রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কলকাতার ব্যস্ত শহর একেবারে নিস্তব্ধ। মধ্যরাত পেরোতে এখনো কিছুটা সময় বাকি। এক পুরনো দোতলা বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন বিভাস সেন। পেশায় ইতিহাসের অধ্যাপক, বয়স প্রায় পঞ্চাশ। সারা জীবন বইয়ের ভেতর ডুবে থাকলেও আজ রাতে তার মন একেবারেই অশান্ত।
আজ সকালেই একটি চিঠি এসেছে। প্রেরকের নাম নেই। চিঠিতে লেখা, "আপনার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত রাত আসতে চলেছে। প্রস্তুত থাকুন। রাত ১২টা। বাড়ির দোতলার খালি ঘরটি খুলে দেখুন।" বিভাসবাবু সাধারণত এসব কথায় কান দেন না, কিন্তু চিঠির শেষ লাইনটা তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল: "আপনার অতীত আপনাকে ডাকছে।"
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। বারোটা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। বিভাসবাবু ধীরে ধীরে দোতলার সেই খালি ঘরের দিকে এগিয়ে যান। ঘরটি প্রায় পাঁচ বছর ধরে বন্ধ। পুরনো কাঠের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন। ঘরের ভেতর থেকে যেন এক চাপা শ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে।
তিনি সাহস সঞ্চয় করে দরজাটি খুললেন। ঘরটি অন্ধকারে ডুবে ছিল। এক হাতে টর্চ জ্বালিয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন। মুহূর্তেই তার চোখে পড়ল একটি পুরনো ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কটি তিনি আগে কখনো দেখেননি। ধুলো-ময়লা জমে গেছে তার উপর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ট্রাঙ্কের উপর একটি নতুন লাল কাপড় মোড়া ছিল।
বিভাসবাবু ধীরে ধীরে ট্রাঙ্কের কাছে গেলেন। হাত কাঁপছিল। তিনি কাপড়টা সরিয়ে ট্রাঙ্কটি খুললেন। ভিতরে ছিল কয়েকটি পুরনো চিঠি, একটা পকেট ঘড়ি, আর একটা ছোট কাঠের বাক্স। চিঠিগুলোতে কোনো ঠিকানা বা নাম লেখা ছিল না, কিন্তু প্রত্যেকটিতে একই কথা লেখা: "আমাকে খুঁজে বের করো।"
কাঠের বাক্সটি খুলতেই বিভাসবাবুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাক্সে ছিল একটি ছোট পুতুল, যার চোখ দুটি গভীর কালো আর তার হাতে বাঁধা ছিল একটি চেন। পুতুলটি বিভাসবাবুকে তার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিল।
ছোটবেলায় তার বন্ধু রাহুল একবার তাকে বলেছিল, “এই পুতুলটিতে ভয়ানক রহস্য লুকিয়ে আছে। একবার যদি এটা কেউ খুঁজে পায়, তার জীবন বদলে যাবে। কিন্তু এটা ভুল মানুষের হাতে পড়লে বিপদ অনিবার্য।” বিভাসবাবু তখন রাহুলের কথা নিয়ে মজা করেছিলেন।
কিন্তু এখন এই পুতুলটা দেখে তার মনে অদ্ভুত এক শীতল অনুভূতি হলো। হঠাৎ করেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। যেন কেউ তাকে দেখছে। তিনি পেছন ফিরে তাকালেন, কিন্তু ঘরে কেউ নেই।
তবুও বিভাসবাবু অদ্ভুত এক কৌতূহল বোধ করলেন। তিনি ট্রাঙ্কের সবকিছু নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। সারা রাত বসে পুতুলটিকে আর চিঠিগুলো পড়তে থাকলেন।
পরদিন সকালে বিভাসবাবুর এক পুরনো বন্ধু, ডক্টর অমিতাভ রায়, তার বাড়িতে এলেন। অমিতাভ একজন গবেষক, অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে কাজ করেন। বিভাসবাবু সব ঘটনা তাকে খুলে বললেন।
অমিতাভ পুতুলটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “বিভাস, এটা কোনো সাধারণ পুতুল নয়। এটি এক ধরনের তান্ত্রিক বস্তু। হয়তো এর মাধ্যমে কেউ তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তোমার অতীতে এমন কিছু কি ঘটেছিল, যা তুমি ভুলে গিয়েছিলে?”
বিভাসবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার একটি পুরনো মন্দিরে আমি আর রাহুল একবার গিয়েছিলাম। সেখানে একটা কাঠের বাক্স খুঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত আমাদের ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। রাহুল বলেছিল, বাক্সের ভেতর কোনো ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে। পরদিন রাহুল হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা আর কখনো তাকে খুঁজে পাইনি।”
অমিতাভ গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, “আমার মনে হয়, রাহুলের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই পুতুল আর চিঠিগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে। হয়তো কেউ তোমাকে সেই সত্য জানতে বাধ্য করছে।”
তারা ঠিক করলেন, মন্দিরে গিয়ে রহস্যের সমাধান করতে হবে।
পরের দিন রাতেই তারা মন্দিরে গেলেন। মন্দির এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। ভেতরে ঢুকতেই বিভাসবাবুর মনে হলো, কেউ যেন তাদের দেখছে। তারা পুরনো সেই জায়গায় গিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে একটি বাক্স খুঁজে পেলেন। বাক্স খুলতেই তারা চমকে গেলেন।
বাক্সের ভেতরে একটি পাণ্ডুলিপি ছিল। তাতে লেখা: "রাহুল বাঁচাতে চেয়েছিল সত্যকে। কিন্তু তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি যদি এই বাক্স খুলে থাকো, তবে সত্য প্রকাশের দায়িত্ব তোমার।"
পাণ্ডুলিপিটি পড়া মাত্রই বিভাসবাবুর চোখের সামনে অদ্ভুত সব চিত্র ভেসে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, রাহুলকে কে বা কারা অপহরণ করে মন্দিরের ভেতরেই আটকে রেখেছিল।
তারা দ্রুত মন্দিরের আরেকটি পুরনো কক্ষে গেলেন। সেখানে একটি গোপন দরজা খুঁজে পেলেন। দরজা খুলতেই বিভাসবাবু আর অমিতাভ শিউরে উঠলেন।
ভেতরে রাহুলের পচা দেহ পড়ে ছিল। কিন্তু তার পাশে আরেকটি চিঠি পাওয়া গেল। তাতে লেখা ছিল: "আমাকে বিশ্বাস করো, বিভাস। আমার মৃত্যুর পেছনের সত্যটা পৃথিবীকে জানাও।"
বিভাসবাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, রাহুলের জীবনের সত্য উদঘাটন করবেন।
রহস্যের জট এখনো পুরোপুরি খোলেনি। কিন্তু বিভাসবাবু জানেন, তাদের এই অনুসন্ধান সবে শুরু হলো। অন্ধকার থেকে আলোতে আসার জন্য তাকে অনেক দূর যেতে হবে।
শেষ হয়েও হলো না শেষ।