রাত গভীর। শহরের কোলাহল দূরে সরে গেছে, আর তারার আলোয় ভেসে যাচ্ছে গ্রামের ছোট্ট বাড়িটির উঠান। বাড়িটির মধ্যে বসে আছে একটি কিশোর, নাম তার তাহসিন। তাহসিনের বয়স পনেরো, আর তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অজস্র প্রশ্ন। আজকের রাতটি একটু অন্যরকম, কারণ তার দাদা, যিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানের গভীর জ্ঞানী, একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে গল্প বলবেন।
দাদা মৃদু হেসে তাহসিনের সামনে বসলেন।
"তুমি জানো, তাহসিন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা কতটা রহস্যময়?"
তাহসিন কৌতূহলী চোখে তাকালো।
"দাদা, আমি তো কত বই পড়েছি, ইউটিউবেও অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।"
দাদা একটু থেমে বললেন,
"ঠিক তাই। বিজ্ঞান এবং ধর্ম—দুই দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে দেখতে হবে, তাহলেই বোঝা যাবে এর প্রকৃত রহস্য। আজ আমি তোমাকে একটি গল্প বলি, যার মাধ্যমে তুমি এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি ভালোভাবে বুঝতে পারবে।"
এক সময়ের কথা। একটি গ্রামে ছিল রুহান নামে এক যুবক। সে ছিল জ্ঞান-পিপাসু, সবকিছু জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তার মনে। একদিন, এক বৃদ্ধ তার হাতে একটি মানচিত্র দিয়ে বলল,
"এই মানচিত্রটি তোমাকে একটি অজানা গুহায় নিয়ে যাবে, যেখানে তুমি বস্তু জগতের সব রহস্যের উত্তর পাবে। তবে শর্ত একটাই—তোমাকে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার আলোয় পথ চলতে হবে।"
রুহান রাজি হয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।
চলার পথে রুহান এক বৈজ্ঞানিকের সাথে দেখা করল। বৈজ্ঞানিক তাকে বলল,
"তুমি কি জানো, এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ড কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে?"
রুহান একটু থমকে জিজ্ঞেস করল,
"তুমি কী বলতে চাও?"
বৈজ্ঞানিক বলল,
"বিজ্ঞান বলছে, আমাদের মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি 'বিগ ব্যাং' দিয়ে শুরু হয়েছিল। একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে ছিল অসীম শক্তি। হঠাৎ সেই বিন্দুটি বিস্ফোরিত হলো, আর সৃষ্টি হলো স্থান, কাল, আর পদার্থ।"
রুহান মুগ্ধ হয়ে শুনল, কিন্তু তার মনে আরও প্রশ্ন জাগল।
"এই বিন্দুটা কোথা থেকে এলো? এটা কি নিজে নিজেই ছিল?"
বৈজ্ঞানিক মৃদু হেসে বলল,
"এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান এখনো দিতে পারেনি। তবে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এর পেছনে এমন কোনো শক্তি আছে, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে।"
রুহান আবার চলতে শুরু করল। এবার সে একটি মসজিদে পৌঁছাল।
মসজিদের এক হুজুর তাকে বললেন,
"তুমি কি জানো, এই ব্রহ্মাণ্ডের শুরু কিভাবে হলো?"
রুহান বলল,
"বিজ্ঞান বলছে, এটি একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে।"
সাধু হাসলেন।
"ঠিক বলেছ। কিন্তু তুমি কি ভেবেছ, সেই বিস্ফোরণ কে ঘটাল? ধর্ম বলে, সৃষ্টিকর্তাই এই মহাবিশ্বের পরিকল্পনা করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
'তিনিই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং সেগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে, তা ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।' (সূরা হাদিদ: ৪)
যদি বিজ্ঞান এবং ধর্মকে মিলিয়ে দেখো, তুমি বুঝতে পারবে, মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে একটি সুনিপুণ পরিকল্পনা আছে।"
রুহান এবার আরও গভীরে যাত্রা করল। পথে সে একটি গাছের নিচে বসা এক দার্শনিককে পেল। দার্শনিক বললেন,
"তুমি কি জানো, জীবন কিভাবে শুরু হলো?"
রুহান উত্তর দিল,
"বিজ্ঞান বলে, প্রাথমিক কোষগুলো রসায়ন থেকে এসেছে। কিন্তু এর চেতনা বা আত্মা কোথা থেকে এলো?"
দার্শনিক বললেন,
"সেটাই বড় রহস্য। বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে জীবনের পদার্থিক দিক, কিন্তু আত্মা? ধর্ম বলে, আত্মা সৃষ্টিকর্তার দেয়া একটি দান।
'তিনিই তোমার মধ্যে তাঁর আত্মা থেকে ফুঁক দিয়েছেন।' (সূরা সাজদাহ: ৯)"
রুহান আরও গভীর জঙ্গলে পৌঁছাল। সেখানে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাকে বললেন,
"তুমি কি জানো, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী?"
রুহান উত্তরে বলল,
"বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্ব হয়তো একদিন শীতল হয়ে যাবে। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে।"
জ্যোতির্বিজ্ঞানী বললেন,
"ঠিক বলেছ। তবে ধর্ম আরও একটি ধারণা দেয়। ধর্ম বলে, একদিন এই জগৎ ধ্বংস হবে এবং নতুন করে সৃষ্টি হবে। কুরআনে বলা হয়েছে:
'যেদিন আমরা আসমানকে একেবারে ভাঁজ করে ফেলব, যেমন করে লেখা কাগজ ভাঁজ করা হয়। তারপর আমরা এটি পুনরায় সৃষ্টি করব।' (সূরা আম্বিয়া: ১০৪)"
শেষে রুহান সেই গুহায় পৌঁছাল, যেখানে ছিল বস্তু জগতের সমস্ত উত্তর। সেখানে দুটি লেখা খোদাই করা ছিল।
প্রথম লেখায় লেখা ছিল:
"বিজ্ঞান তোমাকে প্রকৃতির রহস্য জানতে সাহায্য করবে।"
দ্বিতীয় লেখায় লেখা ছিল:
"ধর্ম তোমাকে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য জানতে সাহায্য করবে।"
রুহান তখন উপলব্ধি করল, বস্তু জগতের রহস্য বুঝতে হলে বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয় অপরিহার্য।
তাহসিন মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছিল। দাদা বললেন,
"এই গল্প থেকে কী শিখলে?"
তাহসিন উত্তরে বলল,
"আমি বুঝলাম, দাদা, বস্তু জগতের রহস্য বোঝার জন্য শুধু বিজ্ঞান জানলেই হয় না, ধর্মকেও বোঝা দরকার।"
দাদা মৃদু হেসে বললেন,
"তুমি ঠিকই বলেছ, তাহসিন।"
গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাহসিন মনে মনে বলল,
"বস্তু জগতের রহস্য জানার যাত্রা আসলে অন্তহীন। তবে এর প্রতিটি ধাপই আমাদের জানার পরিধি বাড়ায়।"