ভিমরুলের মতো এক ধরনের পোকা ঘুরে বেড়ায় ঘরময়। অতি চঞ্চল, দ্রুত আসে, ঘরের এককোণের দেয়ালে কী যেন রেখে আবার পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। কয়েকদিন একটানা খেয়াল রাখলাম। এক তাল কাঁদার স্তূপ জড়ো হয়েছে দেয়ালের সেই কোণে। খুব ভালো করে তখন পোকাটাকে লক্ষ্য করলাম। মুখে খুব সামান্য একফোঁটা কাঁদা। বাইরে থেকে বার বার আনে। সেই কাঁদাই এক সময় স্তুপে রূপ নেয়। কাঁদার সেই স্তূপটাই হলো ওই ভিমরুলের বাসা।
গ্রামে একে কুমরে পোকা বলে, কাঁদা দিয়ে বাসা বানায় বলে কী-না! আসলে এটাও এক ধরনের ভিমরুল। যে সে কাঁদা কিন্তু ঘর তৈরিতে ব্যবহার করে না। রীতিমতো চারপাশে ভালো করে দেখে উপযুক্ত কাঁদা খুঁজে বের করে। তারপর কাঁদার সঙ্গে নিজেদের লালা মিশিয়ে আঠালো করে বাসা তৈরি করে।
কাঁদার সেই স্তূপের ভেতরটা ফাঁপা। বাইরের দেয়ালগুলো যতটা এবড়ো-খেবড়ো, ভেতরটা ঠিক ততটাই মসৃণ। বাইরে থেকে দেখলে পোকাদের সেই ঘরের মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না।
তাহলে পোকা ভেতরে ঢোকে কী করে? শ্বাসই বা নেয় কীভাবে?
তখন জানতাম না, বড় হয়ে জেনেছিলাম। এ ঘর পোকা নিজের জন্য বানায় না। বানায় তার সন্তান-সন্তানাদির জন্য।
ঘরের ভেতরটা যেমন মসৃণ, ঠিক ততটাই ঠাণ্ডা। দরজা না থেকেও ঠান্ডা।
কীভাবে?
কাঁদার সেই ঘর তৈরির সময় দেওয়ালে অসংখ্য ছিদ্র রাখে মা ভিমরুল। খালি চোখে সেই ছিদ্র আমাদের চোখে পড়ে না। সে সব ছিদ্র দিয়ে প্রচুর বাতাস ঢোকে। ভেতরের পরিবেশ রাখে ঠান্ডা। এর ফলে ভেতরে অক্সিজেনেরও অভাব হয় না।
বাসা তৈরি হয়ে গেলে এরা শুঁয়োপোাকা, মাকড়াশা জাতীয় পোকার খোঁজে বেরিয়ে যায়। কাউকে সুযোগ মতো পেলেই তার পিঠে ফুটিয়ে দেয় হুল, দক্ষ শিকারির মতো করে।
বোলতার হুলে বিষাক্ত পদার্থ থাকে। বিষ আক্রান্ত পোকাদের অবশ করে দেয়। প্যারালাইজড রোগীদের মতো করে। বেঁচে থাকে, কিন্তু নট নড়ন-চড়ন।
অবশ সেই পোকাদের ঘরের ভেতর সাজিয়ে রাখে সুন্দর করে। তারপর বাসার ভেতর ডিম পাড়ে মা কুমরে পোকা। সবশেষে মা পোকা বেরিয়ে এসে ঘরের মুখ বন্ধ করে দেয়।
কয়েক দিন বাদে ডিম ফুটে ছানা বেরোয়। ততোদিনে অবশ্য বাসা শুকিয়ে সম্পূর্ণ শক্ত হয়ে গেছে।
মা আশপাশে নেই। অথচ খাওয়ার, আরাম-আয়েশের জন্য কোনো চিন্তাই করতে হয় না ছানাদের। অবশ ও আস্ত কিছু জীবীত পোকা রয়েছে খাবার হিসেবে।
খাবারের সেই ভাণ্ডার শেষ হতে না হতেই ছানারা বড় হয়ে যায়। নিজেরাই তখন ঘরের দেয়াল ছিদ্র করে বেরিয়ে আসে। কিন্তু যে মা অত পরিশ্রম করল, তার দেখা ছানারা কখোনই পায় না। ততক্ষণে মা বেচারি হয়তো কোনো পোকাশিকারি পাখি কিংবা গিরগিটির পেটে চলে গেছে।
আর যদি বেঁচেও থাকে, নিজের সন্তানদের দেখলে সে-ও যেমন চিনবে না, সন্তানেরাও মাকে চিনবে না। অথচ মা তাদের জন্য জীবনের শেষ পর্যায়ে কতটা কষ্ট করেছে! মায়েরা আসলে এমনই! জাতপাত, এমনকী প্রাণীভেদেও মায়ের রূপ বদলায় না।