শহরের কোলাহল ছাপিয়ে ছোট্ট একটি লাইব্রেরি। জায়গাটা তুলনামূলক নিরিবিলি, বইপ্রেমীদের জন্য এক প্রিয় আশ্রয়স্থল। এখানে প্রতিদিন আসে আরমান। তার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। আরমানের শখ বই পড়া, গল্প লেখা, আর মাঝে মাঝে ছবি আঁকা। লাইব্রেরির জানালার পাশে নির্দিষ্ট একটি টেবিলে বসে বই পড়া তার রুটিন।
একদিন হঠাৎই তার পাশের টেবিলে এসে বসল একটি মেয়ে। মেয়েটির পরনে সাদা শাড়ি, চুল খোলা। হাতে ধরা একটি বই, কিন্তু চোখ বইয়ের পাতায় নয়। বরং জানালার বাইরে দূরে কোথাও।
আরমান মনে মনে একটু অবাক হলো। মেয়েটির চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা। যেন হারিয়ে গেছে কোনো গভীর স্মৃতির ভেতর।
আরমানের মন কৌতূহলে ভরে উঠল। কিন্তু সাহস করে কিছু বলল না। মেয়েটির নাম জানা হলো না সেদিন।
পরিচয়ের শুরু
পরের দিনও মেয়েটি ঠিক একই জায়গায় এসে বসে। এবার আরমান সাহস করে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অবশেষে লাইব্রেরিয়ান সাহায্য করলেন। মেয়েটি লাইব্রেরিতে একটি বই ফেরত দিতে এসেছিল। বইটির নাম ছিল “শেষের কবিতা”।
আরমান এগিয়ে গিয়ে বলল,
“শেষের কবিতা আপনার খুব প্রিয় বই মনে হচ্ছে। বারবার পড়েন?”
মেয়েটি তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “প্রিয় বইয়ের তো কোনো শেষ নেই। বারবার পড়লেও মনে হয়, নতুন কিছু শিখছি।”
আরমান হেসে বলল, “আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি। তবে আমি ভাবছিলাম, এই লাইব্রেরিতে আসেন কেন? এত বই থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন?”
মেয়েটি একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমার নাম আভা। বই পড়তে ভালোবাসি। তবে জানালার বাইরেও এক অন্যরকম পৃথিবী দেখি। আমি মাঝে মাঝে সেখানেই হারিয়ে যাই।”
বন্ধুত্বের গড়ন
এরপর থেকে তাদের কথাবার্তা বাড়তে থাকে। আরমান আর আভা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে দেখা করে। বই, জীবন, প্রকৃতি—তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে।
একদিন আরমান জিজ্ঞেস করল,
“আভা, তুমি কি সবসময় এমন চুপচাপ?”
আভা হেসে বলল, “সবসময় নয়। তবে আমার মনে হয়, চুপ থাকার মধ্যেও একটা ভাষা আছে। তুমি কি কখনো সেটাকে শুনেছ?”
আরমান মুগ্ধ হলো। আভার চোখে সে এক গভীর রহস্য দেখতে পায়।
প্রেমের সূচনা
একদিন আরমান আভাকে প্রস্তাব দেয়,
“চলো, আজ লাইব্রেরির বাইরে কোথাও যাই। শহরের একঘেয়েমি ভেঙে ফেলা দরকার। আমরা একটু নদীর ধারে বসতে পারি।”
আভা প্রথমে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু আরমানের অনুরোধে সে রাজি হলো।
নদীর পাড়ে বসে তারা অনেকক্ষণ গল্প করল। সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় আকাশ রঙিন হয়ে ওঠে। আভা হঠাৎ বলে উঠল,
“আরমান, তুমি জানো? এই আকাশের দিকে তাকালে আমার মনে হয়, আমি উড়তে পারি। কিন্তু আমার ডানাগুলো হয়তো হারিয়ে গেছে।”
আরমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু তোমার কথাগুলো মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। আমি মনে করি, তোমার ডানাগুলো এখনো আছে। শুধু তুমি নিজেই সেগুলো দেখতে পাচ্ছ না।”
আভা একটু মুচকি হেসে বলল, “তাহলে কি তুমি আমার ডানাগুলো খুঁজে দেবে?”
এই কথার মধ্যেই যেন তাদের সম্পর্কের সূচনা হলো।
সম্পর্কের গভীরতা
আরমান আর আভার দেখা-সাক্ষাত বাড়তে থাকে। তারা একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরে, গল্প করে। আভা ধীরে ধীরে তার জীবনের গল্প খুলে বলে।
“আমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। তখন আমি মাত্র ষোলো। সেই থেকে আমি একা। কিছুটা সময় আত্মীয়দের কাছে থেকেছি, তারপর নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছি।”
আরমান আভার কথা শুনে অবাক হয়। সে ভাবতে থাকে, কীভাবে একজন মানুষ এত কষ্ট পেরিয়ে এমন হাসি ধরে রাখতে পারে।
আরমান বলে,
“তুমি কি জানো, তোমার জীবন আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে? তোমার মতো সাহসী মানুষ খুব কম দেখা যায়।”
আভা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদুস্বরে বলে,
“তোমার কথাগুলো খুব আপন লাগে। আমার জীবনে কেউ এভাবে কথা বলেনি আগে।”
ভালোবাসার ঘোষণা
এক সন্ধ্যায় আরমান আভাকে একটি নির্জন পার্কে নিয়ে যায়। সেখানে এক পুরোনো বটগাছের নিচে বসে তারা। আরমান বলে,
“আভা, আমি অনেক দিন ধরে কিছু বলতে চাইছি। তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমার জীবনের সঙ্গী হবে?”
আভা কিছুক্ষণ কিছু বলে না। তার চোখে জল জমে আসে। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বলে,
“তুমি কি জানো, আমি কখনো ভাবিনি, কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসবে। কিন্তু তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো এটাই আমার নতুন জীবন শুরুর সময়। আমি তোমার হাত ধরে বাঁচতে চাই, আরমান।”
আরমান খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা পরস্পরের হাত ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গল্পের পরিণতি
আরমান আর আভার ভালোবাসা ধীরে ধীরে গভীর হয়। তারা একসঙ্গে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করে।
তারা বুঝতে পারে, ভালোবাসা শুধু রোমান্টিক আকর্ষণ নয়, বরং একজন আরেকজনের জীবনের শূন্যতা পূরণ করা।
তাদের জীবন হয়ে ওঠে এক নতুন গল্পের বই। যেখানে প্রতিটি পাতায় লেখা থাকে ভালোবাসা, বিশ্বাস, আর একসঙ্গে বাঁচার ইচ্ছা।
শেষ।