এক নির্জন বিকেলে অর্ক তার পুরোনো বাড়ির ভাঙা বারান্দায় বসে ছিল। হাতে ছিল একটা পুরোনো হারমোনিয়াম, আর চোখে ছিল স্মৃতির ঘোর। অর্ক একটি নামকরা স্থপতি হলেও, জীবনের একধরনের শূন্যতা তাকে গ্রাস করেছিল। সে যখনই বাড়ি ফিরতো, তার মায়ের গাওয়া পুরোনো গানগুলোর সুর যেন তার হৃদয়কে আন্দোলিত করতো। আজও বারান্দায় বসে সে তার শৈশবের সেই দিনের কথা ভাবছিল।
অর্কের মা, মাধবী, ছিলেন একসময়কার খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী। তবে সংসারের দুঃখ-কষ্টে তিনি গানের জগৎ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার জীবন আবর্তিত হতো অর্ক আর তার বাবাকে ঘিরে। মাধবীর প্রতিটি গান যেন একটি গল্প বলতো—স্নেহ, ত্যাগ, আর ভালোবাসার গল্প। অর্ক শৈশবে তার মায়ের গান শুনে যে প্রশান্তি পেতো, তা তার জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি।
অর্ক বড় হয়ে শহরে পাড়ি জমায়। ক্যারিয়ারের তাড়নায় সংসারের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। মায়ের গলা থেকে সুরের মায়া কবে দূরে সরে গেছে, সে নিজেই টের পায়নি। জীবনের ব্যস্ততায় মায়ের প্রতি তার সময় ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই শূন্যতা সে অনুভব করতে শুরু করেছিল, যখন মাধবী চিরতরে নিঃশব্দ হয়ে গেলেন।
মায়ের মৃত্যুর পর অর্ক একদিন গ্রামের বাড়ি ফিরে আসে। ঘরের কোণে একটি পুরোনো বাক্সে তার মায়ের হারমোনিয়ামটি খুঁজে পায়। তার সঙ্গে ছিল একটি ডায়েরি, যেখানে মাধবী প্রতিদিনের অনুভূতি লিখতেন। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা ছিল:
"আমার গান একদিন অর্কের জীবনে সুর হয়ে ফিরে আসবে।"
অর্কের বুক কেঁপে ওঠে। ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে তার মায়ের জীবনের না বলা কথাগুলো পড়তে থাকে। সেখানে মাধবী তার ত্যাগ, স্বপ্ন, আর ছেলের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা লিখেছিলেন।
মায়ের স্মৃতি তাকে যেন একধরনের দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ করে ফেলে। সে অনুভব করে, মায়ের গানের সুরই ছিল তার জীবনের আসল সম্পদ। কিন্তু এতদিন সে সেই সুরকে অবহেলা করেছে।
একদিন, অর্কের কলেজের সহপাঠী নীলা হঠাৎ তার জীবনে ফিরে আসে। নীলা তার মায়ের শিষ্যা ছিল। মাধবীর কাছ থেকে সংগীতের পাঠ নিতে নিতে সে অর্কের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। সময়ের আবর্তে তাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। নীলা এখন একজন সংগীতশিল্পী, মাধবীর গানের সুরকে জীবিত রাখার জন্য কাজ করছে।
নীলা অর্কের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মা শুধু আমার শিক্ষিকা ছিলেন না; তিনি আমাকে জীবনের সুর শিখিয়েছেন। জানো, তিনি বলতেন, গান কেবল সুর নয়, এটা ভালোবাসার এক ভাষা।"
অর্ক নীলার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বললো, “নীলা, আমি মায়ের সেই ভাষা বুঝতে পারিনি। আমি নিজেকে এত ব্যস্ত রেখেছি যে মায়ের জীবনের সুর হারিয়ে ফেলেছি।”
নীলা মুচকি হেসে বললো, “তোমার মা চাইতেন তুমি জীবনের সুর খুঁজে পাও। এখনো দেরি হয়নি। তোমার মায়ের গানকে জীবন্ত করো।"
এরপর অর্ক আর নীলা মিলে মাধবীর রেখে যাওয়া সুরগুলো পুনরায় জীবিত করার কাজ শুরু করে। অর্ক তার মায়ের ডায়েরি থেকে সুরের টুকরো টুকরো অংশ খুঁজে বের করে, আর নীলা সেগুলোকে সংগীতে রূপ দেয়।
একদিন, তারা সিদ্ধান্ত নেয় মাধবীর স্মৃতিতে একটি সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করবে। অর্ক প্রথমবারের মতো মায়ের হারমোনিয়ামে হাত রাখে। তার আঙুল যখন হারমোনিয়ামের কীবোর্ডে ছুঁয়ে যায়, তার মনের মধ্যে মায়ের গাওয়া সেই সুরগুলো বেজে ওঠে।
অনুষ্ঠানের দিন, নীলা একটি গান গায়, যা মাধবী তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন। গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর যেন অর্কের মাকে জীবন্ত করে তোলে। দর্শকদের মধ্যে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না।
অর্ক মঞ্চে উঠে বললো, “আজ আমি বুঝেছি, সুর শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি সম্পর্ক। এটি ভালোবাসার ছায়া, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে। আমার মা চেয়েছিলেন, তার সুর একদিন আমার জীবনের অংশ হবে। আজ আমি অনুভব করছি, তিনি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সুর হয়ে আছেন।”
এরপর থেকে অর্ক মাধবীর গানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। তার হারমোনিয়ামের সুর কেবল তার মাকে নয়, বরং তার নিজের হারানো সম্পর্কগুলোকে পুনরুদ্ধার করে। নীলা, অর্কের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
গল্পটি শেষ হয় একটি স্মরণীয় কথায়:
"সুর শুধু সংগীত নয়; এটি ভালোবাসার সেতু, যা ছায়ার মতো নীরবে আমাদের জীবনকে রাঙিয়ে তোলে।"
সমাপ্ত।