শুভ বড়দিন। খ্রিস্টসমাজের প্রতি শুভেচ্ছা, প্রীতি ও সহমর্মিতা। দরিদ্রের শরণ ও আদি সাম্যবাদী মহাত্মা যিশুর প্রতি জানাই প্রাণান্ত শ্রদ্ধা! মাতার মাতা দুঃখী মরিয়মের সর্বংসহা পুত্রকে গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করি আমরা।
বর্ণনাটি ইবনে ইসহাকের মহানবীর প্রথম বিশদ জীবনী গ্রন্থ সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আছে। আরবভূমি নজরানে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন ফায়মিউন। শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর শখ। পেশায় ছিলেন নির্মাতা। কাদার ইট দিয়ে ঘর তৈরি করতেন। যা উপার্জন করতেন, তাই দিয়ে আহার করতেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, অত্যন্ত উৎসাহী ও তপস্বী। তাঁর প্রার্থনার ফল বা জবাব তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যেত। ফায়মিউন ও তাঁর ছায়াসঙ্গী সালিহ এসে উপনীত হলেন আরব দেশে। একটা কাফেলা তাদেরকে আক্রমণ করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিল নজরানে। নজরানের অধিবাসীরা তখন আরবদের ধর্ম অনুসরণ করত। বিরাট এক খেজুর গাছকে পূজা করত তারা। প্রতিবছর উৎসব হতো। উৎসবের দিন খেজুর গাছে ঝুলত সবচেয়ে সুন্দর মিহি কাপড়। ঝুলিয়ে দেয়া হতো নারীদের অলংকার। তারপর তারা ছুটে বেরিয়ে যেত ওখান থেকে, নিবেদিতপ্রাণ হয়ে সারাদিন গাছের পূজায় মত্ত থাকত।
ফায়মিউন বিক্রি হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁকে যে ঘরে রাখা হতো, সেই ঘরে বসে রাতেরবেলা গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রার্থনা করতেন। কোথাও কোনো বাতি না থাকলেও প্রার্থনা করার সময় পুরো বাড়ি উজ্জ্বল আলোয় ঝলমলে হয়ে যেত। এতে তাঁর মনিব যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী তাঁর ধর্ম?
ফায়মিউন মনিবকে তাঁর খ্রিস্ট ধর্মের কথা বললেন। মনিবকে এও বললেন, তাঁরা সবাই ভুল করছেন। খেজুর গাছ না পারে রক্ষা করতে, না পারে মারতে। তিনি যদি আল্লাহর নামে গাছটাকে অভিসম্পাত করেন, তবে আল্লাহ গাছটিকে নিমিষেই ধ্বংস করে দেবেন। আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই।
তাঁর প্রভু বললেন, তাই করো তবে। যদি তা করতে পারো, আমরা তোমার ধর্ম গ্রহণ করে বর্তমান ধর্ম বর্জন করব। ফায়মিউন পবিত্র হয়ে প্রার্থনা করলেন। যা ভাবলেন তাই হলো। দৈব ঝড়ে গাছটা সমূলে ধ্বংস হলো। তিনি ঈসা ইবনে মরিয়মের ধর্মের অনুশাসন তদের অবহিত করলেন। এরপর নজরানের অধিবাসীরা তাঁর ধর্ম গ্রহণ করল। আরবভূমি নজরানে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পেল। অতঃপর সেই ধর্মের মহিমাটি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। পরবর্তীতে আরও নূতন ধর্মের আবির্ভাব ঘটলেও খ্রিস্টিয়ানিটির বহুল প্রসার এখনও কমেনি। যিশুর জ্বালিয়ে দেয়া আলোকবর্তিকাও নিভছে না, দিন দিন দেদীপ্যমান হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি চর্চিত ধর্ম হলো খ্রিস্টিয়ানিটি। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক হলেন যিশু খ্রিস্ট। ২৫ ডিসেম্বর মহামতি যিশুর জন্মদিন। ক্রিস্টমাস ডে বা বড়দিন পৃথিবীব্যাপী বহুল উদযাপিত উৎসবগুলোর একটি।
বেথলেহেমের নভোমণ্ডলে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব দেখে সুদূর প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী ব্যক্তি মহাপুরুষ যিশু খ্রিস্টের জন্মের বার্তা পেয়েছিলেন। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, এই শিশুই একদিন মানবতার ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হবেন। অতঃপর মহামতি যিশু জন্মগ্রহণ করলেন অত্যন্ত দীনবেশে, একটি গোশালায়। আজীবন দীনবেশেই জীবন যাপন করে তিনি দারিদ্রকেই ধন্য করেছেন।
আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'দারিদ্র্য' কবিতায় সঙ্কোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে দুরন্ত সাহসিকতায় দারুণভাবে মহাত্মা যিশুর উপমা টেনেছেন।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বরাবর উৎসবের আমেজে বড়দিন রাঙিয়েছেন। যিশু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ক্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন। ... লোভে আজ নিদারুণ, দুর্বলের অন্নগ্রাস আজ লুণ্ঠিত, প্রবলের সামনে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টের দোহাই দিয়ে মার বুকে পেতে নিতে সাহস নেই যাদের তারাই আজ পূজাবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুশূলবিদ্ধ সেই কারুণিকের জয়ধ্বনি করছে অভ্যস্ত বচন আবৃত্তি করে। তবে কিসের উৎসব আজ।...আজও তিনি মানুষের ইতিহাসে প্রতিমুহূর্তে ক্রুশে বিদ্ধ হচ্ছেন।'
ইমরে আজিজলার্লি ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে লিখেন, মেরি তথা মরিয়ম একজন অবিবাহিত নারী হিসেবে সন্তান জন্ম দেবার ফলে তাঁকে নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু যিশু - নবজাত শিশু অবস্থা থেকেই ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ হিসেবে কথা বলতে শুরু করেন। এই যাদুকরি ঘটনার পর তাঁর মায়ের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা থেমে যায়। এটি হচ্ছে সংস্কারের ওপর বিজয়ের এক গল্প।
আমাদের ইসলামিজমে যিশুর জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই। কিন্তু মহামতি যিশুকে সম্মান করতে কসুর করি না। আমরা মুসলিমরা যখন যিশুর নাম নিই, তখন 'তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক' বলতে হবে-এমনটাই ধর্মীয় বিধি। আমরা যিশু তথা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ঈসা(আ.)কে গভীরভাবে সম্মান করি। এমনকি নবী মোহাম্মদ(সা.) এর আগে অবতীর্ণদের মধ্যে যিশুকে সবচেয়ে সম্মানিতদের অন্যতম বলে স্থান দেয়া হয়েছে কোরআনে। কোরআনে অসংখ্যবার উল্লিখিত হয়েছে যিশুর (যাকে আরবিতে বলা হয় ঈসা) নাম, নবী মোহাম্মদের নামের চেয়েও বেশিবার। সেইসাথে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে এমন নারী আছেন মাত্র একজন। তিনি আর কেউ নন, কুমারী মেরি। আরবিতে তার নাম মরিয়ম। মেরি বা মরিয়মের নামে কোরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সুরার নামকরণ হয়েছে - যাতে কুমারীর গর্ভ থেকে যিশুর জন্মের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এখানে আছে, মেরি একাই যিশুর জন্ম দিয়েছিলেন মরুভূমিতে, একটি মরা খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে। সেখানে তার খাবার জন্য গাছ থেকে পাকা খেজুর পড়ে, এবং তার পায়ের কাছে পানির ধারার সৃষ্টি হয়।
তবে ইসলামের এই কাহিনিতে বাইবেলে বর্ণিত কোনো জোসেফের উল্লেখ নেই, নেই কোন যিশুর জন্মের বার্তাবাহী জ্ঞানী ব্যক্তি বা পশুর আস্তাবলের কথাও। বৃত্তান্তে সামান্য তফাৎ থাকলেও যিশুর আবির্ভাবীয় দর্শন খ্রিস্টিয়ানিটি ও ইসলামিজমে প্রায় এক ও অভিন্ন।
শেষ বিচারের আগে বিপথগামী মানুষকে পথে ফেরাতে যিশু সত্যের বার্তা নিয়ে আবার পৃথিবীতে আসবেন। এই প্রতীতি দুই ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। কোরানিক বর্ণানুসারে মুসলিম সাহিত্যগুলোতে যিশুর মহিমা গাওয়া হয়েছে বহুবর্ণিল অভিধায়। আমাদের সুফী দার্শনিক আল-গাজ্জালি যিশুকে বর্ণনা করেছেন 'আত্মার নবী' বলে।
তবে কট্টরপন্থীদের ভুবনে তাদের নিজেদের ধ্যানধারণা পুরোদস্তুর আলাদা। বাইবেল অনুসারে, ইহুদিরা নবী মুসাকেই কেবল শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল বিশ্বাস করে, শেষ নবী মুহাম্মদ(সা.) কে মান্যতা দেয় না। নবী ঈসা'র কুমারী গর্ভে জন্ম ও নবীত্বও স্বীকার করে না। আবার বাইবেলের নিউটেস্টামেন্ট অনুসারে, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, ইহুদিরাই ঈসা (আ.) এর খুনী!
অপরদিকে মুসলিমরা বিশ্বাস করে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না। সহজিয়া সুফিইজমে যেখানে যিশুকে 'সন্তুদের নিশানা' বলা হয়েছে। সেখানে বৈরিতা লালনকারী মুসলিমরা বন্ধুত্বই অস্বীকার করছে।
তারপরও যিশু খ্রিস্টের মহিমা এতটুকু কমেনি। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো যার জীবনকে ঐশী আলোকে উদ্ভাসিত করে রেখেছে, তার দ্যুতি কখনোই ম্লান হবার নয়।
যিশু ক্ষমা, পরিত্রাণ, আবেগ, নিদারুণ যন্ত্রণা, অপরিসীম দুঃখভোগ, প্রায়শ্চিত্ত ও ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব এবং সমর্পণের মূর্ত প্রতীক। শিষ্যরা তাঁকে ক্রুশে ক্ষতবিক্ষত করবার পরেও তাই তো তিনি বলতে পারেন, "পিতঃ, ইহাদিগকে ক্ষমা কর; কেননা ইহারা কী করিতেছে তাহা জানে না’’ (লূক ২৩:৩৩-৩৪)।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিশুপ্রশস্তিতে 'মানববপুত্র' কবিতায় যথার্থই বলেন:
মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মূত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন
রবাহূত অনাহূতের জন্যে,
তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর।
আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে।
চেয়ে দেখলেন,
সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে--
যে উদ্ধত শেল ও শল্য, যে চতুর ছোরা ও ছুরি,
যে ক্রূর কুটিল তলোয়ারের আঘাতে--
বিদ্যুদ্বেগে আজ তাদের ফলায় শান দেওয়া হচ্ছে
হিস্হিস্ শব্দে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে
বড়ো বড়ো মসীধূমকেতন কারখানাঘরে।
লেখক: সাংবাদিক
১০ পৌষ ১৪৩১ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
তথ্যসূত্র:
সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) -ইবনে ইসহাক
পবিত্র বাইবেল
যার যা ধর্ম -মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
রবীন্দ্র রচনাবলী -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান -ড. মরিস বুকাইলি
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস
প্রথম আলো