রাখার জন্যও জনগণ থেকে সংগ্রহ করা কর অনিবার্য। তবে এই করের টাকা যে সরাসরি জনগণের হাত থেকে একনায়কের সেই পোষ্য গোষ্ঠীর কাছে চলে যায় এমনটাও নয়। এই কাজের জন্য একনায়করা মেনে চলে সুসংগঠিত নিয়ম বা পদ্ধতি। যে পদ্ধতি একনায়কতন্ত্রিক বা নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশে "মেগা প্রকল্প" নামে পরিচিত। জনগণের করের টাকা দেশের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে এটি বুঝানোর জন্য যেমন একদিকে যেমন এসব ব্যয়বহুল মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয় তেমনি এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ কাজ পায় একনায়কের সেই পোষ্য গোষ্ঠীর লোকেরা৷ আদতে এসব মেগাপ্রকল্প লাভজনক হবে কি না সেটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। ফলে এসব দেশে একদিকে যেমন দেখা যায় চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন তেমনি আরেকদিকে বাড়তে থাকে আয় বৈষম্য ও অর্থ পাচারের বিষয়গুলো।
এমনকি যদি দেশে কখনও অর্থনৈতিক সংকট, দূর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুযোর্গ দেখা দেয় তবে সেটিও এসকল শাসকদের জন্য আর্শীবাদ হিসাবে দেখা দেয়। দুর্যোগ মানেই হলো বিদেশি সাহায্য আসার সুযোগ তৈরি হওয়া। আর যতবেশি বিদেশি সাহায্য আসবে একনায়ক তার কোয়ালিশনকেও ততোবেশি খুশী করতে পারবে আর ক্ষমতা সুসংহত হবে। ফলে দেখা যায় ২০০৮ সালে মায়ানমারে যখন ঘূর্নিঝড় নার্গিসের আঘাতে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় তখন সেখানে ক্ষমতায় থাকা সেনাশাসক বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোকে অবাধে ত্রান বিতরণ করার অনুমতি প্রদান করেনি। এর ফলে ঘূর্নিঝড় পরবর্তী সময়ে শুধু মানবিক সাহায্যের অভাবে মায়ানমারে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছে কিন্তু সেনাশাসকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে কোনো সমস্যাই হয়নি।
তবে যতোদিন পর্যন্ত একনায়ক তার কোয়ালিশন বা প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে তার ক্ষমতাও ততোদিন নিশ্চিত থাকে। এই কোয়ালিশনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো একনায়কের থাকা সেনাবাহিনী। তবে স্বৈরাচার বা একনায়কের প্রতিপক্ষের দিকে তাক করিয়ে রাখা সেনাবাহিনীর বন্দুকের যদি একবার নেমে যায় বা স্বৈরাচারের দিকে ঘুরে যায় তবে তার পতন তখন সময়ে ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এর সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত হলো মিশরে একনায়ক হোসনি মোবারকের পতন। যে কোয়ালিশনের জোরে দীর্ঘ ৩০ বছর নির্বিঘ্নে মিশর শাসন করেছেন সেই কোয়ালিশন তথা সেনাবাহিনী যখন তার প্রতিপক্ষের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানালো তখন তার পতন নিশ্চিত হয়ে গেলো।
একই কথা প্রযোজ্য লাইবেরিয়ার সাবেক একনায়ক স্যামুয়েল ডু এর ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে জন ডু বলতে একটা কথা প্রচলিত আছে যার অর্থ হলো একজন অচেনা ব্যক্তি। সেনাবাহিনীর সামান্য একজন সার্জেন্ট স্যামুয়েল ডু লাইবেরিয়ার সমাজে ছিলেন একজন পুরোপুরি অপরিচিত ব্যক্তি। তবে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে দেশের শাসক হয়ে যাওয়া ডু যদিও ছিলেন নিরক্ষর তবে তিনি জানতেন কিভাবে কোয়ালিশন গঠন করে নিজের অনুগত গোষ্ঠী তৈরি করতে হয়। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রথমেই তিনি সন্ধান করলেন কোথায় টাকা আছে। সেই টাকা ছিটিয়ে দিলেন তার অনুগতদের মাঝে। যার ফলাফল হলো সারাক্ষণ মদ আর নারী নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই শাসকের ক্ষমতাও সুসংহত হয়ে গেলো। তবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন যখন এই কোয়ালিশনকে আর সন্তুষ্ট রাখতে পারলেন না। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তিতে লাইবেরিয়ার গুরুত্ব কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায় লাইবেরিয়াতে। ফলে দেখা দেয় বিদ্রোহ আর সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারান স্যামুয়েল ডু। তবে হত্যার আগে তার উপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন যার উদ্দেশ্য ছিলো তার অর্থ কোথায় আছে সেটি বের করা। সেই ভয়াবহ নির্যাতনের ভিডিও এখনও পাওয়া যায় ইউটিউবে।
তবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য স্বৈরাচার যতোই কৌশল অবলম্বন করুক না দিনশেষে জনগণের বিজয়ই অনিবার্য। তাই দুনিয়া জুড়ে সাধারণ গনতন্ত্রপ্রিয় মানুষের বিজয় হোক এটাই সবার প্রত্যাশা।