পোস্টস

চিন্তা

ট্রাইবাল সমাজ এবং আধুনিককালের মৌলবাদ

১৬ মে ২০২৪

মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন

মূল লেখক মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন

ট্রাইবাল সমাজ এবং আধুনিককালের মৌলবাদ

উপমহাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ট্রাইবাল ধারণার প্রথম প্রয়োগ করেন শংকরাচার্য, তারপর প্রায় এক হাজার বছর বাদে হাজি শরীয়াতুল্লাহ। ট্রাইবাল সমাজের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো নিজেদের রীতি-নীতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকা। বাহির থেকে প্রবেশ করে তাদের বিশুদ্ধতাকে ক্ষীণ করে এমন যে কোনো কিছুকে ঠেকিয়ে দেবার প্রাণান্ত প্রয়াস করে তারা। আন্দামান-নিকবোর দ্বীপপুঞ্জে নর্থ সেন্টিনাল নামক একটি দ্বীপে হাজারখানেক মানুষ দ্বীপটাকে প্রায় অভেদ্য এক দুর্গে পরিণত করে বসবাস করছে। হাজার হাজার বছর ধরে তাদের জনসংখ্যা বিভিন্ন কারনে কমেছে বেড়েছে। কিন্তু জীবনযাপন পদ্ধতি একই রয়ে গেছে সব সময়। তাদের সাথে সভ্য মানুষের যোগাযোগের সব রকম চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তাদের বসবাসের দ্বীপকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঐ দ্বীপের পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত প্রবেশ নিষিদ্ধের সীমানা টানা হয়েছে। যারাই তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তাদেরকেই তীর মেরে হত্যা করে সৈকতে মাটিচাপা দিয়েছে। ভিন্ন রীতি ভিন্ন সংস্কৃতি সব অস্বীকার করে আদিম অবস্থায় অবিকৃত থাকার মরণপণ প্রচেষ্টায় আজো তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরবিতে যা বিদআত বাংলাতে তাই প্রগতিশীলতা। আর এই প্রগতিশীলতাকে অগ্রাহ্য করার সংস্কৃতিকেই ট্রাইবাল সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়। 

বর্তমান সভ্যতা প্রগতির নামান্তর। ট্রাইবাল পদ্ধতিকে ভঙ্গ করেই মানুষ সভ্য হয়েছে। সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিটি শক্তিশালী জাতি আজকের অবস্থানে এসে দাড়িয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ট্রাইব এবং ধর্মগুলো সামাজিক জাদুঘর হয়ে সভ্যতার শোকেসে বিরাজ করছে। দেখো, আমাদের পূর্ববর্তীদের সংস্কৃতি এই রকম ছিল। তারা এই কাজ করতো এবং এই এই কাজগুলোকে নিষিদ্ধ জ্ঞান করতো। সামাজিক জাদুঘরগুলো থেকে এভাবে দেখে নিয়ে সময়ের প্রবাহকে স্বচক্ষে দেখার ভালো মাধ্যম হতে পারে ট্রাইবাল সংকৃতি। ট্রাইবের মানুষগুলো এত পরিশ্রম, এত ত্যাগ ও সংগ্রাম করে নিজেদের আদিম অবস্থায় রেখে দেবার অপ্রয়োজনীয় কসরত করলেও আদতে তাদের সকল প্রচেষ্টা সভ্য পৃথিবীর কাছে ভালো জাদুঘর ছাড়া আর কিছু নয়। ট্রাইবগুলোকে সংরক্ষিত ও নিরাপদ রাখার যে বিধি-বিধান আরোপ করে রাষ্ট্রগুলো, তা ঐ জাদুঘরকে মানসম্মত করার পরিকল্পনার অংশমাত্র।

যে জাতি যত বিশুদ্ধবাদী সে জাতি তত নাজুক। এভাবে বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে গিয়ে বহু জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অনেকে বিলুপ্ত হবার পথে রয়েছে। সর্বজাতি সমন্বয় তথা সমগ্র মানবজাতিকে একটামাত্র জাতি জ্ঞান করে যারা সমন্বয় এবং আত্তীকরণকে গ্রহণ করে নিয়েছে কেবল তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে। এই সূত্রের বাইরে সম্ভবত পৃথিবীর কোনো মানুষই নেই। যে যত বেশি বিশ্বনাগরিক সে তত বেশি যোগ্য এই পৃথিবীতে। সমগ্র পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রাণী এখন একটাই। তাই রঙ, দৈর্ঘ, আকার ও ভাষা দিয়ে যতই বিভেদ করা হোক, সকল মানুষের সাথে সহাবস্থান ও বৈচিত্রকে গ্রহণ করার মনোভাব না থাকলে কোনো জাতিরই টিকের থাকার নিশ্চয়তা নেই। হয় অধিকতর শক্তিশালী জাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে, নয় নিজেদের মধ্যকার কলহে, নির্মূল হবার অপেক্ষায় থাকবে।

একটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে গিয়ে নির্মমতা প্রদর্শন। সেন্টিনাল দ্বীপের জাতিগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করে তাদের নির্মমতা প্রদর্শন করছে। তাদের ভেতরে ঢুকতে চাওয়া মানুষকে হত্যা করে বাইরের মানুষকে নিষ্ঠুরতার বার্তা দেয়। তাদেরকে তাই বিরক্ত করতে কেউ যায় না এখন। বরং চারপাশ ঘিরে রেখে সংরক্ষিত অঞ্চলের চিড়িয়া বানিয়ে রাখা হয়েছে। এই বিশুদ্ধতাবাদী নির্মমতা যদি বৃহত্তর জনসমাজের মাঝখানে বসে চালাতো তাহলে এতদিনে তাদের সবার নির্মূল হওয়া সময়ের ব্যাপার হতো মাত্র। আজ যারা পৃথিবীতে বিচিত্র জনতার মাঝখানে বসে মৌলবাদী বিশুদ্ধতার নির্মমতা প্রদর্শন করছে তারাও একদিন সমূলে নির্মূল হবে। সভ্য মানুষের দায়িত্ব হলো এই নির্মূল হবার কাজকর্ম প্রতিহত করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

জাতি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, পরিবার নির্বিশেষে কোনো কিছুতেই ট্রাইবাল পদ্ধতি স্বাস্থ্যকর নয়। রক্ষণশীলতার নামে আত্মঘাতী কর্মকান্ড বিস্তৃত হয়। রক্ষা করার কিছু নাই মানুষের হাতে। কেননা নতুনকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক জড়তা রয়েছে। চাইলেই এক বাক্যে নতুনকে গ্রহণ করতে পারে না। নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করতে পারে। এটা না করে যে কোনো নতুনকে ঠেকিয়ে দেবার বিধি প্রস্তুত করা মূলত অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আর এই অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাকে অকাজের ভারে ভারাক্রান্ত করে ফেলে। আর ভেতর থেকে নির্মূল হবার উপযোগীতার দিকে ধাবিত করে।

ভয় এবং লোভ দেখিয়ে অশিক্ষিত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটাও কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করার তাগিদ থেকে। সামষ্টিক কল্যাণে নয়। সামষ্টিক কল্যাণ তো সর্বব্যাপি মুক্তিতে। চিন্তার মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি, সংস্কৃতির মুক্তি, আচরণের মুক্তি।

# মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন