Posts

গল্প

"অবিনশ্বর অনুভূতি"

December 23, 2024

jeet karemaker

135
View

                                                                                                                                                                                                           "অবিনশ্বর অনুভূতি"

নিশীথের জীবনে ভালোবাসা মানে ছিল একরকম শূন্যতা। সে বরাবরই একা থাকতে পছন্দ করত, বই পড়া, নতুন কিছু শেখা আর নিজের জগতে মগ্ন থাকা তার নিত্যদিনের সঙ্গী। বন্ধুরাও মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, "তুই তো একেবারে রোবটের মতো!" কিন্তু নিশীথ জানত, তার পৃথিবী ঠিকই সুন্দর, নিঃসঙ্গ হলেও।

একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে বসে একটি পুরনো বই পড়ছিল নিশীথ। হঠাৎ এক মিষ্টি কণ্ঠ শুনল, "এই বইটা কি আপনার প্রিয়?" মুখ তুলে তাকাতেই দেখল এক অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চশমা, হাতে নোটবুক। নিশীথ কিছুটা অবাক হয়ে বলল, "হ্যাঁ, এটি আমার খুব প্রিয় বই। আপনি পড়েছেন?" মেয়েটি হাসি দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, বহুবার। তবে প্রতিবার নতুন কিছু শিখি। আমি মীনা।"

তারপর থেকে নিশীথ আর মীনার মধ্যে নিয়মিত কথা হতে লাগল। তারা বই নিয়ে আলোচনা করত, জীবনের গল্প শেয়ার করত। নিশীথ বুঝতে পারল, মীনার সাথে কথা বললেই তার একাকিত্ব যেন দূর হয়ে যায়। মীনার হাসি, তার চিন্তা করার ধরন—সবকিছু নিশীথের কাছে যেন এক নতুন দুনিয়ার দরজা খুলে দিল।

একদিন বিকেলে কলেজের ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে মীনা হঠাৎ বলল, "তুমি জানো, নিশীথ, মানুষকে বুঝতে সময় লাগে, কিন্তু একবার যখন সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয়, তখন সেটাই ভালোবাসার প্রথম ধাপ।" নিশীথ একটু হাসল, বলল, "তাহলে কি আমি বুঝতে শুরু করেছি?" মীনা মৃদু হেসে বলল, "হয়তো তুমি অনেক আগেই বুঝে গেছ।"

এরপর তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় রূপ নিল। নিশীথের জীবনে শূন্যতার জায়গা নিল এক আশ্চর্য মুগ্ধতা। মীনার মতো একজন মানুষ, যাকে ভালোবেসে নিশীথ তার নিজের জীবনের অর্থ নতুন করে খুঁজে পেল।  

তাদের ভালোবাসার গল্প প্রমাণ করল, জীবন যতই নিঃসঙ্গ মনে হোক না কেন, একদিন ঠিক এমন কেউ এসে উপস্থিত হবে, যে আপনার একাকিত্ব ভরিয়ে দেবে, শুধু এক টুকরো হাসি আর মনের স্পর্শ দিয়ে। 
নিশীথ আর মীনার সম্পর্ক ক্রমেই গভীর হতে লাগল। তারা শুধু দুজন একসঙ্গে সময় কাটাতেই পছন্দ করত না; একে অপরকে নতুন কিছু শিখতেও সাহায্য করত। মীনা ছিল সাহসী ও উচ্ছল, আর নিশীথ ছিল শান্ত ও চিন্তাশীল। মীনা নিশীথকে জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলো দেখতে শেখাল, আর নিশীথ মীনাকে শেখাল ধৈর্য এবং গভীরভাবে চিন্তা করার গুরুত্ব।  

একদিন মীনা প্রস্তাব দিল, "চলো, পাহাড়ে ঘুরতে যাই। বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির মধ্যে একটু সময় কাটানো দরকার।" নিশীথ প্রথমে দ্বিধা করলেও মীনার আবেগে রাজি হয়ে গেল।

তারা পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় তারা পাহাড়ের চূড়ায় বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। চারপাশে নীরবতা, আকাশে কমলা আর সোনালী রঙের খেলা। নিশীথ প্রথমবার অনুভব করল প্রকৃতির স্পর্শ কীভাবে হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতে পারে। সে মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি যদি না থাকতে, আমি হয়তো কখনোই এই সৌন্দর্যটা দেখতে পেতাম না।"

মীনা হেসে বলল, "আমি কিছুই করিনি। তুমি নিজেই সব দেখেছ, আমি শুধু তোমার চোখ খুলে দিয়েছি।"

সেই মুহূর্তে নিশীথ তার হৃদয়ের গভীর অনুভূতিটা বুঝতে পারল। মীনাকে ছাড়া সে আর তার জীবন কল্পনাও করতে পারছিল না। সেই রাতে তারা তারার নিচে বসে গল্প করছিল, যখন নিশীথ ধীরে ধীরে বলল, "মীনা, আমি কখনো ভাবিনি আমার মতো একজন নিঃসঙ্গ মানুষ ভালোবাসার মতো কিছু অনুভব করতে পারবে। কিন্তু তুমি আমাকে দেখিয়েছ ভালোবাসা কেমন হতে পারে। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়।"

মীনার চোখ ভিজে উঠল। সে বলল, "ভালোবাসা এমনই। এটা আমাদের ভেতরে থাকে, শুধু কেউ এসে সেটাকে জাগিয়ে তোলে। তুমিও আমার জীবনে সেই জাদু নিয়ে এসেছ, নিশীথ।"

তাদের সেই পাহাড়ের সন্ধ্যা যেন তাদের সম্পর্কের প্রতীক হয়ে উঠল। প্রকৃতির মতোই, তাদের ভালোবাসা ছিল বিশুদ্ধ, গভীর এবং নিরবধি।

পাহাড় থেকে ফিরে আসার পর তাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়ে উঠল। নিশীথ তার কাজের মাঝে মীনার জন্য সময় বের করত, আর মীনা প্রতিদিন নতুন নতুন পরিকল্পনা করত, যাতে তারা একসঙ্গে আরও বেশি স্মৃতি তৈরি করতে পারে।

একদিন তারা কলেজের শেষ দিন উদযাপন করছিল। নিশীথ বলল, "এই পথচলা যদি কখনো শেষ হয়, তুমি কি মনে করবে আমাদের গল্পটা অসম্পূর্ণ?" মীনা হাসি দিয়ে বলল, "গল্প কখনো শেষ হয় না, নিশীথ। প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের গল্পেরই অংশ। আমরা আলাদা হয়ে গেলেও, এই মুহূর্তগুলো আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে।"

জীবনের পথে তারা হয়তো আলাদা গন্তব্যে পাড়ি দিল, কিন্তু তাদের ভালোবাসার স্মৃতিগুলো রয়ে গেল চিরস্মরণীয়। ভালোবাসা যেমন হওয়া উচিত—বিশুদ্ধ, নিঃস্বার্থ আর চিরন্তন।

সময় কেটে গেল। নিশীথ আর মীনা নিজেদের ক্যারিয়ার এবং জীবনের পথে আলাদা হয়ে গেলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ কখনো পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মধ্যে অনেক কিছু বদলাল—নতুন কাজ, নতুন শহর, নতুন মানুষ। কিন্তু মনের গভীরে কোথাও একে অপরের জন্য একটা বিশেষ জায়গা চিরকাল রয়ে গেল।

নিশীথ তার লেখালেখি নিয়ে বেশ নাম করেছিল। একদিন একটি বড় সাহিত্য উৎসবে তার আমন্ত্রণ এল। নিশীথ মঞ্চে উঠে তার নতুন উপন্যাস নিয়ে কথা বলছিল। সে বলল, "এই গল্পটা এক বিশেষ মানুষকে উৎসর্গ করা। সে আমাকে শিখিয়েছে জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আসলে কতটা মূল্যবান।" উৎসব শেষে, ভীড়ের মধ্যে একটি পরিচিত মুখ নজরে এলো। মীনা! অনেক বছর পর তাকে দেখে নিশীথের হৃদয় যেন হঠাৎ করেই স্পন্দিত হয়ে উঠল।

মীনা এগিয়ে এসে বলল, "তোমার কথা শুনে মনে হলো, সেই বিশেষ মানুষ আমি।" নিশীথ মৃদু হেসে বলল, "তুমি জানো যে তা ঠিক।"

তারা দীর্ঘক্ষণ কথা বলল। মীনা জানাল যে সে এখন একটি এনজিও-তে কাজ করছে, যেখানে সে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার চেষ্টা করছে। নিশীথ তার কাজের প্রতি মীনার গভীর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলো।

মীনা জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি এখনো সেই পুরনো নিশীথ? যে নিঃসঙ্গতায় নিজেকে খুঁজে পেত?" নিশীথ বলল, "না, তুমি আমার জীবনে এসে সব বদলে দিয়েছিলে। এখন আমি মানুষকে বুঝতে পারি, তাদের অনুভব করতে পারি। এটা সব তোমার জন্য।"

মীনা হেসে বলল, "তুমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত দেখাচ্ছো। আমি খুশি।"

নিশীথ এবং মীনা আবার একে অপরের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করল। তারা জীবনের নানা গল্প ভাগ করত, পুরনো স্মৃতি নিয়ে হাসাহাসি করত। নিশীথ একদিন সাহস করে বলল, "মীনা, এত বছর পরেও তুমি আমার কাছে ঠিক আগের মতোই। আমি জানি, আমাদের পথ আলাদা হয়েছিল, কিন্তু আমার ভালোবাসা কখনো বদলায়নি। তুমি কি মনে করো, আমরা আবার একসঙ্গে নতুন করে শুরু করতে পারি?"

মীনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "তোমার মতো মানুষকে ভালোবাসা সহজ, কিন্তু ত্যাগ করা কঠিন। আমি কখনো তোমাকে ভুলিনি, নিশীথ। আসলে, আমি অপেক্ষা করছিলাম।"

এইভাবে, অনেক বছর পর আবার তাদের পথ এক হলো। তাদের ভালোবাসার গল্পের নতুন অধ্যায় শুরু হলো, কিন্তু এবার তারা জানত যে ভালোবাসা শুধু একটা মুহূর্ত নয়, বরং তা জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে জেগে থাকে।  

নিশীথ আর মীনা একসঙ্গে জীবনের প্রতিটা ছোট ছোট মুহূর্ত উপভোগ করল। তাদের গল্প প্রমাণ করল যে সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো হারায় না; সময়, দূরত্ব, আর জীবনের ওঠাপড়ার মধ্যেও সেটা টিকে থাকে।


                                                                                           এই গল্পের মূল কথা হলো ভালোবাসার শক্তি এবং তার স্থায়িত্ব।  

                                                            1. ভালোবাসা মানুষকে বদলাতে পারে: গল্পটি দেখায় কীভাবে মীনা নিশীথের নিঃসঙ্গ জীবনে আলো এনে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। 
                                                                                                ভালোবাসা শুধু একে অপরকে পছন্দ করার বিষয় নয়, এটি একে অপরকে সমৃদ্ধ করারও একটি মাধ্যম।  

                                                            2. ভালোবাসা সময় এবং দূরত্ব জয় করতে পারে: নিশীথ এবং মীনা জীবনের ভিন্ন পথে হাঁটলেও তাদের অনুভূতি কখনো ম্লান হয়নি।
                                                                                                        তারা প্রমাণ করে যে সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো হারায় না, সময় ও দূরত্বের মধ্যেও এটি টিকে থাকে।  

                                                            3. প্রতীক্ষা এবং পুনর্মিলন: জীবনে এমন সময় আসে যখন সম্পর্ক ভেঙে যায় বা দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু যদি ভালোবাসা সত্যিই গভীর 
                                                                                       এবং নিঃস্বার্থ হয়, তাহলে সময়মতো তা আবার একত্রিত হতে পারে|

                                                                   মূল বার্তা: ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, চিরন্তন এবং জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আমাদের হৃদয়ে থেকে যায়। এটি শুধু একে অপরের প্রতি 
                                                                              অনুভূতি নয়, বরং একে অপরকে পূর্ণ করার এক অমূল্য উপহার।

Comments

    Please login to post comment. Login