২০ এপ্রিল, ১৯৮০। কিউবান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো আকস্মিক ভাবেই তার দেশের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি জারি করে বসলেন। বললেন, যাদের ইচ্ছা হয় তারা কিউবা ছেড়ে অন্য কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারবে। এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণার প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেল বেশ দ্রুত সময়ের ভিতর। মাত্র ১০ দিনের ভিতরই জনগণের মাঝে দেশ ছাড়ার হিড়িক পরে গেল। স্বল্প সময়ের ভিতর দেশটির প্রায় ১,২৫,০০০ নাগরিক জলপথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হলেন তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র আমেরিকার মায়ামিতে।যার ফলে মায়ামির জনশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে গেল প্রায় ৭%৷
মায়ামিতে আকস্মিক অভিবাসীদের আগমন ও জনশক্তি বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় নাগরিকদের বেতন ও কর্মসংস্থানের উপর কেমন প্রভাব পড়েছে সেটা নির্ণয়ের জন্য গবেষক ডেভিড কার্ড একটি গবেষণা পরিচালনা করেন যেটি Study of the Mariel Boatlift নামে পরিচিত।
গবেষণায় মায়ামির সাথে তুলনা করার জন্য ডেভিড কার্ড বেছে নিয়েছিলেন আরও চারটি শহরকে৷ সেগুলো হলো আটলান্টা, হিউস্টন, লস এঞ্জেলস ও ওটাম্পা। গবেষক কার্ড মায়ামির সাথে শহর চারটির তুলনা করে এটাই নির্ণয় করতে চেয়েছিলেন যে অভিবাসীদের আগমনের ফলে মায়ামির স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বেতন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাকি চারটি শহরের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়ল কি না। আর এটি বের করার জন্য তিনি যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন সেটি Difference in Differences নামে পরিচিতি লাভ করে।
গবেষণায় কী পেয়েছিলেন গবেষক ডেবিড কার্ড? সেটি জানার আগে আমাদের জানা উচিত কেন ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই অভিবাসন ইস্যুটি দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২০২৪ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে সেটি যে বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো অভিবাসন ইস্যু। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টি সবসময় অভিবাসীদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করলেও তার থেকে ভিন্ন ও কঠোর নীতি সাধারণত গ্রহণ করে থাকে রিপাবলিকান পার্টি কারণ তারা মনে করে অভিবাসীরা স্থানীয় জনগোষ্ঠির বেতন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে দিন দিন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রিপাবলিকান পার্টি থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এটা একরকম নিশ্চিত। তাই আলোচনার স্বার্থে আমাদের জেনে রাখা দরকার অভিবাসীদের নিয়ে এই দুই নেতা কেমন মনোভাব পোষণ করেন।
★প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতে, যারা অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে তাদের সরকার নির্ধারিত স্থান বা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তাদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। যদি মনে হয় তারা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয় তবে তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের উপর আরও কিছু শর্তও আরোপ করার বিধান থাকবে।
★ অপরদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নীতির প্রচণ্ড বিরোধী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন পরিস্থিতিকে দেখেন Chain Migration হিসাবে। এর মানে হলো অভিবাসীরা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য একা আসলেও দেখা যায় যে পরবর্তী কয়েক বছরের ভিতরেই তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও এখানে এসে হাজির হচ্ছেন। আর এ কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই ‘অভিবাসী খেদাও অভিযান’ চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এবার আবার ফিরে আসা যাক ডেবিড কার্ডের গবেষণায়। গবেষক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, অভিবাসীদের এই আকস্মিক আগমনের পর এমনকি কয়েক বছর পেরিয়ে যাবার পরও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বেতন হ্রাস পায়নি বা আক্রান্ত হয়নি। এমনকি এই গবেষণার মাধ্যমে অভিবাসন ইস্যুতে যে জনপ্রিয় চাহিদা-যোগান মডেল ব্যবহার করে এর বিরোধিতা করে করা হয় সেই মডেলটিরও অকার্যকারিতা তিনি এখানে দেখিয়েছেন।
যারা অভিবাসনের বিরোধিতা করেন তাদের মাঝে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় টার্ম হলো Seductive Syllogism। এর মানে হলো গরীব দেশের জনগোষ্ঠী যদি উন্নত দেশে আসার সুযোগ পায় তবে তারা নিজেদের আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এমনকি উন্নতদেশে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার অর্ধেকও যদি তাদের দেওয়া হয় তবুও তারা নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে আসবে। যেটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বেতন বেশ খানিকটা কমিয়ে দিবে। আর এই ধারণার পেছনে যে যুক্তি কাজ করে সেটি হলো "চাহিদা ও যোগানের সাথে দামের তত্ত্ব "। অর্থাৎ শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পেলে মজুরি হ্রাস পাবে আর যোগান হ্রাস পেলে শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি পাবে।
তবে Good Economies for Hard Times বইতে নোবেল জয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যনার্জি ও এস্টার ডুফলো বলেছেন মানুষ শুধু অধিক আয়ের সুয়োগ পেলেই নিজ দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে পাড়ি জমায় না। সেক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ কবি Warsan Shire এর কবিতা উল্লেখ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে:-
no one leaves home unless
home is the mouth of a shark
অর্থাৎ মানুষ দেশ ছাড়ে তখনই যখন যুদ্ধ, সহিংসতা ও জীবনের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা চরম ভাবে বিরাজ করে।
এক্ষেত্রে তারা উর্দ্ধিত করেছেন নেপালিদের উদাহরণ যেটি দেখায় যে দেশটিতে যখন কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ভাবে হ্রাস পাবার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল তখনও খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ দেশ ত্যাগ করেছিল।তবে তাদের মাঝে দেশ ত্যাগ স্রোতের মতো বৃদ্ধি পায় যখন মাওবাদীদের কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পেড়েছিল। একই উদাহরণ প্রযোজ্য ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে উদ্বাস্তু হওয়া নাগরিকদের জন্যও।
তাছাড়া বইটিতে লেখকদ্বয় আলোচনা করেছেন যে কেন অভিবাসনের ক্ষেত্রে চাহিদা-যোগান তত্ত্ব প্রযোজ্য হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে জার্মানির সীমান্ত শহরগুলোতে ১০% এর বেশি চেক প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের কর্মরত থাকার ফলেও স্থানীয় জার্মান নাগরিকদের বেতনের যে কোনো পরিবর্তন হয়নি এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাও উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় বইটিতে। যেখানে দেখা যায়, ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন খামারে কর্মরত " ব্রাসেরস " নামক মেক্সিকান অভিবাসীদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এই অভিযোগে যে তারা সেখানের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মজুরি কমিয়ে দিচ্ছে। তবে গবেষনায় দেখা যায় মেক্সিকানদের তাড়িয়ে দেওয়ার ফলেও স্থানীয়দের বেতন ও কর্মসংস্থান কোনটাই বৃদ্ধি পায়নি। কারণ তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার ফলে খামার মালিকরা উৎপাদন কাজে অধিক হারে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব ফসল অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব সেই ফসলগুলো উৎপাদন শুরু করে।
এসবের বাইরেও বইটিতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের পক্ষে যুক্তি হিসাবে বলা হয় নিম্নদক্ষতা সম্পন্ন অভিবাসীরা স্থানীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। যেমন অভিবাসীরা এমনসব কাজ বেছে নেয় যেগুলো সাধারণ স্থানীয়রা করতে চায় না। যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো লনে ঘাস কাটা, ফাস্টফুডের দোকানে বার্গার ফালি করা ইত্যাদি।
বইটিতে উল্লেখ করা আরেকটি গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় অনেকক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে অভিবাসীরা। এমনকি তারা স্থানীয়দেরকে ম্যানেজার বা বস হবার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি করেছে ব্যাপকভাবে।
অধিকন্তু সেন্টার ফর আমেরিকান এন্ট্রাপ্রেনরশিপ এক প্রতিবেদনে খুঁজে পেয়েছে, ২০১৭ সালে রাজস্বের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম পাঁচশো কোম্পানির (ফরচুন ৫০০ এর তালিকা) মধ্যে ৪৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠিত অথবা যৌথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভিবাসী অথবা তাদের সন্তানদের দ্বারা। এমনকি শীর্ষ পঁচিশটি কোম্পানির ৫২ শতাংশ এবং শীর্ষ পয়ত্রিশটি কোম্পানির ৫৭ শতাংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলো অভিবাসীরা, এবং সবচেয়ে দামী শীর্ষ তেরোটি ব্র্যান্ডের মধ্যে নয়টি অভিবাসীদের প্রতিষ্ঠিত।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এরই মাঝে তার কঠোর অভিবাসন নীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের জীবন আরও কঠিন হবে না কি সহজ হবে তা সময়ই বলে দিবে।