ভোর বেলায় এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো রিশুর।৪:১৫ বাজে। তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে গেল সে।আজ কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগছে। কখনো হাসি পাচ্ছে,কখনো কান্না কিংবা কখনো বিরক্ত লাগছে নিজের উপর। হয়তো আজ তার বিয়ে বলেই এমন হচ্ছে। কথাটা ভেবে আনমনে হেসে উঠলো রিশু।বাসা থেকে বের হওয়ার আগে একবার বাবা মার রুমে উঁকি দিল সে। বাবার ঘুমন্ত চেহারা টা দেখে আবার মন খারাপ হয়ে গেল তার।
নিজেই মনে মনে বললো," আরজু থেকে আমাকে আর কেউ ভালো রাখতে পারবেনা আব্বু।হয়তো আরজুর ব্যাপারে একটু সাহস করে বললে আজ এমন হত না"
রিশু মাথা ঝেড়ে নিজেকে বুঝালো,"যাক গে, এসব ভেবে এখন আর লাভ নেই। পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া।”
দ্রুত ওড়না দিয়ে মুখ পেচিয়ে বাড়ির পাঁচিল টপকে বেরিয়ে আসলো।বাইরে এসে আরজুকে কল দিল রিশু
"হ্যালো আরজু? ”
আরজু ঘুমের মধ্যে উত্তর দিল, " হুমমম?”
"তাড়াতাড়ি পার্কে আয় তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। ”
আরজু ঘুম ঘুম চোখে ফোনের দিকে তাকালো। ৪:৪৫ বাজে। দ্রুত শীতের কাপড় পড়ে সে পার্কে চলে আসলো।
রিশু কে দেখে সে গম্ভীর মুখ করে বললো, "কি হয়েছে? ”
"কালকে বাসায় পাত্রপক্ষ এসেছিল। আব্বু আম্মু খুব পছন্দ হয়েছে।আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আর আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি। ”
"তো তুই এখানে কি করিস? ”
"যখন সকালবেলায় ঘুম ভাঙলো তখন হঠাৎ করে মনে হলো আমার পাগলামি তুই ছাড়া আর কেউ সহ্য করতে পারবে না।”
"রিশু আমি তোকে আরো দুই মাস আগে প্রপোজ করছি। তুই সাথে সাথে না বলে দিসিলি।"
রিশু ভ্রু কুঁচকে বলল,"তো এখন হ্যাঁ বলতেছি। নাকি তুই অন্য কাউকে পছন্দ করস?”
"আরে সেটা না। ”
"তাহলে আমার সাথে পালাতে পারবি?"
"হ্যাঁ। কিন্তু টাকা পয়সা গয়না কিছু আছে?”
"হিসেব করে খরচ করলে এক মাস চলবে এমন টাকা আছে। আর গয়না নাই।”
আরজু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,"কই যাবি কিছু ঠিক করছিস?”
"এমন কোন জায়গায় যেখানে খরচ কম আর আব্বু আম্মু যেন সহজে নাগাল না পায়। ”
আরজু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল," বাইকে উঠ।”
"আরজু। তুই যদি না চাস তাহলে দরকার নাই।”
"না চাইলে ঠান্ডার মধ্যে তোর সারপ্রাইজ দেখতে আসতাম না। ”
৫ বছর পর
পাঁচ বছর আগের সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ছে রিশুর।ঐদিন যদি আরজুর সাথে না আসতো আজকে হয়তো জীবনটাই অন্যরকম হতো। কিন্তু আরজু যেই হাতটা একবার ধরেছে সেটা আর ছাড়ে নি।সেখান থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।ঢাকায় একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া।আরজু নতুন ব্যবসা শুরু করা। ৫ বছরের মাথায় একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট নেওয়া। এমনকি ৩ বছর আগে ওদেরকে রিশুদের পরিবার ও মেনে নেয়।কিন্তু দুবছর আগে রিশুর বাবা-মা ও মারা যায়।এখন পরিবার বলতে একমাত্র আরজুই আছে রিশুর।
কলিংবেলের আওয়াজে রিশুর ভাবনায় ছেদ পড়ে।দরজা খুলে সে আরজুকে ভেতরে ঢুকতে দেয়।
"আরজু তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
"লাস্ট টাইম যে সারপ্রাইজটা পেয়েছিলাম তার জন্য এখনো আমার ভুগতে হচ্ছে।”
"উফ।বি সিরিয়াস।আই এম প্রেগন্যান্ট।”
"ফাইনালি। ইয়েসসস।আমার এত বছরের কষ্ট আজ সার্থক হয়েছে।”
" আব্বু আম্মু আজকে থাকলে কত খুশি হত তাই না? ”
"যেই ছেলেটা তাদের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে তার বাচ্চার জন্য মনে হয় না এত খুশি হত।”
দুইজন হাসতে হাসতে নিজেদের স্বপ্নের দুনিয়ায় হারিয়ে যায়।
৬ মাস পর
আরজু অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছে।রিশু প্রেগনেন্ট জানার পর থেকেই যত্নে যেন কোন ত্রুটি না থাকে সেদিকে খেয়াল রেখেছে সে।কিন্তু প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে ও কেমন যেন দুর্বল হয়ে যায়।অনেক ক্ষুধা লাগতো, কোন কাজ করতে পারতো না,প্রচন্ড ব্যথা হতো। ডক্টর এসব নরমাল বললেও বেবির গ্রোথ নিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল। যে কোন নরমাল বাচ্চা থেকে অনেকখানি দ্রুত বাচ্চাকে বড় হচ্ছিল।তাই নয় মাসের জায়গায় ছয় মাসের সময় ডেলিভারি করতে হয়। একটু আগে ডক্টর আরজুকে জানিয়ে গেছে কেস খুবই ক্রিটিকাল।বাচ্চা কিংবা মায়ের মধ্যে হয়তো যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে।
আজও খুব ভালোভাবে জানে সে বাচ্চার মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে পারবে না। রিশু তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।আর বাচ্চাটা তারই একটি অংশ।রিশুর সাথে ৫ বছর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তের একটি বড় অংশ।তার সারা জীবনের একটা ইচ্ছার প্রতিফলন।
হঠাৎ একটা হাত আরজুর কাধ স্পর্শ করে।আরজুকে নার্স জানায়,"মিরাকেল হয়ে গেছে আরজু সাহেব।মা আর বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে।তাও আমরা বাচ্চাকে ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে চাচ্ছি।”
"আমি কি আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারি? ”
" সে এখন ঘুমাচ্ছে।আপনি চাইলে বাইরে থেকে দেখতে পারেন।”
আরজু নিজ চোখে রিশুকে দেখে নিশ্চিন্ত হল। সে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একজনকে কল করে বলল, "হ্যাঁ সব ঠিকঠাক আছে। ”
পরবর্তী ছয় বছর হেসে খেলে কেটে যায়। আরজু আর রিশু তাদের ছেলের নাম রাখে সৌম্য।সৌম্য বারো মাসের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে কথা বলতেও হাঁটতে পারে।ছয় বছর বয়সে সে বাংলা ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষা শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারে।সে তার বয়সে যে কোনো বাচ্চার থেকে খুবই দ্রুত ও সাবলীলভাবে সব শিখে ফেলে।এজন্য তাকে তার মা স্পেশাল গিফট মনে করে।
কিন্তু আরজু ব্যাপার গুলো খুবই অস্বাভাবিক লাগে। তার ছেলের আচরণে বেশ কিছু অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করে। একবার তার খেলতে গিয়ে তার হাত ভেঙে যায়।ডাক্তাররা বলে এই ক্ষত সারতে অন্তত এক মাস লাগবে। সেখানে এক সপ্তাহের মাথায় সৌম্য পুরোপুরি ভাবে ঠিক হয়ে যায়।
আরজু এসব নিয়ে রিশুর সাথে কথা বলতে চাই কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যেন তাদের সম্পর্কও মরীচিকা পড়ছে। রিশু সারাদিন সৌম্যকে নিয়ে পড়ে থাকে।আরজুর সাথে কথা হয় না আজকাল।
অবশ্য আরজু এসব নিয়ে চিন্তিত না।তার মাথায় অন্য কিছু ঘোরে।তার জীবনের লক্ষ্য।
আরজু অফিস থেকে বাসায় না গিয়ে একটি ছোট খুপরি মতন জায়গায় যায়।সে ঘরে বিছানায় একটা রোগা বৃদ্ধ লোক শুয়েছিল। আজও তাকে কিছু না বলে খাটের এক কোনায় বসে পড়ে।
বৃদ্ধ চোখ খুলে আরজুকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,"তুমি আজ এখানে কেন? ”
"আজকেই সেই দিন। আমার আপনার এত বছরে পরিশ্রম অবশেষে সার্থক হবে।আজ আমি ওদেরকে সবকিছু বলে দেবো। ”
"ওরা কি তোমার কথা মেনে নিবে?”
"অবশ্যই নিতে হবে। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবলেই চলবে না। এর সাথে আরো অনেক মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। ”
" এই কাজের জন্য ৫টা জীবন চলে যাবে।দুজন আরো আগেই মারা গেছে।”
"যে দুইজন মারা গেছে তারা আর যাই হোক নিস্পাপ নয়।বাকি বাকি ৩ জনের মধ্যে তো একজন আমারই তৈরি।আমি আমার জীবনকালের অর্ধেক দেওয়ার জন্য আমি বিন্দুমাত্র আফসোস করি না।কিন্তু শেষ মানুষটার জন্য আমি নিজেকে কখনো মাফ করতে পারব না।”
"তোমার ধারণা নেই তুমি এই গোটা মানবজাতির জন্য জন্য কত বড় ত্যাগ করছো।তোমার এই অভিযানের একটি অংশ হওয়ার জন্য আমি নিজের উপর গর্ববোধ করি। আশা করি তুমি সফল হবে।"
আরজু কিছু না বলেই চুপচাপ বেরিয়ে আসলো। এখনো আসল কাজ বাকি। আরজু বাড়িতে এসে নিজের মনকে সামান্য সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।কিন্তু কিছু বিশেষ লাভ হলো না।
আরজু ঘুমোতে যাওয়ার আগে সৌম্য আর রিশুকে ডাকলো এবং বলল,"তোমাদেরকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।তার আগে তোমাদের কিছু বিষয় জানা দরকার। মানুষকে তার আত্মা কন্ট্রোল করে।কিন্তু যখন মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা অহংকার চলে আসে তখন তাকে অন্ধকার গ্রাস করে। তখন তার আত্মার সে খারাপ অংশ তাকে আর ভালো কাজ করতে দেয় না।খারাপ অংশ থেকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করতে হয় তার উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমি জানতে পারি আত্মা ভক্ষকদের ব্যাপারে। এরা যে কোন জীবিত বা মৃত মানুষের আত্মা ভক্ষণ করতে পারে। কিন্তু এদেরকে আমি কখনোই ব্যবহার করতে পারতাম না। তাই আমি উপজাতিদের সাথে চুক্তি করলাম।এর বিনিময় তাদেরকে ২টি প্রাণ, ১টি দেহ এবং আমার অর্ধেক জীবন কাল দিতে হয়েছে। রিশু তোমার বাবা-মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। তাদেরকে সেই উপজাতি বলি দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমায় রিশু ওনারা ভালো মানুষ ছিল না।তারা অঙ্গপাচার করত। রিশু আমাদের ছেলের সৌম্য কোন সাধারণ মানুষ না।সে একটা আত্মা ভক্ষক। তার দেহর বিনিময় আমরা এই আত্মা ভক্ষককে পেয়েছি।ওর মাধ্যমে আমি পৃথিবীতে খারাপ মানুষদের আত্মার খারাপ অংশটি বিনাশ করতে পারবো। হয়তো আমাদের ছেলেই গোটা মানব জাতিকে এক নতুন সূচনা দেবে। সেখানে না থাকবে অন্যায়, না থাকবে অবিচার।
কথাগুলো একদমে বলে আরজু রিশুর দিকে তাকালো।আরজুর রিশুর কান্না দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। আরজু রিশুর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো।
সে রিশুকে বুঝানোর চেষ্টা করলো,"দেখো আমি বুঝতে পারছি এত কিছু হয়তো সহ্য করতে পারবে না।কিন্তু কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। আমার হাতে সময়ও বেশি নেই প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আর তুমি আমার প্রমিস কর যে তুমি আর মন খারাপ করবা না।”
রিশু কোনরকমে বলল, " অরজু তোমার জন্য একটা স্পেশাল সারপ্রাইজ আছে।”
অরজু কিছু বলার আগেই পিঠের পিছনে তীব্র ব্যথা অনুভব করে।সেখানে হাত দিয়ে এসে দেখতে পায় রক্ত বের হচ্ছে। পিছনে ফিরতেই সে দেখে সৌম্য তার পিঠের ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে।অরজু অবাক চোখে সৌম্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সৌম্য রিশুর পাশে এসে বলল,"জানিস তোর সবচেয়ে বড় ভুল কোনটা?এমন উপজাতির সাথে চুক্তি করা যারা কিনা শয়তানের উপাসনা করে। আরে যারা নিজেই মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে,তারা মানুষের ভালোর জন্য কেন কিছু করবে?”
সৌম্যের কথায় রিশু অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে।
আরজু হতাশ গলায় বলে," তু-তু-তুমি-তুমি আমার রিশু না।”
রিশু আরজুর দিকে তাকিয়ে বলে,"না। তোর বউ তো ডেলিভারির সময় মারা গেল। আত্মা ভক্ষকদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কি জানিস। এরা সহজে দেহ পায় না। কিন্তু একবার দেহ পেয়ে গেলে সেখানে একজন থেকে দুজন হতে পারে। মানে ডেলিভারির সময় আমি তোর বউয়ের আত্মা খেয়ে ফেলেছিলাম। তার দেহটি আমি নিয়েছি।”
আরজু মারা যাওয়ার পরে রিশু আর সৌম্য তার দেহটাকে পুড়িয়ে ফেলে।গ্যাস লিকেজের বাহানায় পুরো বাড়ি জালিয়ে দূরে কোথায় চলে যায়।পৃথিবীর কাছে এখন অরজু, রিশু আর সৌম্য মৃত।