আমাদের স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিতভাবেই দেখা যায় যে তাদেরকে বানরের তৈলাক্ত বাশের অঙ্কের সমাধান করতে হয়। যেখানে একটি বানর প্রাণপণ চেষ্টা করে বাশের চূড়ায় উঠার জন্য। যদি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জীবনচক্র বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সেখানেও প্রায় একই রকম দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন। এসব গরীব জনগোষ্ঠীর জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই পার হয়ে যায় দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে করতে। তবে এই দুষ্টুচক্র থেকে বের হয়ে আসার সংগ্রামটা যে শুধু গরীর জনগোষ্ঠী একাই করে ব্যাপার এমন নয়। বরং তাদের সাথে এই সংগ্রামে যোগ দেয় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থা। গ্রহণ করা হয় নানান রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর। গঠন করা হয় বিপুল অঙ্কের উন্নয়ন তহবিল। অর্থও খরচ করা হয় দেদারসে।তবে সবসময়ই যে এসব কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখা ব্যাপারটি কিন্তু এমনও নয়। বরং বিপরীত ফলাফলের হারই বেশি লক্ষ্য করা যায়। ফলে দাতাদের মাঝেও দেখা যায় মতের বিভক্তি যে ত্রাণ কর্মসূচি না কি অন্যকোন উপায় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অধিকতর কার্যকরি।
প্রতিবছর আফ্রিকা অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করার জন্য যখন বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকি মূল্যে গরীব পরিবারগুলোকে মশারি বিতরণ করা হয় তখন দেখা যায় তারা এসব মশারি ব্যবহার করে ফেলে বিয়ে বাড়ি সাজানোর কাজে ব্যবহৃত পর্দা হিসাবে। অথচ কোন জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তখন যে তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হয় এমনও নয়। অথচ এসব জটিল রোগ প্রতিরোধের জন্য যখন বিনামূল্যে টিকা বিতরণ করা হয়েছিল তখন সেটা গ্রহণেও এসব জনগোষ্ঠীর বিরাট অনীহা ছিল চোখে পড়ার মতো। ফলে তৈরি হয় স্বাস্থ্য ভিত্তিক দারিদ্র্য ফাঁদ পরিস্থিতির। অর্থাৎ দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে তারা কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না, ফলে অধিক অর্থ উপার্জন করাও সম্ভব হয় না। যেকারণে তারা গরীবই থেকে যায়। আর যেহেতু তারা গরীব তাই সুস্বাস্থ্যের পেছনে খরচ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে তাদের হাতে থাকে না বা খরচ করতেও তারা ইচ্ছুক থাকে না।
তাদের এ ধরনের আচারণের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের চর্চা করা বিশ্বাস পদ্ধতির যেটি People’s Belief System হিসাবে পরিচিত। পশ্চিম ভারতের উদয়পুরে একটি কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে যে বাচ্চাদের জন্মের প্রথম এক বছর তাদেরকে ঘর থেকে বের করা যাবে না যাতে দুষ্ট আত্মার খারাপ নজর থেকে রক্ষা করা যায়। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাদের জন্মের পরপরই যে কিছু অতি প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হয় সেগুলো আর প্রদান করা সম্ভব হয় না। সাধারণত টিকা গ্রহণ করলে যেমন ভবিতব্য অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় তেমনি আবার টিকা গ্রহণ না করলে রোগ আক্রান্ত হবেই এমন নিশ্চয়তাও প্রদান করা যায় না৷ ফলে যখন দেখা যায় কিছু বাচ্চা টিকা গ্রহণ করেও সুস্থ রয়েছে, সেটিই অনেক অভিভাবকের কাছে সঠিক উদাহরণ হিসাবে বিবেচ্য হয়। ঠিক একইভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে প্রদান করা মশারীকে বিয়ে বাড়ির পর্দা বানানোর পেছনের কারণকেও ব্যাখ্যা করা যায়। এর পেছনে থাকে এসব জনগোষ্ঠীর দূরদৃষ্টির অভাবকে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে নামমাত্র মূল্যে মশারী কেনা অথবা ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের পেছনে অর্থ ব্যয়ের পরিবর্তে পাড়া-পড়শীর বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন উপহার কেনাকে বেশি জরুরি মনে করে থাকে।
আবার যখন পুষ্টি ভিত্তিক দারিদ্র্যের ফাঁদ এড়ানোর জন্য গরীব জনগোষ্ঠীকে খাবারে ভর্তুকি প্রদান করা হয়, তখন দেখা যায় তারা পুষ্টিকর খাবারের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে তারা বেছে নেয় অপেক্ষাকৃত মুখরোচক খাবার কিংবা কোন বিলাসবহুল দ্রব্য ক্রয় করাকে। অন্তত মরক্কোর যুবক যার নাম উচা মোবারক ও তার গ্রামের মানুষের অর্থ ব্যয়ের অভ্যাস এক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক। কারণ সেখানে গ্রামের মানুষের কাছে পুষ্টিকর খাবারের চেয়েও ঘরে একটি টেলিভিশন থাকাটা বেশি জরুরি হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এমনকি পরিবারের প্রধান উর্পাজনক্ষম ব্যক্তিটি মারা গেলে যখন পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তখনও এসব স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও বেশ বড় পরিসরে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান করতে হয়। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে পুষ্টি ভিত্তিক দারিদ্র্যের ফাঁদ কথাটি কতটা বাস্তব সম্মত।
আমাদের উপমহাদেশসহ বেশ কিছু অনুন্নত দেশেই শিশুশ্রম খুবই স্বাভাবিক একটি দৃশ্য। অনেক সময়ই দেখা যায় যে ছোট একটি শিশু তার বাবার চায়ের দোকানে চা বিক্রির কাজে বাবাকে সাহায্য করছে। এখন যদি তার বাবাকে জিজ্ঞেসা করা হয় যে বাচ্চাটিকে স্কুলে না পাঠিয়ে কেন চায়ের দোকানের কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো তখন নিশ্চিতভাবেই বাবার কাছ থেকে উত্তর আসবে যে অর্থের অভাবে বাচ্চাটিকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটা মনে করা যেতে পারে যে যদি বিনামূল্যে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে অবশ্যই গরীব পরিবারও তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাবে। কিন্তু বাস্তবে অনেকক্ষেত্রেই এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়। এমনকি ভারতের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায়ও প্রতিটি শিশুর সর্বোচ্চ ৫০০ মিটারের মধ্যে অন্তত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে শিশুদের উপস্থিতির হার অত্যন্ত নিম্ন। আবার কোন অভিভাবক যদি তার সন্তানকে স্কুলে পাঠায়ও তখনও বাচ্চাদের মাঝে স্কুল পালানোর প্রবণতা থাকে খুব বেশি। ফলে সরকারের বা দাতা গোষ্ঠীর অর্থায়নে স্থাপিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল তা আর অর্জিত হয় না। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে শিক্ষা গরীব জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করতে পারে সে শিক্ষা যেহেতু তারা গ্রহণ করতে চাচ্ছে না তার মানে কি এই নয় যে গরীব জনগোষ্ঠী তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রকৃতপক্ষেই ইচ্ছুক কি না। না কি সরকার বা দাতারা গরীবদের শিক্ষা সংক্রান্ত চাহিদা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে?
যেহেতু দরিদ্র অভিভাবকগণ তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর বদলে কোন অর্থ উপার্জনকারী কাজে যুক্ত করে দেয় অর্থাৎ তাদের কাছে যেহেতু নগদ অর্থটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় তাই এসব অভিভাবকদের যদি সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর শর্তে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয় তাহলে হয়ত স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়বে এমন ধারণা থেকে মেক্সিকোতে চালু করা হয় "প্রোগ্রেসা (Progresa)" নামক একটি কর্মসূচির। এর ফলাফলও দেখা যায় বেশ ইতিবাচক ভাবেই। এই Conditional Cash Transfer কর্মসূচি যেটি স্থানীয় ভাবে "প্রোগ্রেসা" নামেও পরিচিত এটি গ্রহণের পর মেক্সিকোর মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ছেলে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ৭৭ শতাংশে। এমনকি এই উদ্যোগটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও।
তবে অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের মাঝে যে শুধু অর্থ সংশ্লিষ্ট কারণেই শিক্ষা গ্রহণে অনীহা দেখা যায় ব্যাপারটি এমনও নয়। অনেকসময় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষও এসব জনগোষ্ঠীর চাহিদা নির্ধারণে ভুল করে থাকে। বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে সেটি নির্ধারণ করা ও গরীব জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনে যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতা প্রয়োজন সেটি যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদান করে সেটিও অনেকসময় কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারে না। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ভারতের শিক্ষা বিষয়ক এনজিও " প্রথম" পশ্চিম ভারতে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে যার নাম দেওয়া হয় "বালসখি"। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল ক্লাসে সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে পাঠদানের সময় তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা৷ এর ফলাফলও ছিল চলতি অবস্থার নাটকীয় রকমের পরিবর্তন। যেখানে পূর্বে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া অন্তত ৪৭% শিক্ষার্থী যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজি বইতে থাকা একটি অনুচ্ছেদ সঠিকভাবে পড়তে পারত না তাদেরও এই কর্মসূচির পর অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়।
Poor Economics বইতে দুই নোবেলজয়ী উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্টার ডুফলো অনুসন্ধান করেছেন দারিদ্র্যের কারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যকর উপায় সম্পর্কে। তাছাড়াও, বইটিতে এসব জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ নিয়েই বিস্তারিত গবেষণা ও তার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে বিস্তৃত ভাবে। ফলে নতুন কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বই আবশ্যক পাঠ্য হয়ে উঠেছে।