ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মের মধ্যে অন্যতম প্রধান ধর্ম হলো বেদ ভিত্তিক ধর্ম যা সনাতনী ধর্ম নামে পরিচিত। বহু ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মটাকে হিন্দু ধর্ম নামে ব্যবহার করা হয়। যেখানে হিন্দু শব্দটা ভারতের মানুষকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। হিন্দু শব্দটার প্রচলন হয় ১৯ শতকে ব্রিটিশ লেখকদের লেখার মাধ্যমে। তবে হিন্দু শব্দের ব্যবহার প্রথম শুরু করে আরবরা। ভারতের অধিবাসী বোঝাতে তারা হিন্দু বা হিন্দি শব্দটা ব্যবহার করতো এবং এখনো করে থাকে। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভারতবর্ষের সতন্ত্র ধর্মীয় ধারনা বোঝাতে হিন্দু শব্দটা ব্যবহার করা হয়।
সনাতন কি?
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ঈশ্বরে বিশ্বাস। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং তিনি অনন্য পরমসত্তা। নানা পূজা এবং অগ্নি কেন্দ্রিক নানা আচার পালনের মাধ্যমে দেবতাদের প্রার্থনা করা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিবাহে অগ্নিকে সাক্ষি রেখে বিবাহ করা হয়, কারণ তাদের বিশ্বাস মতে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, ঊষা, ঈশ্বরের শক্তির পরিচয় বহন করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা তাদের ধর্মীয় কিতাবকে অনুসরণ না করে পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠানকে অনুসরণ করে থাকে। ফলে নানা আচরণে তাদের কিতাব এর বিপরীত কাজ করতে দেখা যায়। এ কিতাবে এক ইশ্বরবাদ থাকলেও একটা বৃহৎ অংশের সেই সম্পর্কে ধারণা নাই বললেই চলে।
সনাতনে দেবতা সংখ্যা
সনাতন ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ঈশ্বরে বিশ্বাস। আর যদি কিতাব অনুসারে বলি, এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাস। ঈশ্বর এক, তার কোনো শরিক নেই। তিনি পরমসত্তা, অনন্য, অভিন্ন। তিনি নিরাকার, তবে প্রয়োজন অনুসারে তিনি নানা রূপ ধরতে পারেন। বিভিন্ন অবতার, দেবদেবি প্রভৃতি মূলত ঈশ্বরের প্রকাশ। ফলে কোনো ধর্মীয় কিভাবে ঈশ্বরের ছবি না থাকলেও । অনেক অনুসারী নিজেদের সুবিধার্থে নিজের মতো করে দেবতাদের রূপ দিয়েছেন। এমন নানা মত, নানা মানুষের মাধ্যমে এক ঈশ্বরের ৩৩ কোটি রূপ তৈরি করে নিয়েছে। অনেকেই বলে থাকে এখানে ৩৩ কোটি শব্দটা সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে যেখানে ৩৩টা অনুবাদ করা হয়েছে কিন্তু কোটি শব্দটার অনুবাদ করা হয় নি। তাদের মতে সংস্কৃত কোটি অর্থ রূপ। অর্থাৎ ঈশ্বরের ৩৩ টি রূপ। যা ৩৩ কোটি দেবতা নামে পরিচিত। সনাতনীরা প্রতিটি কাজের জন্য দেবতাকে নানা রূপে রূপায়িত করেছেন। যেমন নারায়ন হলেন হলেন শ্রেষ্ঠ পুরুষ যিনি জলে বাস করেন। এজন্য নারায়নকে প্রকাশের সময় প্রায়শই জলের উপর অবস্থানকারী মূর্তিতে চিত্রিত করা হয়। কৃষ্ণ হলেন পূর্ণ অবতর, যিনি ভগবত গীতার প্রবর্তক। তিনি বাঁশি বাজাতেন বলে তাকে প্রায়শই বাঁশি হাতে চিত্রিত করা হয়। সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যা অর্জনের দেবি। তাই তাকে এ বাদ্য যন্ত্র হাতে চিত্রিত করা হয়। এভাবেই ইচ্ছেমতো ঈশ্বরকে চিত্রিত করা হয়।
গ্রাম্য নারীদের ও বর্তমান জেনারেশনের দেবতা বিশ্বাসঃ
এখনো অনেক সনাতনী আছে যারা সনাতনী ধর্মের এক ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে জানেই না। এখনো তারা মনে করে তাদের দেবতার সংখ্যা একাধিক। কারণ তারা কিতাব পরেনি, ফলে কিতাবে দেওয়া নির্দেশ এবং এক ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ছোটরা বাড়ির বড়দের পূজা দেখে, কথা শুনে বড় হয়। আবার তারা যখন বড় হয় তখন তাদের ছোটদের শুনায়। এভাবেই চলে আসছে যুগের পর যুগ। ফলে সত্যি ঘটনা সম্পর্কে তাদের এখনো কোনো ধারণাই নাই। তবে সেক্ষেত্রে আরো একটি বড় সমস্যা হচ্ছে পুরহিত, যাদেরকে তারা ধর্মীয় জ্ঞানে পরিপূর্ণ ধর্মীয় গুরু হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু ধর্মীয় গুরুরা কিতাবে শিক্ষিত না হয়ে, বংশ পরম্পরায় পুরহিত পদ পাওয়ায় তাদেরও ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব থাকে। আবার অনেক অসাধু পুরহিত আছে যারা, তাদের পেশা এবং অর্থলালসায় তাদের অনুসারীদেরকে সঠিক তথ্য বলে না, যা এখন ব্যাপক ভাবে দেখা যায়।
অন্যদিকে এর বিপরীতও রয়েছে। বর্তমান শিক্ষিত জনগণ পুরহিত কেন্দ্রিক না হয়ে কিতাব কেন্দ্রিক ধর্মকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। আবার বর্তমানে অনেক সনাতনী আছে যারা কিতাব ও পুরহিতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার পালনে নানা পার্থক্য দেখায় ধর্মের প্রতি তাদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। অশিক্ষিত কিছু বিশ্বাসির মতে দেবতা একাধিক হলেও বর্তমান শিক্ষিত জনগণ মনে করে ঈশ্বর এক তবে তার নানা রূপ। আবার অনেকেই আছে যারা মনে করে ঈশ্বর এক এবং তার কোনো প্রতি মূর্তি বা ছবি নেই। "না তাস্তে প্রাতিমা আস্তি" (রিগ বেদ,৩২/৩)। অর্থ "ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নেই"। কিন্তু এখানে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণও ছোট বেলা থেকে অনুসরণ করা পুরহিত ও অবিভাবকদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে।
একক দেবতায় বিশ্বাস
সনাতনী কিতাব ও তাদের দ্বারা পালনকৃত আচার- অনুষ্ঠানগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন রয়েছে একেশ্বরের চিন্তা তেমনি রয়েছে বিভিন্ন অবতার এবং বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস, পূজা- আর্চনার কথা। বেদ ও উপনিষদ গুলো তাদের প্রধান ধর্মীয় কিতাব, সেগুলোতে বলা হয়েছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তবে প্রচলিত বিভিন্ন দেব-দেবির প্রতি উপাসনা সনাতনী ধর্মের একটি বিশেষ দিক।
সনাতনী ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে আরাধ্য দেবতা কথাটা শোনা যায়। বিভিন্ন জন ইশ্বরের বিভিন্ন রূপকে পূজা করেন। যার যাকে বেশি পছন্দ হয় তাকে পূজা করে। তাদের মতে ঈশ্বর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। এবং সাধারণ মানুষের মতো বসবাস করে। তারাও আবার অন্য কোনো দেবতাকে পূজা করে। যেমন শ্রী কৃষ্ণ নিজেই নিজের আরাধ্য ছিলেন।
ঈশ্বর যেকোনো রূপ নিয়ে যখনই জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা সবাই ভারতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যেমন শ্রী কৃষ্ণ মধুরাইতে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তবে এই ভারত বলতে তারা বোঝায় অখণ্ড ভারতকে, অখণ্ড ভারত বলতে বর্তমান ভারত, পাকিস্তান,শ্রীলংকা, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ। মার্কণ্ডেপুরাণম বই অনুসারে অখণ্ড ভারতের পশ্চিম পাশের হিমালয় পর্বতে সেইসময় ভগবান ব্রহ্মার বাস ছিল। যা ব্রহ্মপুরি নামে পরিচিত। সেখানে আরো অনেক দেব-দেবীর বাস ছিলো। তারা মনে করে ভারত হলো দেব-দেবীদের দেশ। তাইতো ভারতের কিছু সনাতনী সংঘ ভারতকে সনাতনী দেশে পরিণত করতে অখণ্ড ভারত প্রস্তাবনা পেশ করেছেন।