সময়টা ১৯৯১ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। মাত্রই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নীতি-নির্ধারকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তখন এই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে "বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়" হিসেবে দেখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের ফল হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মত দিতে থাকেন যে এটি সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে পুঁজিবাদের জয়। তাদের মতে এই পতনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে। এবার পৃথিবী অধিক নিরাপদ আর শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় হয়ে উঠবে। তবে এমন মতামত প্রদানে সবচেয়ে অগ্রগামীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা। তিনি তার বিখ্যাত বই "The End of History " বা ইতিহাসের পরিসমাপ্তি গ্রন্থে দাবি করেন যে, মানবেতিহাসের মানুষের কল্যাণে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব- সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং এখন এমন পরিস্থিতি এসেছে যে বিশ্বব্যাপী এখন সর্বজনীন চেতনা ও পাশ্চাত্য উৎসারিত উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের সমাজের জন্য স্থায়ী এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তার মতে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে বিছিন্নভাবে কিছু সংঘাত হতে পারে তবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সংঘাতের অবসান ঘটেছে। তিনি আরও দাবি করেন যে " বিশেষ করে অ-ইউরোপীয় বিশ্বে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নে এ পরিবর্তন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। মতাদর্শিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে উঠা এই বিশ্বব্যবস্থার নাম দেয়া হলো "New World Order" বা নবতর বিশ্বব্যবস্থা। এসময় বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাবী করতে থাকে যে, নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যায়নের দিন শেষ হয়ে এসেছে এবং এ বিভাগে আর অধ্যাপক নিয়োগ দানের প্রয়োজন নেই।
ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা ও তার অনুসারীরা যখন পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যাবস্থার জয়জয়কার উদযাপনে ব্যস্ত তখন নতুন করে আলোচনায় আসেন আরেক মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন। তিনি দাবি করেন যে, না সংঘাতের অবসান হয়নি।এতোদিন যুদ্ধ হয়েছে পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের, এবার সংঘাত হবে এক সভ্যতার সাথে আরেক সভ্যতার। সামনের দিনগুলোতে জাতিগুলোর মাঝে ধর্মীয় পরিচয় প্রকট আকার ধারণ করবে এবং এই সভ্যতাকেন্দ্রিক পরিচয় বা পার্থক্য তাদেরকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে। আর এই পরিস্থিতিকে তিনি নাম দিয়েছেন "সভ্যতার সংঘাত" নামে।
১৯৯৩ সালে Foreign Affairs জার্নালে এ বিষয়ের উপর "The Clash of Civilizations " নামে তিনি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলে সারাবিশ্ব জুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়। জার্নালটির সম্পাদকের মতে ১৯৪০ সাল থেকে প্রকাশের পর এই জার্নালে প্রকাশিত আর কোন প্রবন্ধ নিয়ে এতো আলোচনা হয়নি যেমনটি এটি নিয়ে হয়েছে।পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রবন্ধটির সম্প্রসারিত রূপ হিসাবে পূর্ণাঙ্গ বই আকারে নিয়ে আসেন "The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order " নামে। বইটিতে তিনি নতুন বিশ্বব্যবস্থায় দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ধারণা করা হয় হান্টিংটনের দেওয়া এই থিওরির উপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র তার পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বইটিতে পৃথিবীর দেশগুলোকে সভ্যতার ভিত্তিতে ৮ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমনঃ
১. পশ্চিমা সভ্যতা- এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলো।
২.জাপানিজ সভ্যতা- এখানে জাপানকে বুঝানো হয়েছে।
৩. ভারতীয় সভ্যতা- এখানে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৪. ল্যাটিন আমেরিকা সভ্যতা- মূলত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এই সভ্যতার ভিতর বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
৫. স্লাভিক সভ্যতা- সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। তবে আলবেনিয়া ও আজারবাইজান দেশ দুইটিকে এর বাইরে রাখা হয়েছে।
৬.সিনিক সভ্যতা- চীন, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
৭. আফ্রিকা সভ্যতা- সাব- সাহারান আফ্রিকার দেশকে এর মাঝে রাখা হয়েছে।
৮. ইসলামি সভ্যতা- বিশ্বের সকল ইসলাম ধর্মগরিষ্ঠ দেশগুলোকে নিয়ে এই সভ্যতা গঠিত।
তবে শুধু যে হান্টিংটনই প্রথম বিশ্বের দেশগুলোকে সভ্যতা অনুযায়ী বিভক্ত করেছেন এমন নয়। বিশ্ব- ইতিহাসে কতগুলো সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞজনদের মাঝে নানান মত রয়েছে। যেমন, কুইগলির মতে ইতিহাসে ১৬ টি সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যায়। তবে এর সাথে অতিরিক্ত আরও ৮ টি সভ্যতাকে যুক্ত করা যায়। তাছাড়া ঐতিহাসিক টয়েনবি এর মতে সভ্যতার সংখ্যা ২১ বা ২৩ টি। তাছাড়া স্পেলারের মতে প্রধান সভ্যতা মাত্র ৮ টি।
হান্টিংটনের মতে মোট ৮ টি সভ্যতা থাকলে দ্বন্দ্ব হবে মূলত ৩ টি সভ্যতার মাঝে। অর্থাৎ পশ্চিমা সভ্যতার সাথে সিনিক সভ্যতা ও ইসলামি সভ্যতার দ্বন্দ্ব হবে।এক্ষেত্রে সিনিক ও ইসলামি সভ্যতা একত্র হয়ে পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধ লড়াই করবে।
তাছাড়া এই ৮ টি সভ্যতার মাঝে ৩ টি সভ্যতা নিয়ে হান্টিংটন দোদুল্যমান সভ্যতা গঠনের কথা বলেছেন। তিনটি সভ্যতা হলো স্লাভিক, জাপানিজ ও ভারতীয় সভ্যতা। এদের দোদুল্যমান সভ্যতা বলা হয়েছে কারণ এরা কখনও পশ্চিমা সভ্যতা আবার কখনও সিনিক- ইসলামি সভ্যতার সাথে মিলে কাজ করবে। এরা কখনও পশ্চিমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিবে আবার কখনও পশ্চিমাদের সাথে একই সূত্রে গাঁথা। এক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে এই দেশগুলোর অবস্থা দোদুল্যমান।
হান্টিংটনের এই থিওরি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় বর্তমানে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্বেরও। বইটির কোররাষ্ট্র( প্রধান), এককেন্দ্রিকবৃত্ত এবং সভ্যতার সুবিন্যস্তকরণ ( অধ্যায়-৭) অধ্যায়ে ইউক্রেনের দুটি অংশ তথা পূর্ব ও পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের চিন্তাভাবনা ও আচার-আচরণগত পার্থক্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে পশ্চিম ইউক্রেনকে রুশ বিরোধী আখ্যায়িত করে বলা হয় যে সেখানে বাস করা এক-তৃতীয়াংশ রুশ জনগোষ্ঠী অভিযোগ করেছে যে তারা রুশবিরোধি বিদ্বেষ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। পূর্ব ও পশ্চিম ইউক্রেনের এই বিভেদকে তিনি কোনভাবেই নৃগোষ্ঠীক বিভেদ নয় বরং সাংস্কৃতিক বিভেদ হিসাবে অবহিত করেন। এখানে একজন রুশ জেনারেলের মতামত উল্লেখ করে বলা হয় যে, পাঁচ, দশ কিংবা পনেরো বছরের ভিতর ইউক্রেন অথবা পূর্ব ইউক্রেন রাশিয়ার মাঝে ফিরে আসবে। আর পশ্চিম ইউক্রেন নরকে যেতে পারে। তাছাড়াও এখানে আরও বলা হয় যে, পশ্চিমাবিশ্বমুখী ইউক্রনের অংশটি কেবল পশ্চিমাবিশ্বের কার্যকর সমর্থন পেয়েই টিকে থাকতে পারবে। হান্টিংটন মনে করেন যে, ইউক্রেন বিভাজিত হয়ে যেতে পারে কারণ সেখানে ফাটলরেখা রয়েছে। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল রাশিয়ার সাথে এক হয়ে যেতে পারে। আর বিছিন্নতার ইস্যুটি প্রথম আসতে পারে ক্রিমিয়ার অবস্থা থেকে। কারণ ১৯৯২ সালে ক্রিমিয়ার সংসদ তাদের স্বাধীনতার বিষয়টি অনুমোদন করে। যদিও তা পরে ইউক্রেনের চাপে বাতিল হয়েছিল। উল্লেখ্য যে হান্টিংটনের এ মন্তব্যের সত্যতা মেলে ২০১৪ সালে রাশিয়া কতৃক ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে।
তবে এই থিওরি নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। এর সমালোচকদের মাঝে অন্যতম এডওয়ার্ড সাইদ এই থিওরিকে অজ্ঞতার সংঘাত হিসাবে অবহিত করেছেন। তাছাড়া প্রখ্যাত মার্কিন চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কির মতে, বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নৈরাজ্যের বৈধতা দেয়ার জন্য এই থিওরি ব্যবহার করছে।
তবে আলোচনা- সমালোচনা যাই থাকুক না কেন এই একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বরাজনীতি বুঝার জন্য The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order বইটি সবসময়ই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।