চলুন , একটা গল্প শুনি -
একদা বঙ্গবাসী ছিল খুব সহজ-সরল । বিশেষত গ্রাম-গঞ্জে । তখন বঙ্গবাসী বিশ্বকে গ্রামে রূপান্তরের কথা শুধু হাস্যকর ই নয় বরং পাগলের প্রলাপ বলে মনে করত । ইন্টারনেট , ফেসবুক , ইউটিউব ইত্যাদি আধুনিককালের শব্দভাণ্ডার তখনও জ্যোতির্বিদ্যার অনুরূপ গবেষণার বিষয় । সহজ-সরল বঙ্গবাসী সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে যেতো । আবার , সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে না আসতে ঘুমিয়েও যেতো । কেউ নতুন কোনো কাজ করার আগে অভিজ্ঞ কারো সাথে পরামর্শ করত । কেউ কোনো ভুল ধরিয়ে দিলে তা আমলে নিয়ে নিজের কাজকে আরো বেশি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করত । বলা যায় যে , মানুষ বিনা পয়সায় পাওয়া উপদেশ কাজে লাগিয়ে নিজের উন্নতি সাধন করত । কথায় আছে , " বঙ্গবাসী বিনা পয়সায় পেলে আলকাতরাও খায় ।" তবে , সেকালে বঙ্গবাসীর মাঝে কিছু সমস্যাও বিদ্যমান ছিল । এর মধ্যে অন্যতম হলো : সমালোচনা । অর্থাৎ , কেউ যদি এমন কিছু করতে চাইতো যা সমাজে অন্য কারো বোধগম্য নয় , তাহলে সমাজে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে যেতো । সে ঝড়ে উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্তও হতো । ফলে , অনেকে লোকে কি বলবে এই ভয়ে মহৎ কিছু করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করত না । অনেকটা "পাছে লোকে কিছু বলে " কবিতার মতো । শুধু বঙ্গেই যে এমন সমস্যা ছিল ব্যপারটা এমন নয় । সুদূর পাশ্চাত্যেও এর ব্যতিক্রম ছিল না । সমাজে প্রতিষ্ঠিত কোনো ভুলের বিপরীতে কথা বলা ছিল গুরুতর অপরাধ ।
এর পরের গল্পটা আরো হতাশার -
এর পর ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে লাগলো ইন্টারনেট , ফেসবুক , ইউটিউব । যাত্রা শুরু হলো বিশ্বগ্রাম নামক নতুন দুনিয়ার । বঙ্গবাসী এখন আর আগের মতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না , সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যায় না । এখন তারা , ঘুমাতে যায় ভোরের সূর্য উঠার সময় । ঘুম থেকে উঠে সূর্য হাপিয়ে যাওয়ার পর যখন ক্লান্ত দেহে বিশ্রাম নেয় তখন । এখন যুক্তি আর প্রযুক্তির বদৌলতে তাদের আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় না । যৎসামান্য করতে হয় তা নিজের মতো ই করে । ইন্টারনেট , ফেসবুক , ইউটিউব ইত্যাদির বদৌলতে মানুষ যখন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রযুক্তির সান্নিধ্য গ্রহণ করতে শুরু করেছে , তখন চেঙ্গিস খানের ন্যায় আবির্ভাব ঘটলো হালের টিকটক, লাইকি , বিগো , ফ্রি ফায়ার , পাবজি ইত্যাদি অসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ধূলাহীন খেলাধুলার ।
এখন সবাই মোটিভেশনাল স্পিকার , কন্টেন্ট ক্রিয়েটর , অ আ ক খ না জানা গবেষক , বিশ্লেষক । ব্যপারটা অনেকটা এমন ," কাজীর নামে বিচার করছে পেশকারের সহোদর ।" অর্থাৎ , সবাই নিজের কাজ ফেলে অন্যের কাজ করতে ব্যস্ত । যার যা মনে চায় তাই করছে । কেউ আর আগের মত "পাছে লোকে কিছু বলে " কবিতার মতো সমালোচনার ভয়ে পিছু হটে না । যাক , কামিনী রায় এতদিনে সফলতা পেল । এখন বঙ্গবাসী বিনা পয়সায় পাওয়া আলকাতরার মত কারো কাছে পাওয়া বিনা পয়সার উপদেশ কাজে লাগিয়ে নিজের কাজের সংশোধন করে না । বরং , প্রত্যেকেই এখন ধরেই নিয়েছে সমালোচনা মানেই খারাপ কাজ । সমালোচক মানেই তার কোনো কাজকর্ম নাই , তাই সে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজ করে সময় কাটায় । প্রত্যেকেই অবচেতন মনে এটা স্থির করে নিয়েছে যে , একমাত্র আমিই ঠিক বাকি সবাই ভুল এবং সবাই আমার খারাপ চায় , সবাই আমার শত্রু , কেউ আমার ভালো দেখতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি । সবাই বোধহয় ভারসাম্য নামক শব্দটা অভিধান থেকে তুলে দিয়েছে । কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চায় না । হয় সে বাড়াবাড়ি করবে নয়তো সে ছাড়াছাড়ি করবে । যদি সবাই ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করত তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না । হয়তোবা এখনো মানুষ সমালোচনাকে আশীর্বাদস্বরূপ গ্রহণ করত । হয়তো মানুষ এই ধারণা পোষণ করত যে , সমালোচক শুভাকাঙ্ক্ষীও হতে পারে । এক্ষেত্রে দোষ ঐ সকল সমালোচকদের যারা সমালোচনার নামে সর্বদা নেতিবাচক কথা ই বলেছে । " সমালোচনা মানে শুধু নেতিবাচক কথা বলে কাউকে হতাশ করা নয় বরং গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে তার বিপরীতে অধিকতর ভালো ও যৌক্তিক সমাধান ও পরামর্শ দেয়া "। সমালোচনার নামে শুধু নেতিবাচক কথা বলে , ভুল ধরে কারো কোনো উপকার করা সম্ভব নয় । সমালোচনার ফল তখনই মিষ্টি হবে যখন সমালোচনার বিপরীতে অধিকতর ভালো কোনো পরামর্শ পাওয়া যাবে । এই ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফল আজ পুরো মানব জাতিকে ভোগ করতে হচ্ছে ।
আজ আমি পরাজিত এক কলম সৈনিক হিসেবে শুধু তাই বলতে পারি যেমন সিরাজ তার ভবিষ্যত পরাজয় অনুমান করে বলেছিল , " আজ আমার ভরসা আমার সৈন্যবাহিনীর শক্তিতে নয় । আমার একমাত্র ভরসা আগামীকাল যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মীর জাফর , রায়দুর্লভ , ইয়ার লুৎফদের মনে যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সেই সম্ভাবনাটুকু ।" আমিও তেমন আশাবাদী , যদি ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী উপহার দেয়ার আশায় এ জাতি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে !
85
View
Comments
-
ভোঁতা পেন্সিল
11 months ago
পুরো লেখাটি পড়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাবেন । ভালো বা খারাপ যেকোনো মতামত । আপনার মতামত আমাকে হয়তো আরো বেশি লেখালেখি করতে উৎসাহ দিবে অথবা আমার লেখার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। ধন্যবাদ ।