অনামিকার খোলা চিঠি
------নাসিমা খান।
অরুণা
বিশ্বাস কর, তোর ফেলে যাওয়া সংসারটা আমি সেভাবেই ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন যে পারলাম না সে তোকে বোঝাতে পারব না। আদিত্যকে আমিও ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভালোবাসা ইচ্ছে কোরে করে নারে কেউ। ভালোবাসা হয়ে যায় রে। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নয়। অনেকেই বলেছিল, আমি অন্যায় করেছি। তোর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। আপাতদৃষ্টিতে এটাই সত্য। কিন্তু এই সত্যের বাইরেও কিছু সত্য রয়েছে। যেটা আমিও বুঝিনি। তাই আমাকেও ছাড়তে হল আদিত্যকে।
তুই কানাডায় যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলি আমি যেন কিছুতেই অন্তু এবং আদিত্যকে কষ্ট পেতে না দিই। মাত্র তো দুটো বছর। তুই ফিরে আসবি। এই দুই বছর আমি অন্তুকে মায়ের মতো আগলাতে গিয়ে বারবার আদিত্যের সঙ্গে ঠোকর খেয়েছি। বাজারে যাওয়া, অন্তুর কাপড় কেনা,অন্তুর অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। প্রত্যেক মুহুর্তে আদিত্য আমার সঙ্গে। দুটো বছর মাত্র নয়। দুটো বছর লক্ষ-কোটি বছরের মতো হয়ে গিয়েছিল।
আমার অসুখ হলে আদিত্য আর আদিত্যর কিছু হলে আমি। এই যে নির্ভরশীলতা; এই নির্ভরশীলতাই কাল হয়েছিল। দায়িত্ব কখনো ছেড়ে দিতে নেই। তুই সেটা বুঝছিস হাড়ে হাড়ে।
দায়িত্ব নিতে এবং কারো কাছে নিজের দায়িত্ব দিতে গেলে যে সবটুকু চলে যায়; যখন বুঝলাম তখন আদিত্যের ও একই অবস্থা। আমরা দুজন তোর কাছে কতখানি ছোট হয়েছিলাম সে তোকে বোঝাতে পারব না। একটা কথা বলতে পারি তোর অন্তুকে সত্যিই আমি মায়ের মতোই ভালোবেসেছিলাম। কখনো আমি যে সৎ মা এটা বুঝতে দিইনি।
আজ তোর অন্তু ভার্সিটির লেকচারার। দেখতে দেখতে কত বছর পার হয়ে গেল। তুইও অভিমান করে ছেলেটার জন্যও একবার দেশে আসলি না এরকমই ভেবেছিলাম। তোর চিঠি টা আমি একশোবার পড়েছি। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি, এই বিশ্বাসঘাতকতা তোকে এতটা আঘাত দিয়েছে যে তুই নিজেই নিজের দুটো চোখ শেষ করে দিয়েছিস। পৃথিবীর মানুষের কুৎসিত মুখগুলো তুই আর দেখতে চাসনে। কথাগুলো যখন শুনলাম আমিও স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে শাস্তি দিতে গিয়ে আমি সংসারবিমুখ হয়ে গিয়েছিলাম। আদিত্য কখন খাচ্ছে, কখন অফিস যাচ্ছে আমি খেয়াল করতে পারি নি। । তোর এই অবস্থার কথা শুনে আমি নিজেকে প্রবোধ দিতে পারিনি।
আর আদিত্য কিছুদিন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।। তারপর ভিড়ে গেল বন্ধুদের আড্ডায়। সেখানেই উপমাকে পেয়ে যায় আদিত্য। সেই উপমা, তোর মনে আছে? অই যে ঢাকা থেকে এসে ভর্তি হয়েছিল আমাদের কলেজে আমাদের ইয়ারে। তখনই খুব খোলামেলা পোশাক পরত। ছেলেরা যাকে দেখে সিটি বাজাত? খুব সুন্দর ছিল দেখতে?
উপমা বাসায় আসতে শুরু করল। আমাকে জাগিয়ে তুলতে চাইল ওরা। ওরা আমাকে বোঝাল, বিয়েটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। আমার আর আদিত্যের জোড়া বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস জোড়াটোড়া কিছু নয়। আমি যদি তোর সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে না নিতাম তাহলে কিছুই ঘটত না। আসলে কী জানিস ছেলে মেয়েতে কোনো দিন বন্ধুত্ব হয় না। তারা ভাইও নয়। ছেলে মেয়েতে মেলামেশা করতে গেলে ভিতরে একটা অলিখিত সীমারেখা টেনে নিতে হয়। বন্ধুত্বের কী ভয়াবহ পরিণতি সে তুই যেমন বুঝেছিলি আজ আমিও বুঝছি। ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ এরা হচ্ছে চুম্বক। মিশতে মিশতে একে অপরের দিকে আকর্ষিত হবেই। নইলে যে শাস্তি তুই পেয়েছিস সেই শাস্তি এই ষাট বছর বয়সে এসে আমাকেও পেতে হবে কেন? ধর্মীয় অনুশাসনও জীবনে চলতে গেলে খুব দরকার এটা বুঝতেই পারিনি।
হ্যাঁরে! উপমা এক সময় আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে উঠল। অনুশোচনাও ভুলে গেলাম। আমরা এক সাথে ঘুরি, বেড়াই। আড্ডা, মজলিস, এর জন্মদিন, তার ম্যারেজ ডে এসবে আমাদের দিনগুলো ভালোই চলছিল। সারাদেশে বিশাল একটা গ্যাং আমাদের। না না কানিজ, রহিমা ওরা বুড়িয়ে গেছে। ওরা পার্লার চেনে না। ওরা নানি দাদি এখন। পান খায় গ্রামের স্কুলে পড়ায়। আমাদের সাথে ওদের যোগাযোগ নেই। আমাদের গ্যাংয়ে দেশের বিখ্যাত মানুষ সব। আমরা স্লিভলেস ব্লাউজ পরি। চুলে কালার করি। আমরা ক্যাবারে যাই। তোর তো দুটো চোখই নেই। কী করে দেখবি আমাদের অধঃপতন?
আসলে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের শেকড় কোথায়? কোথায় আমাদের ভিত রয়েছে? কিন্তু এই অধঃপতন যে একদিন আমার কাছ থেকেও আদিত্যকে কেড়ে নিয়ে যাবে উপমা, সে আমার চিন্তায় ছিল না। উপমার বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গাড়ি বাড়ি সব আছে। আমার আর আদিত্যের সব থেকে কাছের বন্ধু উপমা।
মাঝে ডেঙ্গু হয়েছিল আমার। হাসপাতালে ছিলাম পনেরো দিনের বেশি। আমার রক্ত যোগাড় করতে উপমা আর আদিত্যের সে কী ছোটাছুটি! একটা স্যালাইনের জন্যও অনেক সময় ছুটতে হয়েছে শহরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। ডেঙুতে চোখের সামনে অনেকের মৃত্যু দেখলাম। আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর বুঝতে পারলাম আদিত্যের কোথায় যেন বসে গেছে উপমা। ভালো রান্না করলে উপমাকে ফোন। উপমা একা বেরুতে পারছে না আদিত্য সাথে যাচ্ছে। একদিন অন্তুই আমাকে বলল, আম্মু তুমি বাবাকে এভাবে ছেড়ে দিয়েছ কেন? সারাদিন তো বাবা উপমা আন্টির সাথে থাকেন।
আমি কিঞ্চিৎ ভাবিনিরে! এই ষাট বছর বয়সে এসে মানুষও বদলে যায়। আসলে মানুষের বদলাবার জন্য কোনো বয়সের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু পরিস্থিতির। যে কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেকে অভিযোজন করার সক্ষমতা রাখে। শুধু তৈরি করে দিতে হবে পরিস্থিতি আর অবস্থা।
আমি আদিত্যকে সেই পরিস্থিতিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। না আদিত্য আর উপমা এখনো বিয়ে করেনি। আমি চলে যাবার পর নিশ্চয় করবে। অন্তুও এখন চায় না তার বাবার সাথে আমরা থাকি। অন্তু মাঝে মাঝে বলে, আম্মু তুমি এতটা নির্বোধ কেন? তোমার পার্সোনালিটি এতো কম কেন? কেন থাকবে তুমি অই লোকটার সাথে? কী করে তোমার জন্য? তার সময় কোথায় তোমার জন্য?
তাই আমরা আজই চলে যাব তোর সেই ফেলে যাওয়া সংসার। ওটা আমারও রইল না আর। পারলাম না তোর অন্তুকে তোর যত্নে গড়ে তোলা বাড়িটাতে রাখতে। আমি আর অন্তু ভার্সিটির পাশে একটা বাসা নিয়েছি। সেখানেই আমরা উঠব। মাঝে মাঝে অন্তু মরিয়া হয়ে যায় কানাডায় যাবে। তোকে খুঁজে বের করবেই। কোথায় লুকিয়ে আছিস। আমাদের অন্তু একটু একটু করে টাকা জমিয়েছে । পাসপোর্ট হয়ে গেছে ওর। নতুন বাসায় যাওয়ার পর ভিসার জন্য আবেদন করবে। খুব শীঘ্রই কানাডা যাবে তোর অন্তু।
আমি অন্তুর নেওয়া বাসায় অপেক্ষা করব তোর ক্ষমা টুকু পাওয়ার আশায়।
ইতি
অনামিকা।
তারিখঃ ২২/১২/২০২৩