গল্পের শুরুটা ছিলো খুবই সাধারণ, কিন্তু শেষটা কেমন যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো। এক শহরের অলি-গলিতে একমাত্র চায়ের দোকানটি ছিলো চিরকালিক দৃশ্যের মতো। দোকানের এক কোণে বসে থাকতো অল্প কিছু মানুষ, কিছু ছাত্র, কিছু কাজের মানুষ আর মাঝে মাঝে কেউ আসে, হয়তো ভাবতে ভাবতে, সময় কাটাতে। তবে, মাধবী আর রাহুলের সম্পর্ক একেবারে অন্য ধরনের ছিলো।
মাধবী ছিলো এক শান্ত, সোজা পথের মেয়ে। লেখাপড়া ছিলো তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, তার জীবনের কোনো চাহিদা ছিলো না। কিন্তু তার জীবনে একটাই ইচ্ছা ছিলো—প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেতে চাওয়া। মাধবীর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা, আর মা একজন স্কুল শিক্ষিকা। পরিবারের মধ্যে সে ছিলো সবার আদরের। কিন্তু মাধবীর জীবন ছিলো একটু একঘেয়ে। তার দিন গুলো গড়ে উঠতো বইয়ের পাতায় আর লেখালেখিতে।
রাহুল ছিলো সেই ছোট্ট শহরের একটি কলেজে পড়ুয়া ছেলে। তার জীবনে কোনো গন্তব্য ছিলো না, তবে যেটি ছিলো, সেটা ছিলো মাধবী। সে মাধবীকে একদিন প্রথম দেখেছিলো চায়ের দোকানে। মাধবী বসে ছিলো এক কোণে, একটি বই হাতে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বাইরে। রাহুলের কাছে তার চেহারা, তার মৃদু হাসি, তার চোখের মিষ্টি চাহনি—সবই যেন একটি মধুর সুর। রাহুলের জীবনেও কোনো বড় উদ্দেশ্য ছিলো না, কিন্তু মাধবী তাকে এক নতুন দিক দেখিয়েছিলো।
রাহুল মাঝে মাঝে দোকানে এসে মাধবীর পাশে বসতো। প্রথমে কথা বলতো না, শুধু নিরবে তাকে দেখত। একদিন, তার সাহস হলো, মাধবীকে কথা বলার জন্য ডাকলো। মাধবী তার বইয়ের পাতা থেকে মাথা তুলে তাকালো। রাহুল হাসতে হাসতে বললো, "আপনি তো এখানেই সবসময় বসে থাকেন, কোনোদিন গল্প করবেন না?" মাধবী হেসে বললো, "গল্প করতে কি আমার এত সময় আছে?" কিন্তু রাহুলের চোখে এক অন্য ধরনের আবেদন ছিলো। সে আর কিছু বললো না, চুপচাপ বসে থাকলো।
এরপর বেশ কিছুদিন, তারা একে অপরের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতো। মাধবী কখনো বই নিয়ে কথা বলতো, কখনো তার ছোট ছোট গোপনীয়তা শেয়ার করতো। রাহুল তার জীবনের শূন্যতার কথা বলতো, যে সে সবসময় কিছু খুঁজে বেড়ায়। সময়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের তীব্রতা বাড়তে থাকে। তাদের মাঝে এক ধরনের নীরব বোঝাপড়া ছিলো, যেন তাদের দৃষ্টিতে আর কোনো শব্দ প্রয়োজন ছিলো না।
একদিন বিকেলে, চায়ের দোকানের কোণে বসে মাধবী বললো, "রাহুল, তুমি জানো, আমি কখনো কাউকে বলিনি, কিন্তু আমার জীবনে এক অদ্ভুত ধরনের শূন্যতা আছে। অনেক কিছু পেয়ে গেলেও মনে হয় কিছু নেই।" রাহুল তার দিকে তাকিয়ে, গভীরভাবে বললো, "মাধবী, তোমার শূন্যতা কোথাও না কোথাও পূর্ণ হবে। হয়তো আমি তোমার ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়াতে পারবো।"
মাধবী মৃদু হেসে বললো, "তুমি কি মনে করো, একজন মানুষের জীবনে ছায়া থাকতে পারে?" রাহুল বললো, "হ্যাঁ, ছায়া ঠিকই থাকে। কখনো কখনো তা এতটাই গভীর হয়ে যায়, যে তুমি নিজেই বুঝতে পারো না, ছায়াটা তোমার থেকে আলাদা হয়ে গেছে।"
মাধবী কিছুটা কাঁপানো মন নিয়ে বললো, "তাহলে, তুমি কি আমাকে ছায়ার মতো ভালোবাসবে?" রাহুল এক পলক মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি তোমার ছায়া হবো, মাধবী, যতদিন তুমি আমাকে ছায়া হিসেবে গ্রহণ করবে।"
তারপর থেকে, তাদের সম্পর্ক যেনো এক নতুন রূপ নেয়। মাধবী যখন হতাশ হয়ে পড়তো, রাহুল তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, ঠিক যেনো একটি ছায়া। আর রাহুল, যেদিন নিজের পথ হারিয়ে ফেলতো, মাধবী তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে আবার নিজের পথ খুঁজে দিতে চেষ্টা করতো। তাদের সম্পর্কটি ছায়া ও আলো হয়ে মিশে যেতো, কখনো সুখ, কখনো দুঃখ, কিন্তু সবসময় একে অপরের পাশে।
কিন্তু, সম্পর্কের মাঝে একদিন এক অজানা অস্বস্তি দেখা দিলো। মাধবী তার জীবনের একটা গন্তব্য খুঁজছিলো, কিন্তু রাহুল ছিলো যেনো স্থির। মাধবী অনুভব করলো, রাহুল তার ছায়া হতে চাইলেও, সে নিজে তো আর এগোতে পারবে না। একদিন, রাহুলকে বললো, "রাহুল, তুমি আমার ছায়া হতে চেয়েছিলে, কিন্তু তুমি তো জানো, ছায়া কখনো সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।"
রাহুল চুপ হয়ে গেলো। সে জানতো, তার জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র মাধবী নয়, কিন্তু মাধবী তাকে কিছুটা আটকে রেখেছিলো। সে বুঝতে পারছিলো, তাদের সম্পর্ক এখনো এক জায়গায় থেমে আছে, আর এটি যদি ছায়া হয়ে থাকে, তবে মাধবী কখনো আলো হতে পারবে না।
মাধবী একদিন রাহুলের হাত ছেড়ে দিলো, কিন্তু রাহুল কোনো কথা বললো না। সে জানতো, তাদের সম্পর্কটি ছায়ার মতোই, কখনো কিছু বলার প্রয়োজন ছিলো না। তাদের সম্পর্কের ভাষা ছিলো চোখের দৃষ্টি, হৃদয়ের স্পন্দন।
বছরের পর বছর কেটে গেলো, আর একদিন, এক পুরনো চায়ের দোকানে, তাদের দেখা হলো আবার। মাধবী হাসলো, "রাহুল, তুমি আজও এখানে এসো?" রাহুল হাসলো, "হ্যাঁ, আমার ছায়া এখানে আছে।"
মাধবী তাকিয়ে রইলো, এক দৃঢ় প্রত্যয়ে বুঝতে পারলো—তাদের সম্পর্ক ছায়ার মতোই ছিলো, কিন্তু এটাই ছিলো এক অমোঘ সম্পর্ক, যা কখনো শেষ হয়নি, কখনো একে অপরকে ছেড়ে যায়নি।
সমাপ্ত।