Posts

প্রবন্ধ

শাসনের রথবদলের মনস্তত্ত্ব

December 26, 2024

Ajmain Rashid Enan

32
View

একাত্তরের যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তা বরাবরই ছিল অরক্ষিত। কোন বিশেষ দল মত একে অরক্ষিত করে নি। যে সকল দল মতের মাধ্যমে এ অরক্ষিত ব্যবস্থার জন্ম হয় তার প্রত্যেকটিই স্বাধীনতা পরবর্তী থেকে আজ অবধি বিরাজমান। এ সকল দল মতের কোনটিই তাদের  অরক্ষিত ব্যবস্থা সৃষ্টির পিছনে তাদের  অবদানের কথা স্বীকার করতে চায় নি। একাত্তরের স্বাধীনতার জন্ম ও সমাপ্তিকাল ছিল একই, সেই একাত্তরের ষোল ডিসেম্বরের পর থেকেই অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা, যাকে পুনরুদ্ধার করতে চায় নি  কোন নেতৃবৃন্দই।  

স্বাধীনতা হলো একটি জাতির ফুলের বাগানের জন্ম আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হলো সেই বাগানের পচেঁ যাওয়া এক বৃক্ষের এবং সেই বাগানের পরিচালনাকারী এক ধ্বংসাত্মক মালির পতন।

অরক্ষিত স্বাধীনতার মধ্যেই  লুকিয়ে থাকে স্বাধীনতার বীজ, আবার স্বাধীনতার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে পরাধীনতার সম্ভবনার বীজ। স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাইলে স্বাধীনতা কিভাবে আমাদের হলো? শামসুর রহমানের এই কথাটাকে প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করা দরকার। একটি দেশ অসংখ্য মানুষের সমষ্টি।  তাই যারা দেশ বলতে কেবল ভুখন্ডকে বোঝে,  অপর দেশের মাধ্যমে সে ভূখন্ডকে যদি  নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিংবা মানুষকে বস্তুুগত বলে কল্পনা করে নিজেদের মতামতকে জোর পূর্বক প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে তা হবে বিজয়ের অরক্ষিত অবস্থার সূচনা।

যে আওয়ামী লীগ একাত্তরে ত্রাণ শিবিরে নিরাপত্তার নামে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করে,  ত্রাণ শিবিরের জন্য বরাদ্দ টাকায় আওয়ামী নেতাদের বিলাশবহুল জীবন ব্যবস্থা ভারতের মাটিতে গড়ে উঠে যখনও কি না স্বাধীনতা  অর্জিত হয় নি। যে জাতীয়তাবাদী দল  মুক্তিযোদ্ধাদের ও বীরাঙ্গনাদের পুনবাসন বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং  আওয়ামী লীগ ও জাতীয়তাবাদী দল স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নিজেদের রাজনৈতিক দখদারিত্বের  লক্ষ্যে যুদ্ধের সৈনিকদেরই হত্যা করে। আরেকটি দল  যাদের বক্তব্য তারা তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ও ধর্মীয় আবেগ দেখিয়ে দখলদারিত্ব, ধর্ষণ ও লুঠপাঠের সর্মথনে তাদের একটি আবেগী গোষ্ঠী সৃষ্টির প্রয়াস পায়। অথচ জনগণের সমষ্টি যে একটি দেশ সে কথা তারা ভুলে গেল এবং ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করলো সাধারণ জনতাকে। তাই তারা লুটতরাজ, ধর্ষণের মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান ও ধর্মীয় ব্যবস্থা প্রণয়নের অযুহাতকে দাঁড় করালেন। যখন স্বাধীনতা পরবর্তী আটত্রিশ বছর পর আওয়ামী শাসনের যুগের সূচনা হলো তখন  আওয়ামী শাসনের  সমর্থনে যতটা নয় বরং তার চেয়ে অনেকবেশি তাদের পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে মতাদর্শনের চর্চা ও মতাদর্শকে কর স্বরুপ আরোপের চেষ্টা  এবং স্বাধীন চিন্তা ও সংস্কৃতির একটি অংশের অপর আঘাত ও তাকে নিজস্ব ধারায় পরিচালনার চেষ্টা ও সামগ্রিক দিকের থেকে নজর সরিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিকে জনগণের আকর্ষণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা  ( যা পরবর্তীতে আওয়ামী শাসনেও চর্চা করা হয়) সেগুলোই তৎকালীন আওয়ামী শাসনের পথ সুগমে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী শাসনেও একটি নিদিষ্ট দিকে জনগণের চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা  ও  সংস্কৃতিকে নিজ ধারায় পরিচালনার চেষ্টায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরিবেশ তৈরি হয়। এবং পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়েও চক্রাকারে একই গঠনের বীজ ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে শুরু করে। যা পরবর্তী আবারো বর্তমানের বিরোধী দলগুলোকে শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রভাবক হতে পারে। যে লাশের,  দমনের ও সেন্টিমেন্টের রাজনীতি একাত্তরের পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে তৎকালীন সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের যারা রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তাদের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে নি যার ফলশ্রুতিতে যখন যুদ্ধ পরবর্তী বীরাঙ্গনাদের পুনবাসনের স্থায়ী সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন সেদিন বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ তাদের পুনবাসনের ব্যায় বহনের চাইতে পতিতাবৃত্তিতে তাদের বৈধ আয় ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারী অনুমোদিত পতিতালয়ের অনুমোদন করা হয়,  বর্তমানে অনুমোদিত ব্যতীত কেবল অনুমোদিত পতিতালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় চৌদ্দটিতে। অথচ তার মূলৎপাটন নিয়ে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চাওয়া দলসমূহ কিংবা মানবাধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলা বাম সংগঠনসমূহের কোন আগ্রহ দেখা যায় নি আজ অবধি। একাত্তরের সেদিনই নারীর ভূমিকা তুলে ধরতে বেশিরভাগ গোষ্ঠীই ছিল উদাসীন। যার ফলশ্রুতিতে কেবল নারীরা নিজেরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদাই যে পায় নি তা নয় তার সাথে তাদের সাথে জড়িত এক বিশাল পুরুষ জনগোষ্ঠীর ভূমিকাও সকলের অধরায় থেকে যায়। শাসকগোষ্ঠী ও এ দেশের আপামর জনতা কোনদিন ইতিহাস কিভাবে আলোকপাত হয় তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারা পায় নি ফলে তারা বরাবরই এটা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে ইতিহাস কেবল নারী কিংবা পুরুষ নিয়ে রচিত হতে পারে না, একটি যুগের সাক্ষী সে যুগের সকল নারী পুরুষ বৃদ্ধ ও শিশুর প্রত্যেকের একান্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়ে থাকে, নারীর সাথে নিপীড়িত হয় তার পুরুষ সন্তান, স্বামী, ভাই ও বাবা,সহজেই সম্ভব হয় নারীকে হীনতা প্রমাণ করে তার পুরুষ সহযাত্রীদের কোণঠাসা করে শাসকগোষ্ঠীর উপরে উঠা । চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও নারীদের আড়াল ও বিতর্কিতভাবে তাদের উপস্থাপনের চেষ্টা করে নারী ও তার সাথে সম্পর্কিত পুরুষদের আড়ালের এক কৌশল গ্রহণ করা হয়। অতীতকে তুচ্ছ করে কখনো সামনে এগোনো যায় না। অতীতের মধ্যে বর্তমানের বীজ, বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যতের বীজ যেমন লুকিয়ে থাকে তেমনি বিপরীত ক্রমেও তা ঘটে থাকে।

Comments

    Please login to post comment. Login