Posts

নন ফিকশন

কেন জাতিগুলো ব্যর্থ হয়

December 20, 2024

Fojla Rabbi

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যেখানে দেখা যায় মেক্সিকোর কিছু বাসিন্দা নিজেদের তু্লনায় পাহাড়সম উচু দেওয়াল টপকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। মেক্সিকানদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের বিষয়টি নতুন কোন ঘটনা নয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে অবৈধ প্রবেশ প্রতিরোধে মেক্সিকো সীমান্তের বড় অংশ জুড়ে উচু দেওয়াল নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা নিয়ে দুদেশের সম্পর্ক বেশ তিক্ত হয়ে উঠেছিল। শেষে ট্রাম্পের চাপে মেক্সিকো সরকার অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ ঠেকানোর জন্য সীমান্তে সেনা মোতায়ন করতেও বাধ্য হয়েছিল।

নোগালেস এলাকাটি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে অবস্থিত যার যুক্তরাষ্ট্র অংশটি অ্যারিজোনা আর মেক্সিকো অংশটি সোনারা নামে পরিচিত। দুই অংশের মানুষ এই ইতিহাস,সংস্কৃতি ও আবহাওয়ার অর্ন্তগত। সে অর্থে এই দুই শহরের মানুষের জীবন-যাপনেও কার্যত তেমন কোন ব্যবধান থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মান পরিমাপক ৫০ টির বেশি সূচকে অ্যারিজোনার বাসিন্দারা সোনারার বাসিন্দাদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। আইন-শৃখলা, জীবনের নিরাপত্তা, বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা যেমন শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কায়ন সুবিধা, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার সহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাভোগে অ্যারিজোনাবাসীর  সাথে সোনারাবাসীর ব্যবধান আকাশ-পাতাল সম।

কেন শুধু একটি দেওয়াল দিয়ে বিভক্ত একটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাপনে এতে পার্থক্য কিংবা কেন পৃথিবীর কিছু দেশ যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নাগরিক সেবায় অন্য দেশ থেকে এগিয়ে যায় আর কিছু দেশ কেন দিন দিন পিছিয়ে পড়ে তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন MIT এর অধ্যাপক দারোন অ্যাসেমোগলু ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস এ. রবিনসন তাদের বিখ্যাত "হোয়াই নেশনস ফেইল" বইতে। যেখানে পৃথিবীর জাতিগুলোর ব্যবধানের পেছনে পূর্বের প্রচলিত কিছু যুক্তি যেমন খণ্ডন করা হয়েছে তেমন উদাহরণ ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে পিছিয়ে থাকার অপ্রকাশিত কারণ।

পূর্বে জাতিগুলোর মাঝে ব্যবধান সৃষ্টির জন্য মূলত ৩ টি কারণকে দায়ী করা হতো। 
১. ভৌগোলিক হাইপোথিসিস
২. সংস্কৃতিক হাইপোথিসিস এবং
৩. অজ্ঞতা হাইপোথিসাস

ভৌগোলিক হাইপোথিসিস মতে বিশ্বাস করা হতো যে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চলের মানুষ জাতিগত ভাবেই অলস। ফলে তারা কঠোর পরিশ্রম করে না যার কারণে তারা দরিদ্র রয়ে গিয়েছে। এমনকি তাদের মাঝে উদ্ভাবনী মেধা ও অনুসন্ধানী মননের অভাব রয়েছে।

আর সংস্কৃতিক হাইপোথিসিস অনুসারে ধারণা করা হয় যে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের মানুষ জাদু ও ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসী ও আধুনিক প্রযুক্তি বিরোধী। তাছাড়া তারা স্বভাবগতভাবে উড়নচণ্ডী হয়ে থাকে। উদাহরন হিসাবে উল্লেখ করা হয় আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষের কথা।

অন্যদিকে অজ্ঞতা হাইপোথিসিসে বিশ্বাসীরা মনে করেন দেশগুলো পিছিয়ে আছে কারণ সেখানে দেশ পরিচলনার জন্য যোগ্য লোকের বড়ই অভাব। যারা রাষ্ট্র পরিচলনা করছে তারা জানে না কিভাবে পলিসি গ্রহণ করলে দেশ এগিয়ে যাবে।

তবে " হোয়াই নেশনস ফেইল" বইতে এই হাইপোথিসিসগুলো পাশ কাটিয়ে বলা হয়েছে পৃথিবীর জাতিগুলোর মাঝে পার্থক্য করে দেয় মূলত দেশগুলোর একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেগুলো মূলত ঠিক করে দেয় একটি দেশ বা সমাজ কে পরিচলনা করবে আর কিভাবে করবে।

এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১. অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ( Inclusive institution),
২. শোষণমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ( Extractive institution)।

আবার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুটিভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১. অন্তর্ভুক্তমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Inclusive institution),
২. শোষণমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Extractive institution)।

অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট বুঝানো হয়েছে যেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রচলিত ও যেখানে সকলের সমান প্রবেশাধিকার রয়েছে।এখানে সকালেই নিজেদের ইচ্ছা, যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ লাভ করে। আর এর ফলে তৈরি হয় Virtuous circle যেটি নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎসাহিত করে ও অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচলনা নিশ্চিত করে।

আর শোষণমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ( Extractive institution) পরিচলিত হয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের ইচ্ছানুযায়ী। নাগরিকদের পছন্দ- অপছন্দের কোন মূল্য এখানে থাকে না যেটি তৈরি করে একটি vicious circle।

তাছাড়া বইটিতে অন্তর্ভুক্তমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Inclusive institution) বলতে বুঝানো হয়েছে যেখানে রাষ্ট ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে এবং প্রতিটি নাগরিক মত প্রকাশ করতে পারেন।

আর শোষণমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Extractive institution) বলতে বুঝানো হয়েছে সেই সমাজ ব্যবস্থাকে যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন থাকে না তেমনি ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে কিছু ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে।

এখন প্রশ্ন জাগে তাহলে কিছু দেশ কেন inclusive institution তৈরি করে অন্যদের মতো এগিয়ে যায় না? এই বিষয়টি নির্ভর করে একটি দেশের সামগ্রিক অবস্থা ও ইতিহাসের কিছু বিশেষ মুহুর্তে গৃহীত পদক্ষেপের উপর। ইউরোপের কিছু দেশে inclusive institutions গড়ে উঠার পেছনে অবদান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকটি বিপ্লব যেমন The glorious revolution ও ফরাসি বিপ্লবের কথা।

আবার কিছু দেশে Extractive institution গড়ে উঠার পেছনে দায়ী করা হয়েছে দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে যারা উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্ত হবার পরও শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে গিয়েছে ব্যক্তি স্বার্থের কারণে।

পৃথিবীর জাতিগুলোর এগিয়ে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়া এবং উন্নয়নের প্রকৃত সংঙা বুঝতে আগ্রহী সবার জন্য " হোয়াই নেশনস ফেইল" বইটি অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়বস্তু হতে পারে।

Comments

    Please login to post comment. Login