Posts

উপন্যাস

তুমি সন্ধ্যার মেঘ (০১)

December 20, 2024

humayra official

Original Author হুমায়রা

তুমি সন্ধ্যার মেঘ (০১)
হুমায়রা

বিয়ের কনের জন্য বিয়ের দিনের সকালটা অনেক স্পেশাল  হয়। রাশার জন্য একটু বেশিই স্পেশাল হয়ে গেলো। সকালে সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে নিজেকে অন্য এক পুরুষের পাশে আবিষ্কার করলে স্পেশাল তো হওয়ারই কথা। আর তারপর যদি দেখে সামনে পরিবারের সবাই সহ আত্মীয় স্বজন সবাই ছিঃ ছিঃ করছে, তাহলে সকালটা বাস্তবিকই স্পেশাল হয়ে যায়। ভীষণ ভীষণ স্পেশাল হয়ে যায়।

পাশে থাকা ছেলেটি এতো চেঁচামেচিতেও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাশা তাকে এক থেকে দুইবার দেখেছিলো। শুধু জানে মেজো চাচার বন্ধুর ছেলে।
দিলওয়ারা জামান নামটা দাদুর দেওয়া। তার জন্মের আগেই নাম ঠিক করে গেছেন তিনি। বড্ড সেকেলে নাম। এই নাম থেকে রাশাকে তার মেজো চাচা উদ্ধার করেছে। সবাই এখন তাকে মেজো চাচার দেওয়া নাম রাশা হিসেবেই চেনে। রাশা অর্থ বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা। তবে তার জন্ম বৃষ্টিতে হয়নি। ঘন কুয়াশায় যখন দেশ ঢেকে ছিলো, তখনই তার জন্ম হয়েছে। মেজো চাচা পেশায় একজন আর্টিস্ট। তাই তার দেওয়া নামটাও এমন আর্টিস্টিক হয়েছে। 
আর্টিস্ট হওয়ার কারনে তিনি দেশের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান আর নতুন নতুন থিমে ছবি আঁকেন। তেমনই একটা জায়গায় গিয়ে পরিচয় হয় আফসার সাহেবের সাথে। অল্প আলাপ থেকে গভীর বন্ধুত্ব। ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষে স্বপরিবারে নিমন্ত্রিত ছিলেন তারা। পুরো পরিবার না আসলেও তিনি তার ছেলেকে নিয়ে ঠিকই এসেছিলেন। মূলত রাশার বড় চাচা একজন সনামধন্য রাজনীতিবিদ। আফসার সাহেবের ছেলে উষিরেরও রাজনীতিতে ব্যাপক আগ্রহ। সেইজন্যেই ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন বড় চাচা সাথে আলাপ করাতে।

উষিরের সাথে ররাতে গায়ে হলুদের সময় অল্প পরিচয় হয়েছিলো রাশার। আদনান কায়সার হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো, নিজ এলাকায় নাকি খুবই জনপ্রিয় সে। শুনে রাশা একবার জনপ্রিয় আদনান কায়সারের দিকে তাকিয়েছিলো। বুক টানটান করে চোখ নিচু করে তাকিয়ে ছিলো সে। রাশার মনে হয়েছিলো, সুঠাম দেহের এই সুদর্শন পুরুষটি তার রুপের জন্যই এতো জনপ্রিয়। গুন টুন কিচ্ছু নেই। সুন্দর মানুষদের সৌন্দর্যই তাদের গুন। বাকি গুনগুলো সব সৌন্দর্যের আড়ালে ঢাকা পরে যায়। কখনও প্রকাশও পায় না।

এখন সেই গুনহীন সুন্দর ছেলেটিকে নিজের পাশে আবিষ্কার করে শরীর হিম হয়ে আসলো তার। কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, সে ব্যাপারে রাশা নিশ্চিত। কিন্তু কোন ছেলের সাথে একই ঘরে রাত কাঁটালেই মেয়ে কলঙ্কিনী হয়ে যায়৷ সেখানে সে তো একই বিছানায় রাত কাঁটিয়েছে!

বিছানা বসেই হতবিহ্বল রাশার মাথায় হাত পরলো,
--আমি..আমি এখানে! তোমরা সবাই এখানে! আমি এখানে এলাম কিভাবে?

রাশার ছোট চাচী এগিয়ে আসলেন। হাত টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে হাত শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলেন,
--শয়তান মেয়ে! তোর লজ্জা করলো না রে? বিয়ে না করলে আগেই বলে দিতি৷ আমাদের মুখ কেন পোড়ালি? এসব করার আগে তোর বোনের কথা মাথায় আসলো না? নিজের মায়ের পেটের বোন তোর৷ ওর এখন কি হবে? ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কি ওকে ছেড়ে দেবে? অপমানের প্রতিশোধ নেবে না?

রাশা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,
--বিশ্বাস করো ছোট মা, আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। এসব কখন কিভাবে হলো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আর আমিই বা এখানে এলাম কিভাবে? আমি তো নিজের ঘরে শুয়েছিলাম। এটা তো আমার ঘরই না।

হা-হুতাশ করতে লাগলো রাশা। কেউ তার কোন কথা শুনলো না। মা ঘরে দরজা দিয়ে কান্না করছেন। বাবা শুরুতেই বলে দিয়েছেন, দিলওয়ারা জামান নামের মেয়েটিকে তিনি ত্যাজ্য করলেন। ছেলেটির আর ছেলেটির বাবার খবর রাশা জানতে না। অন্য একটা ঘরে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

এটা ঠিক যে রাশা সৌরভকে একদম বিয়ে করতে চায়নি। কেমন গায়ে পরা ছেলে! পৃথিবীতে ও একমাত্র ছেলে হলেও তাকে রাশা বিয়ে করতো না। প্ল্যান ছিলো, রাতেই বাড়ি থেকে পালাবে। চকিতে রাশার মনে পরে গেলো! কাল রাতে পালাতেই তো চেয়েছিলো। পরে দেখলো বড় চাচা করিডরে পায়চারি করছেন। তার থেকে লুকাতেই অন্য একটা ঘরে ঢুকে পরেছিলো। তারপর কখন ঘুমের তাড়নায় বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পরেছিলো, কে জানে! আর এরমধ্যেই কি সর্বনাশটাই না হলো! এখন যদি ধরে বেঁধে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়! শিউরে উঠলো রাশা। এমন অশুভ কথা মনে আনার জন্য মনে মনে তওবাও পরে নিলো। ছেলেটি তো আগাগোড়া কিছুই জানে না। বিয়েতে রাজী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এতোটাও নিচ নিশ্চয় না। অবশ্য কিছু মানুষের বিয়েতে ছুঁকছুঁক অভ্যাস আছে। এরা শুধু বিয়ের চান্স খোঁজে। কার সাথে হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে তা দেখে না। তার নিজের বাড়িতেই এমন একজন আছে। ছোট চাচার মেয়ে দিয়া। রাশা সিওর ছিলো, ও পালিয়ে যাওয়ার পরে বিনা দ্বিধায় দিয়া বিয়ে করতে রাজী হয়ে যেতো। কিন্তু এখন কি থেকে কি জানি একটা হয়ে গেলো! সব প্ল্যান জলে ভেসে গেলো!

রাশার সমস্ত আশংকা সত্যি করে উষিরের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেলো। পাশাপাশি বসে না, পাশাপাশি ঘরে বসে তাদের বিয়ে হলো। টেনশনে রাশার মাথা ঘুরতে লাগলো। সকাল সাতটায় তার ট্রেন ছিলো। সাতটা বাজতে আর বিশ মিনিট আছে। এখন বের হলেও ট্রেন ধরা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। সাতশো টাকার এসি কামড়া নিয়েছিলো। সব গেলো! এতো ভোরে কেউ বিয়ে করে! আর এক দুই ঘন্টা দেরি করে বিরে পরালে না ট্রেন মিস হতো আর না বিয়ের শিকল পায়ে পরতো। রাশার ভাগ্যটা ইদানিং খুব একটা সাথ দিচ্ছে না।

***
বিয়ের পর আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করেনি উষির। তাদের সাথে করে আনা গাড়িতে উঠে নিজেই ড্রাইভ করে গাড়ি চালাতে লাগলো। সামনে রাশার সদ্য হওয়া সম্পর্কের শ্বশুর আর বর বসে আছে। আর পেছনে নিজে বসে বসে হাই তুলছে।
আচমকা জোরে ব্রেক কষায় রাশা পরতে পরতে বেঁচে গেলো। তারপর অবাক চোখে দেখলো, যেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সেটা তার বহুল কাঙ্খিত রেলস্টেশন।

আফসার সাহেব অবাক হয়ে একবার বাইরের দিকে আর একবার ছেলের দিকে তাকালেন। বিষ্ময়ে মুখ দিয়ে কথাও বের হলো না। উষির স্টেয়ারিং এ দুই হাত শক্ত করে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে একটু শান্ত করে দরজা খুলে বের হলো। তার দেখাদেখি আফসার সাহেবও বের হলেন। রাশা কি করবে বুঝতে না পেরে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে কথা শুনতে চাইলো।

--আমি যাচ্ছি। তোমার ব্যবস্থা তুমি করে নাও।
উষির কঠিন, রাগী মুখে কথাটা বলেই গাড়ির ডিকি থেকে নিজের ব্যাগটা বের করে কাঁধে নিলো। আফসার সাহেব বিচলিত হলেন খুব। ছেলে চলে গেলে বাকি রাস্তাটুকু নতুন বউ নিয়ে কিভাবে বাড়ি ফিরবেন তিনি!
ছেলেকে শান্ত করতে হালকা করে বললেন,
--আমি গাড়ি চালাতে পারি নাকি?

--বিয়ের সিদ্ধান্ত তোমার ছিলো, এখন গাড়ি কিভাবে চালাবে সেই সিদ্ধান্তও তুমিই নাও। এসব দেখার বিষয় আমার না বাবা, সরি!

আফসার সাহেব রেগে গেলেন। 
--আরে ছাগল..

তার কথা শেষ করার আগেই উষির বাবার পা ছুঁইয়ে সালাম করে বড় করে শ্বাস ফেলে বললো,
--ভালো থেকো বাবা।

উষিরের যাওয়ার কথা শুনে রাশাও গাড়ি থেকে নেমে পরেছিলো৷ ট্রেনের হুইলসেল দিয়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেবে ছেড়ে দেবে করছে। তাই সেও উষিরের পদ অনুসরণ করে শ্বশুরের পা ছুঁইয়ে সালাম করলো,
--আমিও যাচ্ছি আংকেল। ভালো থাকবে। আর এতোক্ষণ আমার খেয়াল রাখার জন্য ধন্যবাদ।

তারপর আফসার সাহেবকে অবাক করে রাশা উষিরের পেছন পেছন ছুটতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো,
--আরে দাঁড়াও? আমাকে গাড়িতে তুলুন। আমিও যাবো...

রাশার আওয়াজ শুনে অনেকেই অবাক চোখে তাকে দেখছিলো। টকটকে লাল বেনারসি আর গা ভর্তি গহনা পরে একজন চলন্ত ট্রেনের পেছন পেছন ছুটছে। সবাই দেখলেও দেখলো না শুধু উষির। একবারও পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজনও মনে করলো না। সোজা একটা ফাঁকা সিটে বসে পরেছে।

রাশা অনেক কষ্টে অনেক দৌঁড়ানোর পরেও ট্রেন ধরতে পারলো না। প্ল্যাটফর্মেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আফসোসের সুরে বললো,
--আমার থেকে টিকিট নিলে তাও জরিমানা দিতে হতো না। বউয়ের দেওয়া ফ্রী টিকিটে এসিতে আড়াম করে বসে যেতে পারতো। বদ দোয়া দিলাম, টিটি ধরে জেলে পুড়ে দিক। সাত দিন রিমান্ডে রেখে আচ্ছামত শায়েস্তা করুক। তারপর জাহান্নামে যাক!

আরো অনেক বদ দোয়া দিতে দিতে হতভম্ব হওয়া শ্বশুরের কাছে এসে বললো,
--চলো আংকেল, আমি ড্রাইভ করে তোমাকে নিয়ে যাই।

--তুমি চালাতে পারো মা?

আফসার সাহেব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। রাশা লাজুক হেসে বললো,
--কি যে বলো! এই রাশা পারেনা এমন কোন কাজ তৈরিই হয়নি।

তারপর দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র আক্রোশে বললো,
--এমন অকর্মণ্য ছেলে তোমারই তো? ডিএনএ টেস্ট ভালো করে করেছিলে তো? শাশুড়ি আম্মার অন্য জায়গায় কোন চক্কর টক্কর ছিলো না তো আবার? তোমাদের চেহারাতেও কিন্তু কোন মিল নাই। শাশুড়িকে কিন্তু সন্দেহ করতে পারো।

রাশার কথাবার্তায় আফসার সাহেব কেশে উঠলেন। রাশা গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতেই লাগলো,
--এমন বিট্রেয়ারকে আর রাখা যায় না আংকেল। আজকেই ত্যাজ্য করে দাও। কি দরকার এই ছেলের! বাপ আর বউকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায়! বেয়াদপ ছেলে একটা। একে তো উল্টা ঝোলায়া রাম ধোলাই দেওয়া উচিৎ।

আফসার সাহেব নিশ্চুপ হয়ে রাশার কথা শুনতে লাগলেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। রাশাকে বলা হলো না, ট্রেন ধরতে পারলে সে নিজেও একই পথের পথিক হতো। তখন গাড়ি নিয়ে তাকে অথৈ জলে পরতে হতো।

দ্বিতীয় ঝড় উঠলো বাড়িতে গিয়ে। তার সাথে বধূবেশে রাশাকে দেখেই তার স্ত্রী হায় হায় করে উঠলো,
--আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেলো গো! এই বুড়া বয়েসে তোমার বিয়ের শখ জাগছিলো? ছেলেও তো সাথে ছিলো। ছেলের মুখের দিকে তাকায়া অন্তত এই কাজ করতা না। ছি ছি ছি! লোক লজ্জার ভয় নাই তোমার?

আফসার সাহেব স্ত্রীর কথার চাপে কোন কথাই বলতে পারছেন না। তবে রাশা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠে বললো,
--কে তুমি? পাগলের মতো একাই বকবক করে যাচ্ছো। আংকেলকে কিছু বলতে কেনো দিচ্ছো না? আর আমার বিয়ে আংকেলের ছেলের সাথে হয়েছে৷ আর সেই ছেলে বিয়ে করে মাঝরাস্তায় বউ রেখে ভেগে গেছে৷

পুরো বাড়িতে আচানক হওয়া এই বজ্রপাতে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পরলো। হতবাক হয়ে সবাই একবার রাশা তো একবার আফসার সাহেবের দিকে দেখতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, আফসার সাহেব নিজে বিয়ে করলেও কেউ এতোটা শক পেতো না!

চলবে...

Comments

    Please login to post comment. Login