Posts

উপন্যাস

ক্ষমা করেছো কি?

December 21, 2024

Rumana Islam Riya

গোটা ষাট বছরের জীবনের হিসেব মেলাতে পার্কের বেঞ্চের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন রিটায়ার্ড প্রফেসর শৌভিক চ্যাটার্জী। তিনি একান্তেই এই বেঞ্চটাতে দুই ঘন্টা যাবত বসে আছেন। সামনেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলছিল। এখন তারাও তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কোন মানুষকে তারা এতক্ষণ পার্কের এক জায়গায় বসে থাকতে আগে কখনো দেখেনি। শৌভিক চ্যাটার্জী বিগত ত্রিশ বছর যাবত এই জায়গাটায় ইচ্ছাকৃতভাবেই আসেননি। কেন আসতেন না তা তিনি নিজেও ঠিক বুঝ উঠতে পারেননি এতদিনেও।  আজ
তিনি সেটাই ভাবছেন। কেন তিনি আসেননি এখানে গোটা ত্রিশ  বছরেও? কেন? আর আজই বা কেন হঠাৎ খুব এখানে আসতে মন চাইলো? আজ সকাল থেকেই তার দিনটা যেন কেমন গোলমেলেভাবে কাটছে। প্রতিদিন সকালে তিনি তিন কাপ চা খান। ১ম কাপ চা সিগারেটের সাথে, ২য় কাপ চা তার ঠিক ১ ঘন্টা পর এবং ৩য় কাপ ঠিক সকাল ১১:৫৫ মিনিটে। কিন্তু কোনো কাপেই তিনি চিনি খান না। তার এই  রুটিন গত ৭ বছর ধরে চলছে। রামু তার দেখাশোনা করে।খুবই কাজের লোক। কোনো কাজেই তার ভুল হয় না। কিন্তু আজ সকালে সে ভুলে তার ১ম কাপ চায়েই চিনি দিয়ে ফেলেছে। যদিও শৌভিক চ্যাটার্জী জানেন Man is mortal- মানুষ মাত্রই ভুল। কিন্তু সকালের ১ম কাপ চা খাওয়াতে বাধা পাওয়ায় তিনি আজ আর চা খাননি।  ঘটনা এখানেই শেষ না। সকালের ১ম কাপ চায়ের পর তিনি খবরের কাগজ পড়া শুরু করেন, অর্ধেক পড়ে বাকিটা পড়েন ২য় কাপ চা খাওয়ার পর। ১ম কাপ চায়ে চিনি পাওয়ার পর চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বসে ছিলেন কতক্ষণ। অর্ধেক পড়ে রেখেও দিয়েছিলেন সাইড টেবিলে। কিন্তু যথাসময়ে খবরের কাগজটা তিনি আর খুঁজে পাননি। এভাবেই তার সকাল কেটেছে। দুপুরে স্নানাহার সেরেই তিনি এই বেঞ্চে এসে বসেছেন। বেঞ্চে এসে বসামাত্রই একটা চিন্তা তার মনে উঁকি দিচ্ছে। মানুষের জীবনের সার্থকতা আসলে কোথায়? তিনি কি একজন সার্থক মানুষ? তিনি জানেন, তার জীবনে সফলতার বিন্দুমাত্র অভাব নেই। সফলতার সাথে সে তার কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছে। জীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কোনোকিছুর সাথেই আপোস করেননি। তবে তার জীবনে কিসের অভাব? পূর্ণতার? জীবনে সফলতাই কি সব না? সফল হওয়ার পরও পূর্ণতার ব্যাপারটা কি রয়েই যায় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে? পূর্ণতা-অপূর্ণতার হিসাব মেলাতে মেলাতে এখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল। সামনের ছেলে-মেয়েগুলোও বাড়ি ফিরে গেছে। কাউকেই তেমন চোখে পড়ছে না। পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় একনাগাড়ে কোকিলটা ডেকেই যাচ্ছে ; থামার কোনো উপসর্গই দেখা যাচ্ছে না। একে তো সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে, তাই এখন আর কোকিলের ডাকও ভালো লাগছে না। কেমন একটা ঝিমঝিমানি ভাব আসছে শরীরে। আধখোলা চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠলো এক নারীমূর্তি। একটু স্পষ্ট হতেই চেনা একটা মুখ ফুটে উঠলো। চিনতে পেরেই আঁৎকে উঠলেন তিনি। "নাহ্! এটা সম্ভব না। নাহ্; আমি তোমায় দেখতে চাই না। পালিয়ে পালিয়ে যেমন ছিলাম, তেমনি থাকতে চাই" মনে মনে ভাবলেন তিনি। হঠাৎই তার বুক কেঁপে উঠলো। তৎক্ষনাৎ বেঞ্চ থেকে উঠে পড়লেন তিনি আর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলেন যে এটা তার কল্পনা না। বাস্তবেই অনা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অতি পরিচিত একজন মানুষ, যার সাথে কিনা ছিল একসময়ের এত পরিচয়, তাকেও অনেক কাল চোখের সামনে না দেখলে, হঠাৎ যদি কোথাও দেখা হয় ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু অনা যদি আজ তার কাছে ত্রিশটা বছরের কৈফিয়ত চায়? যদি একের পর এক প্রশ্ন করে তাকে? তাহলে কি উত্তর দেবে সে? তবে কি এই শেষ বয়সে এসে আবারো অনার কাছে ধরা পড়তে হবে তাকে? কিন্তু তিনি যে ধরা পড়তে নারাজ।

অঙ্গনা রায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শৌভিক চ্যাটার্জীর দিকে। মৃদু বাতাসে উড়ছে তাদের উভয়েরই বার্ধক্যের শুভ্র কেশ। কোকিলটা যেন আরো জোরালোভাবে ডাকা শুরু করেছে। শৌভিক চ্যাটার্জীর নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। হৃৎস্পন্দন আরো বেড়ে গেছে।  হঠাৎই তিনি চেহারা শক্ত করে অঙ্গনা রায়ের দিকে তাকালেন। অভিনয় আর ক্ষোভের সংমিশ্রণ দৃষ্টিতে স্পষ্ট।  কিন্তু অঙ্গনা রায় গলা খুবই স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলেন," কেমন আছো শুভ?" এই কণ্ঠস্বরে নেই কোনো অভিমান বা অভিযোগ, নেই কোনো ক্ষোভ বা ঘৃণা। শুধু আছে আত্মসংবরণের চেষ্টা। টানা ত্রিশ বছর পর অঙ্গনার কণ্ঠস্বর শুনে হৃদয় যেন আরো কেঁপে উঠলো শৌভিক চ্যাটার্জীর। তিনি সামান্য পিছিয়ে গেলেন, আরো সূক্ষ্ণভাবে অঙ্গনাকে দেখার চেষ্টা করলেন, এ তার তরুণ বয়সের অভ্যাস। এখন গোধূলি, এই গোধূলির ক্ষীণ আলোয় বার্ধক্যে উপনীত অনার দিকে তাকিয়েও তার সেই ত্রিশ বছর আগেকার অনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। পরনে সাদা- কালো শাড়ি, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, মাথায় কাঁচা-পাঁকা চুল।

গ্রামের নাম স্বর্গছেড়া। স্বর্গছেড়ায় যে কয়টি পরিবার আছে তারা সবাই আত্মীয়ের মতোই এতগুলো বছর ধরে বসবাস করে আসছে। অসীম রায় গৃহস্থ মানুষ। গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন ব্যক্তির বাড়িতে যে কয়টি ঘর থাকা প্রয়োজন তার সবকটিই তার বাড়িতে আছে।  এছাড়াও গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু। অসীম রায়ের স্ত্রী সুললিতা রায় নিতান্ত সংসারী। স্বামী,তিন মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়েই তার সংসার। অসীম রায়ের যখন পাঁচ বছর বয়স তখনই তাঁর বাবা মারা যান। অনেক কষ্টে তার মা তাকে মানুষ করেছে। এখন ওকালতি করেই অসীম রায় পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় অসীম রায়ের মনে কোনো দুঃখবোধ নেই। প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই তিনি তার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেছিলেন সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে সেটা কোনো বিষয় না, সন্তান সুস্থ থাকলেই তিনি খুশি। সুললিতাও তখন স্বামীর কথা মেনে নিয়েই খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হওয়ায় সুললিতার মুখ গম্ভীর হলো। কিন্তু অসীম রায়ের এতে কোনো মনঃকষ্ট নেই। বড়ো মেয়ে অবলা, মেজ মেয়ে অঙ্গনা, ছোটো মেয়ে অপলা। গোটা সমাজ যদিও তখনও নারীশিক্ষার ব্যাপারে, তেমন উৎসাহ দেখায়নি, কিন্তু অসীম রায় ঠিকই তার মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উৎসাহ দেন।
অসীম রায়ের মা মনোরমা রায় উঠোনে মোড়া পেতে বসে আছেন। এমন সময়ে অবলা আর অঙ্গনা স্কুল থেকে ফিরে উঠোনে পা দিয়েছে। 
"বড় দিদিভাই, একটু এদিকে আয় দেখি"
অবলা এগিয়ে গেল ঠাকুমার দিকে। অঙ্গনা ঘরে কাপড় ছাড়তে গিয়েও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়লো।' বাহ্! কি চমৎকার শিউলি ফুলের গন্ধ।'
"তোর মাকে একটু আলতা বৌদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আয়" 
অবলা স্কুলের পোশাক পরেই মাকে ডাকার জন্য আলতা জেঠিমার বাড়ির দিকে রওনা হলো। বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে বাইরে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো অঙ্গনা। মনোরমা এখনও উঠোনে বসে আছেন। উঠোন থেকে কয়েক পা এগিয়েই ঠাকুমার ঘরের পাশে তাদের বাড়ির শিউলি ফুল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো অঙ্গনা। সাদা চাদরের মতো বিছিয়ে আছে ফুলগুলো। অঙ্গনা ফ্রকের এক কোণা হাতে নিয়ে তুলতে লাগলো ফুলগুলো।এমন সময়ে মনোরমার গলা শোনা গেল।

Comments

    Please login to post comment. Login