Posts

গল্প

দূরত্বের বাঁধন

December 26, 2024

Md. Alamgir Hossain

106
View

শান্ত শহরের একটি ছোট্ট বাড়িতে দোলার শৈশব কেটেছিল। বাড়ির বারান্দায় বসে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। তার বাবা, রতন মল্লিক, একজন কঠোর কিন্তু দায়িত্বশীল মানুষ। মা মীনা ছিলেন পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু, যিনি সবাইকে হাসিমুখে আগলে রাখতেন। কিন্তু দোলার জীবন পুরোপুরি বদলে যায় যখন তার বাবা পরিবার নিয়ে এক শহরে পাড়ি জমান।

শহরের ব্যস্ততা, নতুন পরিবেশ আর সম্পর্কের পরিবর্তন দোলার মনকে কিছুটা ভারাক্রান্ত করে তোলে। তার মায়ের হাসি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে থাকে। বাবার কাজের ব্যস্ততায় পারিবারিক সময় বলতে কিছু আর থাকেনি। ছোট্ট দোলা সেই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তার মনের গভীরে এক শূন্যতা রয়ে যায়, যা কেউ পূরণ করতে পারতো না।

একদিন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর, দোলার জীবনে এলো নিলয়। নিলয় ছিল গ্রামের ছেলে। দোলার মতোই শহরের পরিবেশে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল কলেজের লাইব্রেরিতে। নিলয় একটা বই হাতে বসে ছিল, আর দোলা পাশের চেয়ারে বসে পড়ছিল। নিলয়ের চোখে ছিল একধরনের গভীরতা, যা দোলার মনে দাগ কেটে যায়।

দিনের পর দিন তাদের বন্ধুত্ব গভীর হতে থাকে। দোলা আর নিলয় একসঙ্গে ক্লাস করতো, পার্কে হাঁটতো, আর জীবনের ছোটখাটো গল্পগুলো শেয়ার করতো। তাদের মধ্যে এমন একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল, যা কথায় নয়, চোখের চাহনিতেই প্রকাশ পেতো।

কিন্তু দোলার বাবা-মা কখনো দোলার এই বন্ধুত্বকে ভালোভাবে নেননি। রতন মল্লিক সবসময় মনে করতেন, দোলার পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দোলা যখন নিলয়ের কথা বলতো, তার বাবা চুপ করে থাকতেন। কিন্তু মায়ের চোখে একটা অদ্ভুত আশঙ্কার ছায়া থাকতো।

একদিন রাতে, দোলার বাবা তাকে ডেকে বললেন, "তোমার বয়স কম। জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে। পড়াশোনায় মন দাও, অন্য সবকিছু পরে হবে।" দোলা কিছু বললো না, কিন্তু তার ভেতরে একটা অদ্ভুত ক্ষোভ জন্ম নিল।

অন্যদিকে, নিলয়ও তার নিজের পরিবার থেকে চাপ অনুভব করছিল। তার বাবা-মা চাইতেন, সে গ্রামে ফিরে গিয়ে তাদের জমি আর ব্যবসা দেখাশোনা করবে। কিন্তু নিলয়ের হৃদয়ের গভীরে ছিল দোলার প্রতি এক অদম্য ভালোবাসা।

একদিন দোলা নিলয়কে বললো, "তুমি কখনো ভেবেছো, আমাদের সম্পর্ক কোথায় যাবে?" নিলয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "দোলা, দূরত্ব হয়তো আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু আমাদের ভালোবাসার বাঁধন কেউ ছিন্ন করতে পারবে না।"

সময় এগিয়ে চললো। দোলার বাবা-মা তাকে দেশের বাইরে পাঠানোর পরিকল্পনা করলেন। দোলা এই খবর শুনে ভেঙে পড়েছিল। সে জানতো, এই দূরত্ব তাদের সম্পর্ককে কঠিন এক পরীক্ষার মুখে দাঁড় করাবে।

বিদায়ের দিন এলো। দোলা নিলয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইল। কিন্তু নিলয় আসতে পারেনি। সে বাড়িতে আটকে পড়েছিল পরিবারের কারণে। দোলা চলে যাওয়ার আগে নিলয়ের জন্য একটা চিঠি রেখে গেলো।

চিঠিতে লিখেছিল:
"নিলয়, দূরত্ব হয়তো আমাদের আলাদা করবে, কিন্তু আমি জানি, আমাদের ভালোবাসা এই বাঁধন অতিক্রম করবে। আমি অপেক্ষা করবো সেই দিনের জন্য, যখন আমাদের জীবনের সব বাধা পেরিয়ে আমরা একসঙ্গে হবো।"

বিদেশে গিয়ে দোলা নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেল। সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিল, কিন্তু তার হৃদয়ের এক কোণায় সবসময় নিলয়ের স্মৃতি জেগে থাকতো। নিলয়ও গ্রামে থেকে পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে লাগলো। তবে তাদের মনে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস অটুট ছিল।

বছরের পর বছর কেটে গেল। দোলা যখন দেশে ফিরলো, তখন সে অনেক পরিণত, অনেক আত্মবিশ্বাসী। তার মায়ের হাসি ফিরে এসেছিল, আর বাবা গর্বিত ছিলেন মেয়ের সাফল্যে। কিন্তু দোলার মন তখনো নিলয়ের জন্য ব্যাকুল ছিল।

গ্রামে গিয়ে দোলা খুঁজে পেল নিলয়কে। নিলয় এখন তার বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছে, কিন্তু তার চোখে ছিল সেই পুরোনো ভালোবাসার চাহনি। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো।

নিলয় বললো, "তুমি জানো, দোলা, আমি কখনো ভেবেছিলাম না যে তুমি ফিরে আসবে। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের বাঁধনটা মজবুত।"

দোলা মৃদু হেসে বললো, "হয়তো দূরত্ব আমাদের আলাদা করেছিল, কিন্তু ভালোবাসার বাঁধন কখনো ছিঁড়ে যায়নি।"

তারা একে অপরের দিকে হাত বাড়ালো। আর সেই মুহূর্তে, তাদের মনে হলো, দূরত্ব যতই দীর্ঘ হোক, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো পথ হারায় না।

সমাপ্ত।

Comments

    Please login to post comment. Login