Posts

গল্প

আত্মগ্লাণি

December 26, 2024

Tanjina Tabassum

103
View

হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটচ্ছে একদল তরুণ। সমুদ্রসৈকত একরকম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলা চলে। তবে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে অদূরে একনিবিষ্ট মনে সমুদ্রের জলরাশির পানে চেয়ে আছে বছর আঠারোর এক তরুণ। তার মুখের অবয়বে ক্ষোভ আর বেদনার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নাম আদনান শেখ। “শেখ” উপাধিটা ওকে তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। বছর দশেক আগে ওর দূরন্ত জীবনে এক অকস্মাৎ ঝড় এসে শান্ত করে দেয়। বাবা ফয়সাল শেখ, মা আকলিমা আক্তার আর ছোট বোন ফাবিহা শেখ কে নিয়ে একটা সুন্দর পরিবার ছিলো আদনান এর। তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা শেষে ডিসেম্বর এর এক কুয়াশাচ্ছন্ সকালে বাবার কাছে বেড়াতে যাওয়ার বায়না করেছিলো ছোট্ট আদনান। ছোট্ট ফাবিহা ও তাতে সায় দেয়। বেশ রাগী মানুষ ছিলেন ফয়সাল শেখ। বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব সরাসরি বাবাকে না দিতে পেরে মা আকলিমার মাধ্যমে জানায়। প্রথমে না করলেও কী ভেবে যেন রাজি হন ফয়সাল। সারারাত মা ছেলে মিলে পরিকল্পনা করে তৈরী হতে থাকে। এটাই তাদের প্রথম দূরের ভ্রমণ। চার সদস্যের এই ছোটো পরিবার টি বেশ প্রফুল্ল মনে রওনা দেয়। কয়েকঘন্টা পর তারা পৌছায় গন্তব্যস্থলে। ছোট্ট ফাবিহা কয়েকমিনিট বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আর বোঝার চেষ্টা করে সমুদ্রের বিশালতা। নিজের ক্যামেরা হাতে আট বছর বয়সী আদনান তার বাবার দিকে তাকায়। তার গম্ভীর বাবাকে কেমন খুশি খুশি লাগছে। তার মা বাবা পেছনে তার একটু সামনে আদনান আর ফাবিহা। বাবার নিষেধ সত্বেও দু ভাই বোন সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে পা ভেজায়। বেশ কিছুক্ষন ভালোই সময় কাটে। কিছুক্ষণ পর ফাবিহা দৌঁড়ে মায়ের কাছে যায়। ফয়সাল শেখ বারবার আদনান কে হাত দিয়ে ইশারা করেন বেশি পানিতে না নামতে। কিন্তু কী এক অদ্ভুত টানে আদনানের পানি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হয় না। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসে। রক্তিম সূর্যাস্তে  যেন পরিবেশ কে আরো মনোরোম করে তোলে। বেখেয়ালে পানির বেশ গভীরে চলে যায় আদনান। স্রোতে র তালে মেলাতে না পেরে চিৎকার করে ডাকে বাবা কে। ফয়সাল শেখ বিস্ফোরিত নয়নে দৌড়াতে থাকেন। পানিতে নেমে কোলে নিয়ে আদরের ছেলেকে কোনোমতে স্ত্রী আকলিমার হাতে তুলে দিতে পারলেও নিজে বেশ গভীরেই চলে যান স্রোতের এক টানে। চোরাবালি টেনে নিয়ে যায় তাকে। শত চেষ্টায় ও সবাই মিলে ফয়সাল শেখ কে আটকে রাখতে পারেননি। আকলিমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়। আর আদনান শেষবার চোখ মেলে যেন দেখলো টকটকে রক্তিম জলরাশি তার বাবাকে চুষে নিচ্ছে। তার পর সে আর কিছুই মনে করতে পারে না। সেই দিন এর পর দশ বছর কেটে গিয়েছে। এখন আরেক ডিসেম্বর। আদনান যেন শব্দহীন মানব। কী এক অদ্ভুত আত্মগ্লাণি তাকে চিবিয়ে খায়। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার দেখতে হয় তাকে। আকলিমা আর কথা বলেন না। সুস্থ তবে চুপ। কেবল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকেন। ফাবিহা বড়ো হয়েছে। আদনান মায়ের দিকে তাকাত পার  না। সারাদিন কলেজ তার পর কাজ শেষে বাসায় ফেরে রাত আট টায়। মা তাকে খাবার দেয় তবে কথা বলে না। ডাক্তার ও বলেন ট্রমায় এমন হয়েছে। তবে আদনান ভাবে তার মায়ের তার প্রতি ক্ষোভ। নিজের কক্ষে বাবার একটি হাসিমাখা ছবি টানানো। আজ বাবার এগারোতম মৃত্যু দিন। কলেজ ট্যুরে আসতে চায় নি। বাড়তি খরচ। তবে তারিখ আর স্পট টা মিলে যাওয়ায় আবারো এই সমুদ্র কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে সত্যিই এই জলরাশি কেন টেনে নিলো প্রিয় বাবাকে। এই আত্মগ্লাণির শেষ কোথায়!!!

Comments

    Please login to post comment. Login