পোস্টস

গল্প

বিভোর ও ঘোর

১৭ মে ২০২৪

অধীতি

মূল লেখক অধীতি

মগডালের উপর কাকটা ভিজে যাচ্ছে। দক্ষিণের জানালার শিক গলে অনবরত গুড়ি বৃষ্টি এসে পড়ছে নাকের ডগায়। হালকা শীত, মোটা কাঁথা আবার চলন্ত বৈদ্যুতিক পাখা। শেষ রাত থেকে ফাগুনের বৃষ্টি অঝোরে ঝরে পড়ছে। দক্ষিণা বাতাসের সাথে কার্নিশ চুইয়ে টুপ টুপ শব্দে আছড়ে পড়ছে কঙ্ক্রিটের উপর। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় দেশটিতে এখন হারহামেশাই ঘটে এমন। বৃষ্টির আলাপন চলে বারোমাস। পাশের বাসার টিনে বৃষ্টির তান,মোড়ের মাঠে আল্পনা এঁকে উপচে পড়ছে বাতায়নে। আষাঢ় মাসের এরকম সকালগুলোতে আধঘুম চোখে কাক ভেজা হয়ে ক্লাস ধরার স্মৃতি রোমন্থন করার সাথে শিহরণ নিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ঘুমিয়ে পড়লাম, সাড়ে সাতটার এলার্মও তখন ঘুমাচ্ছে। 

মিঁয়াও মিঁয়াও বিড়ালের ডাক। তন্দ্রালু দেহে অনুমান করতে পারছিনা বিড়ালের ডাকের উৎস। বাসায় একা। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বিড়াল আসবে কোত্থেকে! কফি পাওয়া গেলে ভালো হতো।বিছানা ছেড়ে উঠে পত্রিকার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি বসে আছে কালো বিড়াল। পেটে বাচ্চা এসেছে বোঝা যায়। একটু গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছিস। হতচকিত একটা উত্তর এলো "আমাকে বলছেন??" ঘুম থেকে উঠে নিটোল সুন্দরীর আচমকা প্রশ্নে  থতমত খেয়ে গেলাম। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করলাম বিড়ালের দিকে। খানিক তাকিয়ে রইল,তারপর সিড়ি মাড়িয়ে উপরের পথ ধরলো।

নীচ থেকে পত্রিকা হাতে নিতেই মিয়াও বলে মাথা এলিয়ে দিলো। চুলকে দিলাম যৎসামান্য। রুমের ভেতরে চলে আসলো দরজা ভিজিয়ে দিয়ে রুমের দিকে যেতে তীক্ষ্ণ কন্ঠে ডাক পাড়লো। বিড়ালের ভাষা বুঝিনা কিন্ত ওর ডাকের তীক্ষ্ণ শব্দ বুঝিয়ে দিলো কতটা ক্ষুধার্ত। গ্যাস নেই দু'দিন ধরে। অনুনয় করে মাথা চুলকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি খাওয়াবো তোকে? গ্যাস নেই,রান্না হয় নি কিছুই। কে বোঝে কার ভাষা। বাধ্য হয়ে ফ্রিজ খুলে দু'দিনের বাসি ভাত দিলাম।মুখ ছুঁইয়ে সরিয়ে নিলো।কাতর কন্ঠে বল্লাম কিছু নেইরে আর। ও তখন আহ্লাদে মাথা ঘসে চলছে। এরপর ভাতের ঠান্ডা  কমে গেলে খেয়ে নিলো।জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চা হবে কবে তোর? জবাবে মাথা এলিয়ে চুলকে নিলো।

বাসা ভাড়া নেবার প্রথমদিন ওর সাথে দেখা। কালো বিড়াল, লাল চোখে তাকিয়ে আছে।আমাকে দেখে এক দৌড়ে উধাও। তারপর দেখা নেই। হঠাৎ রাত তিনটের দিকে ধুম করে শব্দ হলো।চেয়ে দেখি এক নিমিষে কালো কিছু একটা চলে গেলো সামনা থেকে, তখন সবেমাত্র  এল্যান পোর বিখ্যাত গল্প "কালো বিড়াল" পড়ে সমাপ্ত করে রাতের একমাত্র শেষ চুরুট ধরাবার জন্য দিয়াশলাই খুঁজছি। সিড়ির বাতির মলিন আলোয় দেখি ইঁদুর মুখে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। চকচকে দু-চোখ জ্বল জ্বল করছে, নিবন্ধিত দৃষ্টি আমার ওপরে, ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। গল্পের মোহ কাটতে না কাটতেই বাস্তবের কালো বিড়ালের সাথে দেখা হবে ভাবতেও পারিনি। চুরুট ধরিয়ে আড় চোখে তাকিয়ে দেখি ওটা নেই। শুনেছি ভূত-প্রেত আগুন দেখলে পালায়। ভয়টা আরো গাঢ় হলো।

প্রতিদিন সকালে পত্রিকা খুলে ধর্ষণের খবর খুজে বের করাটা এক প্রকারের নিত্যকর্মে রূপ নিয়েছিলো। একজনের সাথে বাজি ধরেছিলাম, ধর্ষণের সংবাদ ছাড়া সংবাদপত্র পাবেনা। জয় হয়েছিল আমার, বিজয়ী হিসেবে একটানা সাতদিন দুটো করে চুরুট পেয়েছিলাম। এখন আরেকটা বাজি ধরা যায় “শিক্ষার্থী নির্যাতন” কিন্তু কে ধরবে বাজি?
নীচে নামবো, সকালের নাস্তা হয়নি।
মিঁয়াও! আরে তুই! কেমন আছিস? উত্তর দিলনা, পেট দেখে বুঝলাম বাচ্চা প্রসব করেছে। চুলকে দিতে গেলাম, গলা এলিয়ে দিলো, দু'ফোটা আশ্রু মিয়িয়ে গেলো কালো পশমের অন্তরালে। কষ্ট বেশি হইছে? নিরবে পড়ে রইল পায়ের উপর। কিছু খেয়েছিস? সামনা দিয়ে তড়িৎ গতিতে ইঁদুর চলে গেলো। নির্বাক দৃষ্টিতে দেখলো, ভাবলাম কষ্ট বেশি হয়েছে। চুলকে দিয়ে বল্লাম দাড়া নাস্তা নিয়ে আসি তুই থাক। সিড়ি মাড়িয়ে নীচে নামতে লাগলো, নির্বিকার ভাবে হেটে গেলো দরজার বাইরে।

হালকা গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নাস্তা নিয়ে হোটেল থেকে দ্রুতপদে ফিরছি। শরীরে কেমন বিষণ্ণতা জেঁকে বসেছে। দেখি গলির মোড়ে ড্রেনের ভেতর মুখ করে বসে কিছু একটা দেখছে। চলন্ত অবস্থায় বল্লাম তোর বাচ্চাগুলো দেখাবি না? সবগুলো কালো হয়েছে? কালো হলে কিন্তু বিয়ে হবেনা, আমাকে কোনটা দিবি? ড্রেনের দিকে তাকিয়ে রইল ফিরেও তাকালো না। বল্লাম বাসার ইঁদুরটা ভালো ছিলো ড্রেনের গুলোতো ময়লা। এরপর পাশে গিয়ে ড্রেনের দিকে তাকালাম। আৎকে উঠে পেছনে সরে আসলাম। চার চারটে সদ্যোজাত কালো বাচ্চা আটকে আছে ড্রেনের শিকে। শহরে বৃষ্টির জল নিয়ে নিতে পারছেনা বুড়িগঙ্গার স্রোতে। সহ্য হচ্ছিল না আমার,ও ড্রেনের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চলে আসতে ফিরে তাকালাম। বাসার গেটে ঢুকবো এমন সময় মিঁয়াও ডাক। মিনমিনিয়ে বল্লাম আমার কিছু করার নাইরে, আমি জীবন দিতে পারিনা।

এখনো বৃষ্টি পড়ছে। কার্নিশ চুইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা নেমে আসছে বাতায়নে। থাই জানালার উপর ফোঁটা জল পড়ে যাবার খেলায় মত্ত। গ্লাস সরিয়ে দিতে নির্মল একগাদা বাতাস মুখের অনেক খানি অতলে চলে গেলো। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। মিঁয়াও শব্দে একগাদা ভারী নিঃশ্বাস জেঁকে ধরল আবার। দরজা খুলে দিতেই পায়ের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগলো। চুলকে দিলাম, কাতর অস্ফুট মৃদু স্বরে মিঁয়াও বলে উঠে দাড়ালো, একবার পশ্চাদপ্রদর্শন পূর্বক সিঁড়ি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো, তারপর আর কোনদিন দেখিনি।

অনেক বছর পরে বর্ষা আবার অবেলায় সুর বেঁধেছে। কলেজ থেকে দৌড়ে সিড়িতে উঠেছি। বিদ্যুৎহীন নিকষ অন্ধকার সিড়িতে অস্পষ্ট স্পর্শ  ঘিরে ধরলো আমায়।মৌন হয়ে রইলাম। অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শুন্য কোলাহল,গাঢ় অন্ধকার, আমার সমস্ত জুড়ে কালো বিড়াল আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টির জল ঝুপ ঝুপ শব্দে ড্রেনের শিকগলে বয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার স্রোতে।